
কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার
কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটিতে ১৮৩৪ সালের ৩১ মে বুধবার (মতান্তরে ১০ জুন) এক বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাণিক্যচন্দ্র মজুমদার। মাতা ব্রহ্মময়ী দেবী। ১২৬৩ বঙ্গাব্দে তিনি ঢাকার মানিকগঞ্জের সূয়াপুরের মেয়ে অমৃতময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। ছেলেবেলা ছদ্মনাম ছিল রামচন্দ্র দাস, সংক্ষেপে রাম বলে ডাকতেন স্থানীয়রা। জীবনী ঘেঁটে দেখা যায় কৈশোরে কৃষ্ণচন্দ্র এক সময় কুসংসর্গে পতিত হন। তখন বন্ধুদের পরামর্শে তিনি একবার কলকাতার কালীঘাটে পলায়ন করেন, কিন্তু ধৃত হয়ে সেখান থেকে গৃহে প্রেরিত হন।
পরে তাঁর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। পিতৃহীন হয়ে জমিদার-পুত্রের সঙ্গে তিনি ঢাকা যান এবং এক জ্ঞাতি ঢাকা জজকোর্টের উকিল গৌরবচন্দ্র দাসের আশ্রয়ে থেকে ঢাকার নর্মাল স্কুলে শিক্ষালাভ করেন। এখানে তিনি সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন। এ সময় থেকেই তাঁর কাব্যচর্চা শুরু হয়। ঈশ্বর গুপ্তের উৎসাহে সংবাদ সাধুরঞ্জন ও সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্র এক সময় স্বধর্ম ও ঈশ্বরের বিরোধিতা শুরু করেছিলেন; পরে আবার শাক্ত, বৈষ্ণব ও ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন।
কর্ম জীবন
কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৫৪ সালে বরিশালের কীর্তিপাশা বাংলা বিদ্যালয়ের প্রধান পন্ডিতপদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮৫৬ সালে তিনি ঢাকার নর্মাল স্কুলে যোগদান করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে তিনি মডেল স্কুলে (১৮৬০) যোগ দেন। ১৮৭৪ সালে তিনি যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৮৯৩ সালে তিনি সেখান থেকে অবসরগ্রহণ করেন। তবে ১৮৮৫ সালে তিনি যশোর জেলা স্কুল থেকে সাময়িক চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন স্কুলে দীর্ঘ ১৯ বছর শিক্ষকতা করেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবান। অনেক কীর্তিমান ব্যক্তি তাঁর ছাত্র ছিলেন। মাঝখানে কিছুদিন তাঁর স্মৃতিবিভ্রম ঘটে; পরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। শেষ জীবনে কৃষ্ণচন্দ্র সেনহাটিতে বসবাস করেন এবং বিভিন্ন সংগীত রচনা করে অবসর জীবন কাটান। ১৯০৭ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
রচনাবলি
তাঁর প্রথম ও শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘সদ্ভাবশতক’ ১৮৬১ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। এই বইটির অধিকাংশ কবিতা নীতিমূলক; যা সুফী এবং হাফিজের ফার্সি কবিতার অনুসরণে রচিত। ১৩৩টি নীতি ও উপদেশমূলক এ কাব্যটি পারস্য কবি হাফিজ ও সাদীর কাব্যাদর্শে রচিত। বাল্যকালে একটি ছদ্মনাম ছিল রামচন্দ্র দাস, সংক্ষেপে রাম। তাই পরিণত বয়সে তিনি রামের ইতিবৃত্ত (১৮৬৮) নামে একটি আত্মচরিত রচনা করেন। মহাভারতের ‘বাসব-নহুষ-সংবাদ’ অবলম্বনে রচিত অপর গ্রন্থ মোহভোগ (১৮৭১)। কৈবল্যতত্ত্ব (১৮৮৩) তাঁর একটি দর্শনবিষয়ক গ্রন্থ। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় নাটক রাবণবধ। তবে প্রকাশিত গ্রন্থগুলো এখন বাজারে মেলে না। এছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫। যার মধ্যে আছে শুণবর্ণনা, শিববিবাহ, নীতিস্তবক, শিবপঞ্চাসৎ, ভারতেশ্বরীরর নিকট প্রার্থনীয়া রাজনীতি, বিবিধ সংগীত, নলোদয়ের বঙ্গানুবাদ, সংস্কৃত গদ্যপদ্যস্থাপনা বিধি, সৎপ্রেক্ষণ (দৃশ্যকাব্যবিশেষ), অনুবাদিত স্তোত্র, সংস্কৃত ব্যাকরণ, সংস্কৃত চম্পুকাব্য, ছাত্ররাজনীতি ও সংগীত বীথিকা।
সম্পাদিত পত্রিকা
১৮৬০ সালে মাসিক মনোরঞ্জিকা ও কবিতাকুসুমাবলী নামক পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৬১ সালে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হলে তিনি তার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর মালিকের সঙ্গে মতানৈক্য হলে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন এবং ১৮৬৫ সালে বিজ্ঞাপনী নামক পত্রিকার সম্পাদক হন। দেড় বছর পর তিনি আবার ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার সম্পাদক পদে প্রত্যাবর্তন করেন। অসুস্থতার কারণে সাংবাদিকতা ছেড়ে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এর দীর্ঘকাল পরে ১৮৮৬ সালে যশোর থেকে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় দ্বৈভাষিকী নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। কবিতাকুসুমাবলী ছিল পদ্যবহুল মাসিক পত্রিকা। সদ্ভাবশতক কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
শেষ কথা
যে জন দিবসে মনের হরষে/ জ্বালায় মোমের বাতি/ আশু গৃহে তার দেখিবে না আর/ নিশীথে প্রদীপ ভাতি। শৈশবে অপব্যয় নিয়ে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের এ কবিতা পড়ে বড় হননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। শুধু এ কবিতা নয়, কালজয়ী আরও অনেক কবিতায় সমৃদ্ধ কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষক কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জীবন। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ঈর্ষণীয় সমৃদ্ধ সেনহাটিতে শৈশবস্মৃতির এ কবির শেষ স্মৃতিচিহ্নগুলোও হুমকির সম্মুখীন।
অযত্ন-অবহেলায় দরিদ্রদশা। ভৈরব, আতাই ও চিত্রা নদীবেষ্টিত ব-দ্বীপ প্রধান উপজেলার ওই অংশে বিভিন্ন সময় বেরিয়েছে বহু বিখ্যাত মানুষ। চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন/ ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে।/ কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/ কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে। চির অমর এসব নীতি কবিতার জনকের পৈতৃকভিটা বলতে শুধু নামেই। কবির কোনো আত্মীয়-স্বজন এখানে থাকেন না। বসতভিটার কোনো চিহ্নও নেই। যে পুকুরটি ছিল সেটি দখল করে ভরাটের পর উঠেছে পাকা দালান। সামনের মাঠের দুই প্রান্তে দুটি প্রায় শতবর্ষী মন্দিরও ধুঁকছে।
নদীর পাড়ের রাস্তার ঘেঁষে কবির প্রিয় কামিনী গাছের পাশে একটি স্মৃতিচিহ্ন আছে। আছে একটি স্মৃতিফলক। একটি খোদাই করা ফলকে লেখা, ‘বাংলার অমর মঙ্গল কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার এর প্রিয় কামিনী ফুল গাছের স্মৃতি রক্ষার্থে দ্বিতীয় গাছটি রোপণ করেছিলেন খুলনার এক সময়ের জেলা প্রশাসক এস এম ফিরোজ আলম। ২০০৮ সালের এ ফলকটির অবস্থা দেখে গাছটির কি অবস্থা তা আর জানতে ইচ্ছে হলো না। কংক্রিটের ঢালাইও পায়নি রেহাই। অথচ এখানে যে কামিনী গাছটি ছিল তার নিচে বসেই কবি অনেক কবিতা লিখেছেন। আর কবির জীবনের একমাত্র ছবিটি সেই কামিনী গাছের নিচে বসেই তোলা। সঙ্গতকারণে এসব স্মৃতি রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারপ্রেমীরা।
প্যানেল