
খুলনা : দিঘলিয়ার সেনহাটিতে স্থানীয়দের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট
চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে? কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে? অথবা যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশিথে প্রদীপ ভাতি; কিংবা কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে; অথবা পর দোষ তোমার নিকটে যেই কয়, বলে সে তোমার দোষ অপরে নিশ্চয়; এমন নীতি কবিতার জনক কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি অসংখ্য গানও লিখেছেন। পেশা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতায়। সে কারণেই তাঁকে একজন স্বনামধন্য বাঙালি কবি ও পত্রিকা সম্পাদক বলে অভিহিত করা হয়। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাঁর পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা না হলেও তিনি সংস্কৃত ও ফারাসি ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করেন। এমন মানুষটির স্মৃতির উদ্দেশ্যে খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটিতে কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হলেও তাঁর স্মৃতি চিহ্নগুলো কালের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। এখনো যে টুকুন আছে সেটি যদি সুসজ্জিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা না যায় তাহলে বাংলার এমন নীতি কবি বাঙালি হৃদয় থেকে হারিয়ে যাবে বলে মন্তব্য কবিপ্রেমীদের। এছাড়া স্মৃতি রক্ষার্থে বারবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও বাস্তবে রূপ না পাওয়ায় অসন্তোষে সংস্কৃতিকর্মীরা।
খুলনা শহরের অদূরে খালিশপুর এলাকা থেকে ভৈরব নদ পেরিয়ে বাংলার অমর কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি বাজারে এখনো দৃশ্যমান কিছুটা তাঁর স্মৃতিচিহ্নগুলো। কোনো রকমে টিকে আছে কবির ব্যবহৃত বেঞ্চটি। এর পাশেই রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। আর ভৈরব নদের ঘাটের থাকা সিঁড়ি, বেঞ্চসহ সব কিছুই আজ অস্তিত্বহীন। পৈতৃক ভিটার পেছনের অংশে গড়ে তোলা হয়েছে ধর্মীয় উপাসনায়। বাজারের আরেক পাশে ১৯১৪ সালে কিছু জমি উদ্ধার করে কবিপ্রেমীরা প্রতিষ্ঠিত করে কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট।
এক কক্ষের একটি ছোট ভবন, সামনে আরও ছেট বারান্দা। তবে ভীষণ সুদৃশ্য অনেক পরিপাটি। কিন্তু ভিতরে কবির দুটি ছবি, ছাড়ানো ছিটানো টেবিল চেয়ার, বই রাখার কয়েকটি তাক ছাড়া আর যেন কিছুই নেই। তবে তাক দেখে বোঝা যায় কবির লেখা পাণ্ডুলিপি ও সংগ্রীহিত বই হয়তোবা এখানে ছিল। ভবনের পিছনে কবি মঞ্চ। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে স্থানীয়দের উদ্যোগ নামমাত্র অনুষ্ঠান হয়। আর সামনের মাঠটি একটু বৃষ্টি হলে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। পাশের দেওয়াল দেখে বোঝাই যায় দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে পড়েছে মাঠটি। বেদখল হয়ে গেছে আশপাশের জমিও। তবে কতটা জমি আছে আর কতটা জমি দখল হয়েছে সেই হিসাব নেই প্রশাসনসহ কারও কাছেই। অথচ এসব স্থানে বসে কবি অসংখ্য নীতি কবিতা লিখছেন, যা পরবর্তীতে পাঠ্য বইয়ে অংশ হয়েছে। হয়েছে ভাবসম্প্রসারণ। এক সময় শিক্ষার্থীদের বাংলা দ্বিতীয় পত্রের প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায় উল্লেখ থাকত।
স্থানীয়দের উদ্যোগে চলে ইনস্টিটিউট
কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট সদস্য স্থানীয় সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, এরই মধ্যে বেদখল হয়ে গেছে কবির সিংহভাগ জমি। কেউ করেছেন দোকান ঘর, কেউবা বসতি। ভবন উঠেছে সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানেরও। অর্থাৎ হরিলুট হয়েছে জমি ও স্থাপনা। বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে কোথায় কবি বংশের জমি ছিল সেটিও খালি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই। সেজন্য এ বিষয়টি নিয়ে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় ব্যক্তি উদ্যোগে কবির স্মৃতিভূমি রক্ষা করা কিংবা নতুন কোনো স্থাপনা তৈরি করা একেবারেই সম্ভব নয়। আরিফুল ইসলাম হাসান আরও বলেন, কিছু কবিপ্রেমীদের উদোগে ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম নামমাত্র চলমান রয়েছে। এখানে কোনো ফান্ড নেই।
১৩ জানুয়ারি নীতি কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। দিবসটি পালন উপলক্ষে সরকারিভাবে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা না। তবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ব্লাড ব্যাংক’ এর উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়। স্থানীয়দের অনুদানে কর্মসূচির মধ্যে থাকে কবির স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তারই প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, আলোচনা সভা, কবিতা আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এছাড়া কবির জীবনী নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘কৃষ্ণ চন্দ্র’ প্রদর্শন করা হয়েছে কখনো কখনো। হয়েছে পটগানও।
আত্মশুদ্ধির প্রতীক
আধুনিক পটগানের লেখক কবি মো. ইলিয়াস ফকির। তিনি কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জীবন ও দর্শন নিয়ে পটগান রচনা করেছেন। গানে এক অংশে তিনি লিখেছেন- ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীন চেতায় দৃঢ় ছিলেন কবি/ নিচের এই উক্তিতে ফোটে তার বাস্তব ছবি/ যদ্যপি বল্কল পর রহ উপবাসী/ হইওনা হইওনা তবু পরের প্রত্যাশী/ কর্মস্থলে কবির যখন বেতন বৃদ্ধি হলো/ সংবাদ শুনে অনেকেই খুশি হয়েছিল/ বেতনের বর্ধিত অংশ রহিত করিবার/ দরখাস্ত করছিলেন কর্তৃপক্ষ বরাবর/ কারণ পূর্ব বেতনে আমার সংসার চলে যায়/ বেশি টাকা পেলেই সেইটা হবে অপচয়/ নৈতিকতার কত যে পাগলামি তার জীবনে/ পঠন বিনে কিছুই জানা যাবে না পটগানে/ একশ তেত্রিশটি কবিতা সদ্ভাবশতকেতে/ আখ্যায়িত এ গ্রন্থ বাংলার গীতা নামেতে/ মরণের পরেও লোক ততকাল বেঁচে রয়/ যতকাল কীর্তিস্তম্ভে নাম তার লেখা রয়/ পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন/ আপনা অভাব ক্ষোভ রহে কুক্ষণ/ এমনি, (শত) বাস্তব দর্শন- সদ্ভাবশতকের পাতায়।
পটগানের আরেক অংশে ইলিয়াস ফকির লিখেছেন, কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার মানবের কল্যাণে/ আত্মশুদ্ধির প্রতীক তিনি জীবন ও দর্শনে/ সদ্ভাবশতকে লিখন অমর বাণী তাঁর/ খুলতে সক্ষম মানব মনে চেতনার দুয়ার/ সত্যিকারে আত্মা যদি কলুষমুক্ত রবে/ বলছেন তিনি সেকি কভু মরণের ভয় পাবে/ ওগো মৃত্যু তুমি মোরে কি দেখাও ভয়/ ও ভয়ে কম্পিত নহে আমার হৃদয়/ পর নিন্দা চর্চা যেজন করতেছে সংসারে/ সরলভাবে বলছেন তিনি বাস্তবতা ধরে/ পর দোষ তোমার নিকটে যেইজনা কয়/ বলে সে তোমার দোষ অপরে নিশ্চয়/ এমনি অনেক মহৎ কথা সদ্ভাবশতকে।
নীতি কবিতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে একমাত্র এমফিল করা (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে থেকে ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে) ব্যক্তিত্ব, দিঘলিয়ার সারওয়ার খান ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ গবেষক আলতাফ হোসেন বলেন, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার বাংলা সাহিত্যের একজন ব্যতিক্রম ধর্মী কবি। বিশেষ করে বলা যায় নীতি কবিতার ইতিহাসে তিনি সম্রাট। কেননা বাংলা সাহিত্যে আর কোন কবি নীতি কবিতা লিখে এত বিখ্যাত হননি। ১৮৬১ সালে তাঁর সদ্ভাবশতক কাব্যগ্রন্থ বের হয়। একই বছর মাইকেল মধুসুদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। অথচ এই আধুনিক কাব্যগ্রন্থের চেয়ে বেশি বিখ্যাত ছিল সদ্ভাবশতক কাব্য। তিনি আরও বলেন, আমরা ভাবসম্প্রসারণ সেগুলো অধিকাংশ লেখক কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। যেমন, কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে; অথবা চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে? কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে? তিনি ব্যতিক্রম ছিলেন এ কারণে যে তাঁর জীবন ও কাব্য একাকার হয়ে গেছে। যা অন্য কারো জীবনে খুব একটা দেখা যায় না।
আলতাফ হোসেন বলেন, কবি প্রথম জীবনে কিছুটা বাউন্ডুলে থাকলে পরবর্তী জীবনে একজন আপদমস্তক সজ্জন হিসেবে জীবন যাপন করেছেন। একবার তিনি আদালতে গিয়ে হাজির হলেন, বিচারককে বললেন আমি অনেক অপরাধ করেছি আমাকে শাস্তি দেন। বিচারক বললেন কি কি অপরাধ করেছেন। কলম চুরিসহ এমন ছোটখাটো বিষয় বললেন। শুনে বিচারক হেঁসে দিয়ে বললেন, আপনি অপরাধ করেছেন, শাস্তি চেয়েছেন, আমি বিচারক আপনাকে মাফ করে দিলাম। কেননা অপরাধ বুঝে নিজেকে সুধরে নিয়েছেন তাই। অর্থাৎ তাঁর নীতি নৈতিকতা কথা শুধু কবিতায় নয়; বাস্তব জীবনেও তিনি সেটা চর্চা করেছেন।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের যান্ত্রিক জীবন এবং আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে এসব নীতি বাক্য হারিয়ে ফেলছি। আমরা আত্মভুলা হয়ে যাচ্ছি। আমরা কিংবা আমাদের শব্দটি বেশি ব্যবহার হচ্ছে না। আমি শব্দটি ঘুরে ফিরে আসে। সেজন্য নীতি নৈতিকতাও আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এই সময়ে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের মতো কবি ও কবিতা দরকার। তাহলে মানুষের মধ্যে এই বোধ আরও সুদৃঢ়ভাবে জাগ্রত হবে। তবে পরিতাপের বিষয় হলো সেনহাটিতে কবির জন্ম ও মৃত্যু হলেও সেখানে তাঁর স্মৃতিচিহ্নগুলো নেই বলা চলে। দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বাড়ি দেখতে আসেন। কিন্তু এসে কিছুই না পেয়ে এক বুক ব্যথা নিয়ে ফিরে যান। বিষয়টা এতই দুঃখজনক যে তাঁর বসত বাড়িটি কোথায় ছিল সেটাই এখন খুঁজে পাওয়া ভার। তাই আমি মনে করি আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে নীতি নৈতিকতার বিস্তারের স্বার্থে তাঁর সবকিছু সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। যশোরের কেশবপুরে যেমন মাইকেল মধুসুদন দত্তের বাড়িটি সংরক্ষণ করা হয়েছে এটিকেও ওইরূপ স্মৃতি জাদুঘরে রূপ দেওয়া যেতে পারে, করা যেতে পারে কমপ্লেক্স কিংবা অন্য কোন স্থাপনা। বিগত সরকারগুলোর আমলে আমরা বারবার আশ্বাস পেয়েছি কিন্তু বাস্তব রূপ দেয়নি কেউই। তবে আমি মনে করি বর্তমান সরকার উদ্যোগটি গ্রহণ করবে। কেননা এই সরকার নীতি নৈতিকতা চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা জন্যই তৈরি হয়েছে। এটি হলে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার আগামীতে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
বাঙালি সম্পদ
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব স্বপন কুমার গুহ বলেন, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার শুধুমাত্র একজন কবি কিংবা সাংবাদিক নন। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন এই উপমাহাদেশ এভাবে দেশ ভাগের বিষয়টি ছিল না। তিনি ছিলেন এতদাঞ্চলের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। পরীক্ষাগুলোতে প্রথম স্থান অধিকার করতেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত করেন। অর্থাৎ শিক্ষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল ভিন্ন রকমের। এজন্য তিনি বাংলা ছাড়াও বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করেন। এই আহরিত জ্ঞান পরে তিনি কবিতায় প্রতিফলন ঘটান। সদ্ভাবশতক নামের তিনি যে কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছিলেন সেখানকার প্রতিটি কবিতাই মানুষের উপদেশমূলক ও শিক্ষামূলক। বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষিদের জ্ঞান অর্জনের অন্যতম গ্রন্থ সদ্ভাবশতক। পরবর্তীতে এই গ্রন্থের কবিতার জন্যই তিনি বিশেষ পরিচিতি পেয়েছিলেন। হয়েছিলেন সমাদৃত। গ্রন্থে ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশিথে প্রদীপ ভাতি’ এই কবিতার মধ্যে যে বার্তাটা তিনি মানবজাতিকে দিয়েছিলেন তা কে না জানে। এভাবেই প্রতিটি কবিতায় তিল আকৃতির কথায় তাল আকৃতির বার্তা। সেই আমলে যখন সাংবাদিকতার কথা ভাবাই কষ্টসাধ্য ছিল তখন তিনি ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকতা করেছেন দায়িত্বের সঙ্গে। প্রকাশনার দায়িত্বেও ছিলেন। এত কিছু করেও তিনি অর্থ বৈভবের মালিক হননি। সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি শেষ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে নিজ পিতৃভূমি সেনহাটিতেই ফিরে এসেছিলেন। সেখানবার ভৈরব নদের পাড়, নদ সংলগ্ন বেঞ্চ, গাছের নিচে ও আশপাশের এলাকায় বসে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। শুধু কবিতাই নয় অন্যান্য লেখালেখিরও সিংহভাগ তিনি এই সময়েই লিখেছেন। স্বপন কুমার গুহ আরও বলেন, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার শুধু খুলনার না, শুধু বাংলাদেশের না, তিনি বাঙালিদের সম্পদ। কেননা তিনিই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির দর্শনের জায়গায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। এমন মানুষটির স্মৃতি রক্ষায় তৎকালীন কবিপ্রেমীরা কিন্তু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র ইনস্টিটিউট। তৈরি করা হয়েছিল স্মৃতিফলক। তবে পরবর্তীতে ভালোবাসায় ভাটা পড়ে। অনেক দিন পরে সাহিত্যিক অধ্যাপক সুশান্ত সরকার তাঁকে নিয়ে একটি বই লেখেন। যেটি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি থেকে। বইটি পড়ে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারকে নিয়ে নতুন করে মানুষ ভাবতে শেখেন।
তিনি বলেন, তাঁর স্মৃতি রক্ষায় আমরা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলেছি। এ সময় অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদিরসহ অনেকেই ছিলেন। যেহেতু কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার নামের ইনস্টিটিউটের বয়স শতবর্ষের ওপরে হয়েছে সেই জন্যই আলোচনা চলতে থাকে। পরবর্তীতে সেখানে একটি সহিত্য সাংস্কৃতিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তখন এটার একটা রেজিস্ট্রেশন দেয়। এরপর ওই জায়গাটিতে একটি কমপ্লেক্স করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পনার মধ্যে যেটি ছিল সেটি হচ্ছে তাঁর যে সদ্ভাবশতক গ্রন্থটি ছিল সেই গ্রন্থের ১৩৩টি কবিতা পাথরে খোদাই করে রাখা। অর্থাৎ দর্শনার্থীরা যখন ঘুরে ঘুরে দেখবে তখন সেগুলো পড়তে পারবেন। এছাড়া সভা কক্ষ ও লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন স্থাপনা সেখানে থাকবে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নীতিমালা হলো যা সেখানে যে অবস্থায় আছে সেটি সেই অবস্থায় সংরক্ষণ করা।
সেকারণেই যেখানে তখন আর কিছু করা গেল না। এরপর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। সেই সময় তাদের উদ্যোগ ছিল এ ধরনের যেসব গুণী মানুষ রয়েছে তাদের বসতভিটা ও স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণ করা। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০ জন বিশেষ মানুষকে ঘিরে কমপ্লেক্স তৈরির জন্য অনুমোদন পেয়েছিল। যার মধ্যে ছিল কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। এই কাজের অংশ হিসেবে শিল্পকলা একাডেমির তখনকার মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন। কিন্তু সমস্যা বাধে জায়গা নির্ধারণে। কৃষ্ণচন্দ্রে যে স্মৃতিফলক ও নদীর পাড়টি রয়েছে সেই জায়গাটিই মাথায় রাখা হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে জমি উদ্ধার ও জমি অধিগ্রহণে আটকে যায় পরিকল্পনাটি। তিনি আরও বলেন, যেহেতু এখনো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন রয়েছে সেহেতু এটি বাস্তবায়ন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদি হয় তাহলে এটি হবে নীতি বৈচিত্র্যের যে কথন সেটি নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম উদ্যোগ, যা থেকে তারা শিক্ষা নিতে পারবে। ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পরিদর্শনকালে লিয়াকত হোসেন লাকী বলেছিলেন, সরকারের স্বপ্ন সারাদেশের বিলুপ্তপ্রায় ইতিহাস ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা। লুপ্তপ্রায় যে শব্দ ব্যবহৃত হয় সেটিকে অবলুপ্ত করে দেওয়া। লুপ্তপ্রায় শব্দটিকে যেন আমাদের ব্যবহার করতে না হয়। তিনি বলেছিলেন, কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের যে দর্শন এবং সৃজনশীল কাজগুলো আছে সেগুলো সংরক্ষণ করে বর্তমান প্রজন্ম থেকে শুরু করে আগত পরবর্তী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে। কবির স্মৃতি বিজড়িত সকল জায়গায় পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের মহাপরিকল্পনা করা হবে। সে সময় সঙ্গে ছিলেন দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাহাবুবুল আলম, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তরের নির্বাহী পরিচালক স্বপন কুমার গুহ, সেনহাটি আলহাজ সরোয়ার খান ডিগ্রি কলেজের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (বর্তমানে অধ্যক্ষ) মো. আলতাফ হোসেন, সাংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব দীপংকর দীপন, স্বপন মাহামুদ, নিশান সাবের, সেলিম হোসেন, কবি কৃষ্ণ চন্দ্র ইনস্টিটিউটের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোল্যা মাকসুদুল ইসলাম, ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকার ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি শেখ মনিরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠক আলোর মিছিলের উপদেষ্টা মো. হাবিবুর রহমান, মো. আসলাম মুন্সী, দিঘলিয়া প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি মো. একরামুল হোসেন লিপু, সাংবাদিক শেখ রবিউল ইসলাম রাজিব, কবি কৃষ্ণ মজুমদার ব্লাড ব্যাংকের সভাপতি প্রসেনজিৎ শিকদার, সাধারণ সম্পাদক প্রসেনজিৎ বিশ্বাস, মো. আলম প্রমুখ। বলা হয় এটি এ যাবৎকালের সরকারের পক্ষ থেকে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের নিবাস ও স্মৃতিভূমি রক্ষার অন্যতম প্রয়াশ। কিন্তু ওই পর্যন্তই, যা পরবর্তীতে আর আলোর মুখ দেখেনি।
স্মৃতি রক্ষায় উদ্যোগ
জেলা প্রশাসনের কাছেও সঠিক হিসেব নাই কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ঠিক কতটা জমি বেদখল হয়েছে বা কতটা জমি ছিল সেটিও জানা নাই। তবে রেকর্ডপত্র দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেন জেলা প্রশাসক। স্মৃতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগের কথাও জানালেন খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, এমন নীতি কবি আর কবে আসবে কিংবা আদৌ আসবে কিনা সেটি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নতুন প্রজন্মে কাছে তাঁর নীতি কবিতাগুলো পরিচয় করে দিতে হবে। তাঁর লেখাগুলো পড়লে নতুন প্রজন্ম অনেক সচেতন হতে পারবে। এসব করতে হলে আগে তাঁর পৈতৃক ভিটা ও স্মৃতি চিহ্নগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। সে জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এরপর তিনি মেনে নিয়ে বলেন, এমন একজন জ্ঞানী মানুষকে নিয়ে আমাদের আগেই যেটা করার কথা ছিল তার কিছুই আমরা করতে পারিনি। আর কালক্ষেপণ নয় এখনই সময় কিছু করার।
প্রবীর বিশ্বাস, খুলনা অফিস
প্যানেল