ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ইকো পার্ক ও ট্যুরিস্ট কটেজ

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ১৩ জুন ২০২৫

ইকো পার্ক ও ট্যুরিস্ট কটেজ

বাগেরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি পরিবেশবান্ধব কাঠের বসতবাড়ি

কেউ তৈরি করছেন বসতঘরের দরজা, জানালা, কেউ ফ্রেম আবার কেউ তৈরি করছেন দেয়াল। এমন কি ছাদও তৈরি হচ্ছে কাঠের। সবশেষে দক্ষ শ্রমিকদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় রং পালিশে শেষ হচ্ছে নান্দনিক ও পরিবেশবান্ধব কাঠের বসতবাড়ি বা ট্যুরিস্ট কটেজ। এ ট্যুরিস্ট কটেজের ভেতর-বাইরে এমন অনিন্দ্য সুন্দর কারুকাজ, যা প্রথম দৃষ্টিতেই আকর্ষণ করে।  
এমন দৃশ্য দেখা যায় বাগেরহাট সদর উপজেলার প্রত্যন্ত কররী গ্রামের একটি ফার্নিচারের কারখানায়। বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের সিএনবি বাজারসংলগ্ন এ গ্রামের ‘ন্যাচারাল ফাইবার’ নামের কারখানায় তৈরি ঘরগুলো রপ্তানি করা হচ্ছে ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের ‘পাইরি ডাইজা ইকো পার্কে’। 
শুধু এই ‘ট্যুরিস্ট-কটেজ’ নয়, কাঠ দিয়ে তারা তৈরি করছেন ‘বেবি ব্যালেন্স সাইকেল’, ‘সান বেড’, ‘হোটেল বেড’, ‘কুকুর-বিড়ালের খেলনা’সহ পরিবেশবান্ধব আরও আকর্ষণীয় ফার্নিচার। যার চাহিদা তৈরি হয়েছে বিশ্ববাজারে। এসব পণ্য নতুন বাজার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নবদিগন্ত উন্মোচিত করছে।

বাগেরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি পরিবেশবান্ধব কাঠের বসতবাড়ি
আশপাশের এলাকা থেকে সংগ্রহ করা কাঠ দিয়ে বসতবাড়ি তৈরি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিতে। কাঠের তৈরি এই বাড়ির কাঠামো, দেওয়াল, দরজা-জানালা এমনকি ছাদও কাঠের তৈরি। প্রথমে কাঠ কেটে ও সাইজ করে পুরো বাড়িটি তৈরি করেন শ্রমিকরা। প্রতিটি বসত ঘর ১১ মিটার লম্বা এবং চওড়া সোয়া ৪ মিটার। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি। এরপর বিভিন্ন অংশকে ছোট আকারে খণ্ড খণ্ড করা হয়। ফলে পুরো বাড়িটিকে স্বল্প স্থানে সহজে পরিবহন করা যায়। পরবর্তীতে এই খণ্ডাংশগুলোজুড়ে যেকোনো জায়গায় স্থাপন করা সম্ভব।
এ বছরে ১২০টি ঘর রপ্তানি হবে। চলতি জুন মাসে প্রথম চালানে যাচ্ছে এমন ৩০টি কাঠের তৈরি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বসত ঘর বেলজিয়ামের ‘পাইরি ডাইজা ইকো পার্কে’। প্রতিটি ঘরের মূল্য ত্রিশ হাজার ইউরো। যা বাংলাদেশী মূদ্রায় প্রায় ৪১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরীর ন্যাচারাল ফাইবার প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, পরিবেশের ক্ষতি করে না এমন কাঁচামাল ব্যবহার করে ইউরোপের দেশ বেলজিয়াম থেকে চলতি বছরের প্রথম দিকে ১২০টি বসতবাড়ি তৈরির অর্ডার পান। এরপর থেকে পরিবেশবান্ধব বসতবাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি। 
ব্যবসায়ী মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ‘বেলজিয়ামের একটি ইকো পার্কের জন্য বায়ার-রা অর্ডার দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব কাঠের তৈরি এরকম ১২০টি বসতঘর তাদের প্রয়োজন, যা চলতি বছরের জুন থেকে রপ্তানি শুরু হচ্ছে। ওই ইকোপার্কে ঘরগুলো আমাদের সেট করে দিয়ে আসতে হবে।’
তার ভাষায়, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে, দেশি মেহগনি কাঠ দিয়ে এই ঘরগুলো তৈরি করা হয়। এছাড়া, এসব বাড়ির কাঁচামাল বায়োগ্রেডিবল বা পরিবেশে মিশে যায়। পরিবেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো কিছুই ব্যবহার করা হয়নি। এ ঘরের মধ্যে ৫ জনের একটি পরিবার খুব সাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবেন। এ ঘরের বিভিন্ন খন্ডাংশ খুলে নিয়ে রপ্তানি করা হবে। আবার ওই পার্কে আমাদের কারিগররা সেট (স্থাপন) করে দিয়ে আসবেন। পরিবেশবান্ধব এই বাড়ি রপ্তানির মাধ্যমে নতুন বাজার সৃষ্টি, কর্মসংস্থান তৈরি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ উন্মোচিত হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই উদ্যোগ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।’ 
প্রথমবারের মতো নিজ দেশের এই পণ্য ইউরোপের বাজারে রপ্তানিতে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে শ্রমিকরাও খুশি। কাঠমিস্ত্রী মোজাহিদ বলেন, ‘আমাদের প্রথমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারপরে ডিজাইন দেখে সম্পূর্ণ একটি বসতঘর তৈরি করেছি। এরপর কোম্পানি ও বিদেশি লোকজন দেখে পছন্দ করেছে। এখন আমরা পুরোদমে কাজ করছি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রতিটি বসতঘর তৈরি করতে ১৯-২০ দিন লাগে। সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন শ্রমিক এই বাড়ি তৈরির কাজ করছেন।’ 

বাগেরহাটে নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি গহনা রপ্তানি হচ্ছে নানা দেশে
কারখানার শ্রমিক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আগে কখনো এই ঘর তৈরি করিনি। এখন দেখছি খুবই সুন্দর হয়েছে ঘরগুলো। সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে এভাবে ঘর তৈরি করা যায় কখনো ভাবতেও পারিনি। দুটি বেডরুমে মোট পাঁচজন থাকার উপযোগী এ ঘর সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঘরের একপাশে একটি বারান্দা, বেডরুমের সঙ্গে বাথরুম ও বসার ঘর রয়েছে। বসার ঘরে টেলিভিশন দেখা এবং ঘরের ভেতরেই রান্না করারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ঘরের প্রতিটা অংশ খুলে প্যাকিং করে পাঠানো হবে বেলজিয়ামে।’
সাইফুল নামের অপর এক শ্রমিক বলেন, ‘এই ঘরে প্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র থাকবে। আমাদের হাতে তৈরি এমন কাঠের ঘর বিদেশে যাচ্ছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের। আমরা এই ঘর তৈরি করতে পেরে খুবই আনন্দিত। খুব সুন্দর ডিজাইন, পরিবেশবান্ধব এবং তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় ইউরোপের বাজারে এ ঘরের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।’
কথায় কথায় জানা গেল, গত বছরের শুরুর দিকে গ্রীসের কোকোম্যাট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেলজিয়াম থেকে কাঠের ঘর তৈরির অর্ডার পায় বাগেরহাটের ‘ন্যাচারাল ফাইবার’ নামক প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকে কাঠের ঘরের স্যাম্পল তৈরি শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। কাঠের তৈরি স্যাম্পল ঘরটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পছন্দ হওয়ায় চুক্তি অনুযায়ী চলতি জুন ’২৫ মাসের মধ্যে ১২০টি ঘর তৈরি করে রপ্তানির জন্য কাজ শুরু করে তারা। 
আমদানিকারক ‘পাইরি ডাইজা ইকো পার্কের’ প্রধান স্থপতি পেসেল ডি বেক বলেন, আমরা আমাদের চাহিদা অনুযায়ী স্যাম্পল দেখাই, প্রতিষ্ঠানটি আমাদের চাহিদা মতো নমুনা ঘর তৈরি করে দেখায়, যা খুবই দৃষ্টিনন্দন। এরপর আমরা চুক্তিবদ্ধ হই। প্রথম অর্ডারের ১২০টি ঘর আমরা চলতি বছরের মধ্যে ইউরোপের দেশে নিতে পারবো বলে আশা করছি।’ 
তিনি আরও বলেন, আমরা এখানে এসেছি, কারণ আমরা খুঁজে পেয়েছি এখানের মানুষ কারুশিল্পে দক্ষ। এছাড়া এই এলাকার কাঠ খুবই উন্নত। আমরা এই কাঠের বাড়িগুলোয় থেকেছি, তবে সেখানে অবশ্যই মশার ভয় ছিল। আমাদের দেশে এত মশা নেই। তবে আমরা বাড়িগুলোতে থেকে খুবই শান্তি পেয়েছি। কাঠের ঘর হওয়ায় এর মধ্যে থাকতে খুবই প্রশান্তি লেগেছে, মনে হয়েছে প্রকৃতির কাছেই আছি। বাংলাদেশি কাঠমিস্ত্রিদের দক্ষতা অনন্য। আমরা মনে করছি সামনে আরও প্রজেক্ট আমরা আনতে পারবো।’
কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার শংকর বিশ্বাস বলেন, আমরা এখানে যে ঘর তৈরি করছি তা বিশ্বমানের পরিবেশবান্ধব ঘর। একটি ঘরে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সব কিছুই এ ঘরে থাকছে। ক্রেতাদের ডিরেকশন (নির্দেশনা) অনুযায়ী আমরা প্রথমে যে ঘরটি কমপ্লিট করেছি সেটি ক্রেতারা পছন্দ করেছেন। এর মাধ্যমে কাঠের তৈরি ঘর রপ্তানিতে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। আমাদের কাছ থেকে তারা মোট ১২০টি ঘর ক্রয় করবেন। আমরা অত্যন্ত যত্ন সহকারে কাজ করছি, যাতে ইউরোপের বাজারে আমাদের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়।’ 
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজ আহমেদ আরও বলেন, আমরা ক্রেতাদের নির্দেশনা ও ডিজাইন অনুযায়ী একটি আস্ত ঘর তৈরি করে প্রথমে দেখিয়েছি। ক্রেতারা আমাদের যে ডিজাইন ও ডিরেকশন দিয়েছেন, সে অনুযায়ী কাজ হয়েছে কিনা সেটি তারা যাচাই করে দেখেছেন। তারা এই ঘরে রাত যাপন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। চলতি জুন মাসের মধ্যে মোট ১২০টি ঘর তৈরি করে তাদেরকে দিতে হবে। আমাদের লোকজন গিয়ে পাইরি ডাইজা ইকো পার্কে ঘরগুলো সেট করে দিয়ে আসবে।’ 
তিনি আরও বলেন, কাঠের সঙ্গে ঘরের যেসব ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল জিনিসপত্র ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড হতে হবে। আমরা প্রাথমিকভাবে স্যাম্পল ঘরে বাংলাদেশের লোকাল প্রোডাক্ট ব্যবহার করেছি। এই একই প্রোডাক্টগুলো আমরা ইউরোপ থেকে কিনে সাপ্লাই দেব। ঘরের একেক অংশে একেক রকম কাঠের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশি কাঠের পাশাপাশি আফ্রিকার ঘানা থেকেও কিছু কাঠ সংগ্রহ করতে হয়েছে ঘরের একটি অংশে ব্যবহারের জন্য।’
বাগেরহাট ন্যাচারাল ফাইবার কারখানার কনসালট্যান্ট মো. মনিরুজ্জামান মোল্লা শাহিন বলেন, এই ঘরগুলো যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী মোংলা বন্দর দিয়ে রপ্তানি করা যেত, তা হলে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হতো। আমাদের পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাঠাতে হয়। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাই, আমাদের পণ্য যাতে মোংলা বন্দর দিয়ে পাঠাতে পারি, সে ব্যবস্থা করতে।’  
প্রকৃতিপ্রেমী খোকন মল্লিক বলেন, এই কাঠের ঘর আমাদের বাগেরহাটসহ সুন্দরবন উপকূলের দক্ষিণ অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু শৌখিন লোকেরা এক সময়ে তৈরি করে বাস করতেন। সেই চিন্তা থেকে আধুনিকভাবে এই কাঠের ঘর বানিয়ে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দেশের পক্ষে উপকার হবে। অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তির যুগে আমাদের দেশে, আমাদের কারিগর বা’ মিস্ত্রীদের তৈরি এই ‘ট্যুরিস্ট কটেজ’ আমাদের আবাসন ও দক্ষ কারু শিল্পের ঐতিহ্যের গর্বিত স্বাক্ষর বহন করে। এতে আমাদের সুনাম বাড়বে।’
শিশুদের জন্য নিরাপদ 
কাঠের সাইকেল

প্রথম দর্শনেই মন ছুঁয়ে যায়। দেখতে খেলনা মনে হলেও এটি ‘বেবি ব্যালেন্স সাইকেল’। যার চাকা থেকে শুরু করে পুরো কাঠমোই কাঠের তৈরি। দেশের বাইরে পরিবেশবান্ধব এ ‘বেবি ব্যালেন্স সাইকেল’ ব্যবহার হচ্ছে বাহন হিসেবে। মনোমুগ্ধ এ সাইকেল বাগেরহাটের বিসিক শিল্প নগরীর ‘ন্যাচারাল ফাইবার’ নামের প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করলেও, তা বাংলাদেশের কোনো বাজারে বিক্রি হয় না। সরাসরি যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে। কাঠ দিয়ে নিপুণ হাতে বেবি ব্যালেন্স সাইকেল তৈরি করেন স্থানীয় দক্ষ কারুশিল্পী ৩০ নারী-পুরুষ। এদের কেউ চাকা তৈরিতে অভিজ্ঞ, কেউ তৈরি করেন সাইকেলের হ্যান্ডেল বা ফ্রেম। রং পলিশ করার পর খুবই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে প্রতিটি সাইকেল। এভাবে ৩০ জন কর্মী মিলে প্রতিদিন তৈরি করেন অন্তত ৩০টি সাইকেল। 
এই সাইকেল তৈরির উদ্যোক্তাও বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরীর ন্যাচারাল ফাইবার নামের প্রতিষ্ঠানটি। শুধু এই বাইসাইকেল নয়, কাঠ দিয়ে তারা তৈরি করছেন সান বেড, হোটেল বেড, কুকুর-বিড়ালের খেলনাসহ পরিবেশবান্ধব আরও আকর্ষণীয় ফার্নিচার। যার চাহিদা তৈরি হয়েছে বিশ্ববাজারে। গত বছর প্রথমবারের মতো নিজ দেশের পণ্য ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করতে পেরে খুশি শ্রমিকরা। 
সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানায় কাঠের সাইকেল তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। কেউ তৈরি করছেন চাকা, কেউ তৈরি করছেন হ্যান্ডেল, আবার কেউ সাইকেলের ফ্রেম। সবশেষে শ্রমিকদের নিপুণ হাতে কাঠের বাইকে নানান রং দিয়ে পলিশ করা হচ্ছে।
বিসিক শিল্প নগরীর ন্যাচারাল ফাইবার কারখানায় সুপার ভাইজার আব্বাস বলেন, আকাশমণি, মেহগনি ও গামারিসহ বিভিন্ন উন্নতমানের কাঠ দিয়ে বিদেশি শিশুদের জন্য বেবি ব্যালেন্স সাইকেল তৈরি হয়েছে। এই সাইকেল তৈরি করতে দেড় থেকে দুই দিন সময় লেগেছে। সাইকেলটি তৈরিতে ১১টি পার্টের (অংশে) প্রয়োজন হয়। কারখানার বিভিন্ন স্থানে পার্টগুলো তৈরি করা হয়। নির্দিষ্ট একটি স্থানে সকল পার্ট একত্র করে একটি সাইকেলে রূপান্তরিত করা হয়। পরে রং-পালিশে তৈরি হয় প্রতিটি বেবি ব্যালেন্স সাইকেল। 
কারখানার অপর নারী শ্রমিক পূজারানী বলেন, এখানে কাজ করে যে বেতন পাই তাতে আমার সংসার এবং ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চলে। এখানে বাচ্চাদের সাইকেল তৈরি করতে পেরে আমরা খুশি।
রং মিস্ত্রি মামুন শেখ বলেন, প্রতিদিন কারখানায় প্রায় ৩০টি সাইকেল তৈরি করা হচ্ছে। আমরা এই কাজগুলো করে আসলেই আনন্দিত। ভাবতেই অবাক লাগে আমার হাতের রঙের ছোঁয়া ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে। সত্যিই খুব ভালো লাগে। আমাদের দেশে যদি এসব কাজের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পায় তাহলে দেশে থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। 
বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরীর ন্যাচারাল ফাইবার প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, আমরা সাধারণতো নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে পণ্য তৈরি করতাম। অতি সম্প্রতি ইউরোপের কাস্টমার পেয়েছি, যারা পরিবেশবান্ধব পণ্য বাজারজাত করতে আগ্রহী। তারা কাঠের কিছু প্রোডাক্ট নিতে চায়, তাদের কাছ থেকে কাঠের ‘বেবি ব্যালেন্স সাইকেল’ অর্ডার পাই। আমরা এ পর্যন্ত ৪০ হাজার পিস এক্সপোর্ট করেছি।’ 
তিনি আরও বলেন, রপ্তানির জন্য আমাদেরকে সরকার ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিত। সম্প্রতি কমিয়ে দিয়েছে। ফলে মার্কেটে টিকে থাকা মুশকিল হচ্ছে। আমাদের প্রোডাক্টগুলো সরকারের খরচে প্রচার করতে হবে। সরকারের আন্তরিকতা থাকলে আমাদের প্রোডাক্ট মার্কেটে টিকে থাকবে। আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিশ্বমানের পণ্য তৈরি করে সরবরাহ করতে সক্ষম হব।’
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন বাগেরহাটের উপ-ব্যবস্থাপক মামুনুর রশীদ ও শিল্পনগরীর কর্মকর্তা শরীফ সরদার বলেন, বিসিক শিল্প নগরীতে মুস্তাফিজুর রহমান সব সময়ই ইউনিক আইডিয়ায় কাজ করেন। কাঠের সাইকেল তৈরি করে ইউরোপে রপ্তানি করেছেন। এখন ‘ট্যুরিস্ট কটেজ’ রপ্তানি করছেন। এসব পণ্য শতভাগ রপ্তানিযোগ্য। এর মাধ্যমে যে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে, তা নয়। স্থানীয়ভাবে অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সব সময় উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা করছি। এ ধরনের পণ্য বিদেশে গেলে আমাদের দেশের সুনাম বাড়ে। দেশীয় পণ্যের রপ্তানি করতে ইচ্ছুক উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সরকারী সহযোগিতা অব্যাহত আছে, থাকবে।’
নারকেলের মালায় তৈরি গহনা রপ্তানি

নারকেলের আচার দিয়ে বোতাম তৈরি থেকে শুরু। এর পর বাহারি রং-বেরঙের চুড়ি, কানের দুল, হার, কোমরের বিছা, হ্যান্ডব্যাগ, পার্টসব্যাগ, ওয়াল-ম্যাট, টেবিলসহ বিভিন্ন সো পিস ইত্যাদি। 
বাগেরহাটে নারকেলের আচার দিয়ে তৈরি গহনাসহ এসব পণ্য এশিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে। হাতে তৈরি এসব পণ্য বিশ্ব বাজার জয়ের পাশাপাশি কর্মস্থান হচ্ছে অনেক নারীর, যা থেকে অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। 

বাগেরহাটে পরিবেশবান্ধব কাঠের বসতবাড়ি
এ পণ্যের উদ্যোক্তা একজন নারী। তিনি বাগেরহাটের বিসিক শিল্প নগরীতে ২০১১ সালে ‘নুরজাহান এগ্রো প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড’ গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের পাশাপাশি  ‘কোকো সেল বাটন ইউনিট’ নামে একটি নারকেলের আচার দিয়ে শুরুতে বোতাম তৈরির কাজ শুরু করে। দেশ-বিদেশে চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকায় বোতামের পাশাপাশি নারকেলের আচার দিয়ে বিভিন্ন জুয়েলারি সাগ্রমীসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন শুরু হয়, যার মধ্যে জুয়েলারি পণ্যসামগ্রী চুড়ি, কানের দুল, হার, কোমরের বিছা, হ্যান্ডব্যাগ, পার্টসব্যাগ, বোতাম, ওয়াল-ম্যাট, টেবিলসহ বিভিন্ন সো-পিচ রয়েছে। এই কারখানার প্রায় সব শ্রমিক নারী। তারা নিজ হাতে তৈরি করেন এসব পণ্য। কোকো সেল বাটন ইউনিটে স্থানীয় দরিদ্র নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে মানসম্মত পণ্য তৈরি করায় যেমন সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান, তেমনি অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।
নারী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নারকেলের আচার দিয়ে তৈরি পণ্য এখন রপ্তানি হচ্ছে আমেরিকা, লন্ডন, কোরিয়ায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে একদিকে যেমন দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থান বাড়বে অন্যদিকে আয় হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। এদিকে এই পণ্য তৈরি করে খুশি নারী শ্রমিরা।  
বাগেরহাট কোকো সেল বাটন ইউনিট ইনচার্জ আনোয়ারা মনজু বলেন, নারিকেলের আচারের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। এই আচার দিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের দ্বারা নানা প্রকার গহনা তৈরি হচ্ছে। এতে একদিকে বেকার নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে  বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। এখানে তৈরি জুয়েলারি আমেরিকা, লন্ডন ও উত্তর কোরিয়ায় ব্যাপক চাহিদা আছে। বিদেশে বাজারজাত হচ্ছে। ভবিষাতে অন্যান্য দেশে আমরা বাজারজাত করার জন্য  চেষ্টা করছি।’
বাগেরহাট শিল্পনগরী কর্মকর্তারা জানান, নারিকেলের আচার এক সময় মানুষ ফেলে দিত। এখন এটা মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়েছে। তা এখন সংগ্রহ করে মহিলা উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ধরনের বুতাম, অলঙ্কার, ওয়ালমেট, পার্টসব্যাগ তৈরি  সুনাম অর্জন করেছে। এদের মতো যদি অন্য উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন, তাহলে এই শিল্প আরও বিস্তৃত হবে। এ জন্য সকল উদ্যাক্তাকে সম্ভব সর্বপ্রকার সহায়তা করা হচ্ছে।  
বাবুল সরদার, বাগেরহাট

প্যানেল

×