ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

১১ দিন না ঘুমিয়ে ছিল যে কিশোর, তার গল্পটা জানেন?

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২৪ মে ২০২৫

১১ দিন না ঘুমিয়ে ছিল যে কিশোর, তার গল্পটা জানেন?

ছবি: সংগৃহীত

 ডিসেম্বর ১৯৬৩। গোটা আমেরিকা তখন রাজনৈতিক টালমাটাল। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ডের রেশ তখনও কাটেনি, তারই মাঝে শুরু হয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে উত্তেজনা। এই অস্থির সময়েই ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো শহরে দুই কিশোর এমন কিছু করতে চায় যা দেখে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে বিস্ময়ে। তাদের বয়স মাত্র ১৬-১৭ বছর। সামনে বড়দিনের ছুটি, স্কুল বন্ধ—অলস সময়। হঠাৎ তারা ভাবলো, মানুষ টানা কতদিন না ঘুমিয়ে থাকতে পারে—সেই পরীক্ষা করবে।

কিশোর দুজনের নাম ব্রুস ম্যাকালিস্টার ও রান্ডি গার্ডনার। সিদ্ধান্ত হলো, রান্ডি জেগে থাকবে, আর ব্রুস তাকে পাহারা দেবে। কিন্তু ব্রুস তো মানুষ, ঘুম তো আসবেই। তাই তাদের এক বন্ধু জো মার্সিয়ানো এগিয়ে এল সহায়তায়। এই অদ্ভুত পরীক্ষা শুরু হলো।

প্রথম দুদিন রান্ডির তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কোকাকোলা খেয়ে, ঠান্ডা পানিতে স্নান করে, উচ্চ শব্দে গান শুনে নিজেকে জাগিয়ে রাখছিল সে। অনেকটা রাত জেগে পরীক্ষার প্রস্তুতির মতোই।

কিন্তু তৃতীয় দিন থেকেই শুরু হলো পরিবর্তন। ক্লান্তি চেপে বসতে লাগলো। রান্ডির ইন্দ্রিয়গুলো যেন একে একে বিদ্রোহ করছিল। সাধারণ শব্দ লাগত অসহ্য, কিছু গন্ধে মাথা ঘুরে যেত। স্থানীয় পত্রিকায় খবর ছাপা হলো। বিষয়টি নজরে আসে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুম-বিজ্ঞানী ড. উইলিয়াম ডিমেন্টের। ডিমেন্ট নিজেই এগিয়ে এলেন রান্ডির শরীর ও মন পর্যবেক্ষণের জন্য।

দিন পেরোতে থাকল, রান্ডির অবস্থা খারাপ হতে থাকল। পঞ্চম দিন থেকেই সে ভুলে যেতে শুরু করল সামান্য আগের কথাও। সহজ অঙ্ক করতে পারছিল না। ষষ্ঠ দিনে চোখে দেখা দিতে লাগল অবাস্তব সব দৃশ্য, হ্যালুসিনেশন—দেয়ালে অদ্ভুত সব প্যাটার্ন, জিনিসপত্রের আকৃতি বিকৃত। সপ্তম দিনে সে কলম ধরতেও পারছিল না, কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, রান্ডি হয়তো “মাইক্রোস্লিপস” নামক এক বিচিত্র অবস্থায়—চোখ খোলা, কিন্তু মস্তিষ্ক কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে যাচ্ছে।

রান্ডির মা-বাবা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন—এভাবে চললে কি ছেলেটি বেঁচে থাকবে? অবশেষে, টানা ২৬৪ ঘণ্টা বা ১১ দিন না ঘুমিয়ে কাটানোর পর, রান্ডিকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। সেখানে সে প্রথম দিনেই টানা ১৪ ঘণ্টা ঘুমায়, পরদিন ১০ ঘণ্টা।

পরে গবেষণায় দেখা যায়, রান্ডির জাগা অবস্থায়ও তার মস্তিষ্কের কিছু অংশ ঘুমিয়ে ছিল, আর কিছু অংশ কাজ করছিল। এটি ছিল মস্তিষ্কের এক ধরনের আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা—যা বিজ্ঞানীরা পরে "ক্যাটন্যাপ মডেল" নামে আখ্যা দেন।

যখন রান্ডিকে প্রশ্ন করা হলো—সে এতদিন কীভাবে জেগে থাকল, সে বলেছিল, “It’s just a mind over matter.” মানে, ‘শরীর নয়, মনই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।’

এই ঘটনার পর অনেকেই অনুরূপ চেষ্টা করলেও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস আর এ ধরনের রেকর্ডকে স্বীকৃতি দেয় না।

বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন—রান্ডি গার্ডনারের এই অদ্ভুত পরীক্ষা ঘুম সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিয়েছে। তারা বলেন, ঘুম শুধু বিশ্রাম নয়, এটি মস্তিষ্কের স্মৃতির শ্রেণিবিন্যাসে সাহায্য করে, নিউরোট্রান্সমিটার ভারসাম্য রক্ষা করে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ঘুমের ঘাটতিতে শেখার ক্ষমতা, চিন্তাশক্তি ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা কমে যায়।

আজও এই ঘটনা বিজ্ঞান জগতে এক বিস্ময়। কেউ বলেন এটি ছিল এক সাহসী মনোসম্মত পরীক্ষা, কেউ বলেন নিছক পাগলামি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—মাত্র ১৭ বছরের কিশোর রান্ডি গার্ডনার একবার ঘুমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে বুঝিয়ে দিয়েছিল, মানুষের কৌতূহল কতটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে।

এসএফ 

×