ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৭ মাঘ ১৪৩১

পেঁচারদ্বীপ সৈকতে চলছে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ 

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার

প্রকাশিত: ০১:০৪, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪

পেঁচারদ্বীপ সৈকতে চলছে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ 

ঝাউগাছ কেটে প্রাইভেট বিচ তৈরি করা হচ্ছে কক্সবাজারের রামুর পেঁচারদ্বীপে

পর্যটন স্পট কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ লাগোয়া রেজুখাল সংলগ্ন রামু পেঁচারদ্বীপ এলাকায় সরকারি ভূমিতে মারমেইড বিচ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণকাজ অব্যাহত রেখেছে। কিছুদিন আগে উপজেলা প্রশাসন কয়েকটি স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিলেও অজ্ঞাত কারণে বুধবার থেকে আবারও পুরোদমে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায় , ঝাউবীথি কেটে বালুচর দখল, সৈকত দ্বিখণ্ডিত করে নতুন কাঠের সেতু নির্মাণ এবং ফের বালুচরে থার্টি ফাস্ট নাইটের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন মারমেইড বিচ রিসোর্ট মালিক আনিসুল হক চৌধুরী ওরফে এলিয়েন সোহাগ। অনেকে বলাবলি করছে সরকার বদল হলেও মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন ঠিকই রয়ে গেছে। সরকারি খাস খতিয়ানের সাড়ে ৬ একর ভূমিতে এ ধরনের অবৈধ দখলদারিত্বের কাজ অব্যাহত রাখলেও জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগ রহস্যজনকভাবে নিরবতা পালন করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগ নামমাত্র দুটি মামলা করে অনেকটা নিশ্চুপ রয়েছে। বুধবার জেলা প্রশাসন সম্মেলনকক্ষে পরিবেশ রক্ষা ও ইসিএ এলাকায় স্থাপনা নির্মাণ বন্ধকল্পে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা কমিটির সভাপতি এইচএম এরশাদ সরকারি এই বিশাল সম্পদ দখল ও বিপুল পরিমাণ ঝাউ গাছ কাটার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গত ১৫-১৬ বছর ধরে এধরনে পরিবেশ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজ অব্যাহত রেখেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ। এ সময় বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদাসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 
থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন ডিজে ও মদের পার্টির বিশেষ জোন ॥ কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে মারমেইড বিচ রিসোর্টের বিরুদ্ধে সমুদ্র সৈকত দখলের অভিযোগ নতুন নয়। থার্টি ফাস্ট নাইট পালনে ডিজে ও মদের পার্টির জন্য বিশেষ জোন তৈরি করেছে ঝাউবীথির বাগানে। সেখানে ঝাউগাছ কাটা হয়েছে তিন শতাধিক। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফুল মুন বিচ পার্টি’। সমুদ্র সৈকত রক্ষায় কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের রোপণ করা শতশত ঝাউবীথি উপড়ে ফেলা হয়েছে। যার ফলে পরিবেশের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের একমাত্র মেরিনড্রাইভ সড়ক। এছাড়াও, অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ সরকারের সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইসিটি মন্ত্রী জুনায়েদ আহমদ পলক, শেখ পরিবারের এক নাতিসহ একাধিক মন্ত্রী-প্রভাবশালী নেতার প্রশ্রয়ে একের পর এক সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করেছেন মারমেইড রিসোর্টের মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগ। নিজেকে শেখ পরিবারের একজন দাবি করা সোহাগ একের পর এক দখল চালিয়ে গেলেও গেল ১৫-১৬ বছর অদৃশ্য কারণে প্রশাসনের কেউ সেদিকে নজর দেননি। জানা গেছে, ২০১০ সালের ২২ জুলাই কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রফিকুল ইসলাম অবৈধ দখলদার হিসেবে মারমেইড ক্যাফে নামক কটেজ রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করে ব্যবসা পরিচালনা করায় জমির অবৈধ দখল ছেড়ে দিতে ও অবৈধ স্থাপনা সরানোর জন্য নোটিস দেন। তিনি  (সোহাগ) পেঁচারদ্বীপ মৌজার বিএস ১ নম্বর খাস খতিয়ানের বিএস ১২১৪ দাগের ৫.৩০ একর জমিতে এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেন। এর আগে রামুর সহকারী কমিশনার (ভূমি) ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাকে দুই দফা নোটিস দিলেও তার কোনো কারণ দর্শানোর জবাব না দিয়ে অবৈধ দখলের মাধ্যমে ব্যবসা চালু রাখেন। তবে প্রশাসনের ইচ্ছে থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপের মুখে তাকে উচ্ছেদ করা যায়নি। এভাবে ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রশাসনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বহমান খালের ওপর অবৈধ একটি সেতু নির্মাণ করেছে। যে সেতুর ওপর দিয়ে যেতে হবে সেই বিশেষ ডিজে ও মদের জোনে। পর্যটনের দোহাই দিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকা- চললেও সবাই অদৃশ্য কারণে চুপ ছিল।
সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে কিছু দিনের জন্য গা ঢাকা দেয় এই মারমেইড সোহাগ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ওইসব জমি উদ্ধারে উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো. সালাহ উদ্দিনের নির্দেশে ২১ নভেম্বর দিনব্যাপী অভিযান চালিয়ে প্রায় ৬ একর সরকারি জমি দখলমুক্ত করা হয়। রামু উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাজ্জাদ জাহিদ রাতুলের নেতৃত্বে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হয়। সৈকত দ্বিখণ্ডিত করে নির্মিত কাঠের সেতু  ভেঙে দেওয়া হয়। অভিযানে বালুচরে গড়ে তোলা অন্তত ৩০টি অবৈধ কটেজ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সৈকতে ঝাউবীথি কেটে স্থাপনা নির্মাণের ঘটনায় বনবিভাগ বাদী হয়ে মারমেইড বিচ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা দায়ের করেছে। এ ছাড়া পরিবেশের ক্ষতি করায় পরিবেশ অধিদপ্তরও একটি মামলা দায়ের করেছে।
ভেঙে দেওয়া কাঠের সেতু পূনঃস্থাপন ॥ সরেজমিন ‘মারমেইড বিচ রিসোর্টে দেখা যায়, উচ্ছেদ অভিযানে ভেঙে দেওয়া কাঠের সেতুর পাশে নতুন করে আরেকটি কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যটক বা স্থানীয়রা নির্মিত সেতু দিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। নতুন নির্মিত সেতু পেরিয়ে দেখা গেছে, আবারও শত শত ঝাউবিথী কেটে তৈরি করা হয়েছে নাচ-গানের মঞ্চ, ‘কফি সপ’ বা ‘মদের বার’ সাদৃশ্য বিশেষ জোন। সৈকতে ঝাউবিথী কেটে নতুন ভাবে অবকাঠামো তৈরি করেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট। মারমেইড বীচ রিসোর্টের কয়েকজন কর্মচারী জানিয়েছেন, সৈকত দখল করে গড়ে তোলা ঝাউবিথীর ভিতর থার্টি ফাস্ট নাইটের অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রস্তুতি চলছে। জনপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ টাকা হারে টিকিটও বিক্রি করা হচ্ছে। আর প্রতি মাসে একটি বিশেষ ‘ডিজে পার্টি’ হয় সেখানে। সাড়ে তিন হাজার টাকায় জনপ্রতি ফি’ নেওয়া হয়। টিকিটধারীই শুধু সেখানে যেতে পারে। 
‘বিশেষ ডিজে’ পার্টিতে ‘কি কি থাকে বা খাবার কি থাকে’ জানতে চাইলে কর্মচারীরা বলেন, তেমন কিছু না, শুধু বিদেশী বিয়ার ও মদ থাকে আর নারীদের দিয়ে নাচ-গান। রামু ভুমি অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, মূলত মারমেইড বিচ রিসোর্টটি পড়েছে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নে। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উন্মুক্ত প্রবাহমান খালের উপর মারমেইড বিচ কর্তৃপক্ষ দুটি সেতু নির্মাণ করে। 
মারমেইডে অধিকাংশই খাসজমি ও সৈকতের বেলাভূমি ॥ গত ২৮ নভেম্বর রামু ধেছুয়াপালং ইউনিয়ন ভূমি অফিস জেলা প্রশাসক বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, মারমেইড বিচ রিসোর্টের বিশাল এলাকার অধিকাংশই খাসজমি ও সৈকতের বেলাভূমি। অল্প কিছু জমি কিনে পাশের খাস জমি ও সৈকতের বালিয়াড়ি জমির মধ্যেই গড়ে উঠেছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট। তিনটি দাগের ৬ একর ৭০ শতক সরকারি জমি দখল, চরভরাট ও শ্রেণি পরিবর্তন করে ৭৮ লাখ ২৫ হাজার টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। মারমেইড বিচ রিসোর্টের মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগের মুঠোফােনে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তার জবাব দেননি তিনি। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, সরকারি জমি হোক আর ব্যক্তিগত জমি, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ নেই।

×