ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ  মোকাবিলা

মো. মাঈনউদ্দিন

প্রকাশিত: ০১:২১, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ  মোকাবিলা

.

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা বলতে গেলে উঠে আসে মূল্য, ডলার সংকট, হুন্ডি, বৈদেশিক মুদ্রার  রিজার্ভ কমে যাওয়া, আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও বৈষম্য প্রসঙ্গ। সংবাদপত্র ও টিভির টকশোতেও এসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত আড্ডা দেখা যায়। সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অবস্থা। এছাড়াও অর্থনীতিতে রয়েছে নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা, ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা আনা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করা,  রেমিটেন্স বৃদ্ধি, রপ্তানি বাজার ঠিক রাখা, অর্থপাচার, সিন্ডিকেট দমন, ব্যাংক খাতের সংস্কার ও জ্বালানি তেলের সরবরাহ ঠিক রাখা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান পাঁচটি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়। এখানে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে জ্বালানি স্বল্পতা কে চিহ্নিত করা হয়েছে।  অন্য ঝুকি গুলো হল  উচ্চমূল্য, প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া, সম্পদ ও আয় বৈষম্য, সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও বেকারত্ব। শিল্প খাতের বড় সমস্যা হলো চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না থাকা।  ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছে না । একই সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে।

শিল্পের সম্প্রসারণ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে, তার মানে বেকারত্ব বাড়বে। অর্থনীতিতে ক্রমাগতভাবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী প্রভাবে নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্তসহ সকলেই কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তাছাড়া মূল্যস্ফীতির রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। প্রত্যক্ষ প্রভাবের মধ্যে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির দাবি ও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া উল্লেখযোগ্য। পরোক্ষ প্রভাব হলো উচ্চমূল্যস্ফীতি।  উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে লেনদেন এর ভারসাম্য থাকে না। ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র এল সি খুলতেও সমস্যা হয়। রপ্তানিকারকদের রপ্তানিতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়। গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে অর্থনীতিতে বড় সমস্যা হলো বৈষম্য ও দুর্নীতি। গিনি সহগের মাত্রা থেকে জানা যায় দেশের বৈষম্য এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আঞ্চলিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়ে চলেছে। অর্থনীতিতে সম্পদ ও আয় উভয়ের মধ্যে বৈষম্য অন্যতম ঝুঁকির কারণ। সিপিডির গবেষণা দেখা যায়, উচ্চ আয় বৈষম্য থাকলে নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা তেমন একটা বাড়ে না। সমাজে ধনী মানুষের হাতে সম্পদ ও অর্থ থাকলেও তারা বিদেশে ব্যয় করেন। মধ্যম শ্রেণির  ভোক্তারা হলো সমাজের ভিত্তি। তাদের আয় না বাড়লে অর্থনৈতিক  গতি কমে যায়। এতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়। একসময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নানা প্রতিক‚লতা দেখা দেয়। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সংকট। এতে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পখাতে  উৎপাদন  হ্রাস পাওয়ায় বেড়েছে সব পণ্যের দাম।  শতভাগ মার্জিনে অনেকেই এলসি করলেও ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে দেনা শোধ করতে হচ্ছে। রপ্তানি ও রেমিটেন্স কাক্সিক্ষত হারে না আসায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ দিন দিন বাড়ছে।

একই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়িয়ে অর্থছাড় বাড়ানো না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। অর্থনীতি সম্পর্ক বিভাগ ইআরডি সূত্র থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকারকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৫৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। যা প্রায় ১৭ হাজার ২৪০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

গত অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ হয়েছিল ১০৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। তুলনামূলক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৫১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। বিশ^ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ডক্টর জাহিদ হোসেনের মতে জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত যে হারে অর্থছাড় হয়েছে, পরিশোধ বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে। প্রকল্পের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অবচয় রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ইআরডির হিসাব থেকে দেখা যায়, আগামীতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। ২০২৬ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে। পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয় ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল। এই ঋণের পাঁচ বছরের রেয়াত শেষ হয়েছে গত এপ্রিল ২০২৩ এ। ফলে চলতি অর্থবছর (২০২৩-২৪) এই ঋণের আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ২০২৬ সালের পর মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে।  ঋণ পরিশোধের চাপ সামলানোর সক্ষমতা বাংলাদেশকে অর্জন করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, করোনার পর অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধার হচ্ছিল তখন আমদানি বেড়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি খোলা হয়েছিল ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছিল ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ অথচ বর্তমানে আমদানি কমার কারণে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামালের সংকটে  উৎপাদন কমেছে। অর্থবছর ২০২৩-২৪ এর জুলাই-ডিসেম্বরে এলসি খোলা কমেছে ১ শতাংশ। আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশ।

বিনিয়োগ কমে ঋণ প্রবাহও কমেছে। বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দশ দশমিক ২ শতাংশ। বেড়েছে মাত্র তিন দশমিক ৫০ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮ শত ৬ কোটি ডলার উঠেছিল। আমদানি চাপে রিজার্ভ কমতে থাকে। ডলারের দাম ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও টাকার মান কমছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশে ঠেকেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ শতাংশে উঠেছিল। চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়ে চলেছে। জনগণ এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়। তাই মূল্যকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বাজার নজরদারিতেও প্রযুক্তি সহায়তা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি আমাদের রাজনীতিবিদদের সততার চর্চা বাড়াতে হবে এবং সরকারি আমলা নির্ভরতা কমানো দরকার। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে নিতে হবে যথাযথ উদ্যোগ ।

×