জাতীয় জাদুঘরে নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নানা নিদর্শন নিয়ে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী
পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নানা উপাদান। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ইউনেস্কো এসব উপাদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। ঐতিহ্য সংরক্ষণে উৎসাহিতও করে তারা। কাজটি প্রথম শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে। ওই বছরের ১৮ মে বিভিন্ন দেশের ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ‘মাস্টারপিস অব দ্য ওরাল অ্যান্ড ইনটেনজিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর পর ২০০৩ সালের ৭ নভেম্বর দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে স্থান পায় ২৮টি ঐতিহ্য। ২০০৫ সালের ২৫ নভেম্বর তৃতীয় তালিকায় নাম আসে আরও ৪৩টি ঐতিহ্যের।
এভাবে তিন পর্বে মোট ৯০টি ঐতিহ্যের নাম প্রকাশ করা হয়। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ইউনেস্কো পৃথিবীর নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে লক্ষ্যে ২০০৩ সালের ১৭ অক্টোবর নির্বস্তুক ঐতিহ্য রক্ষার্থে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশসহ ১৭৮টি রাষ্ট্র এ কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। ২০০৬ সালের ২০ এপ্রিল থেকে এটি কার্যকর রয়েছে।
জানা যায়, স্বাক্ষর করা সকল দেশ প্রতি বছর নিজেদের যে কোনো একটি উপাদানের স্বীকৃতি চেয়ে ইউনেস্কোতে আবেদন করতে পারে। স্বাক্ষরকৃত দেশগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপাদান যাচাই-বাছাই ও সুনির্দিষ্ট করে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরে ইউনেস্কো। সংরক্ষণের জন্য সংস্থার পক্ষ থেকে অর্থ প্রদান করা হয় বলেও জানা যায়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশও নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ২০০৯ সালে বাঙালির শিকড়ের সংস্কৃতি বাউল গান ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করে। ২০১৩ সালে ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ লিস্ট অব দ্য ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র অন্তর্ভুক্ত হয় জামদানি বুনন শিল্প। মঙ্গল শোভাযাত্রার কথা আলাদা করে বলতে হয়। পহেলা বৈশাখের এই আয়োজন ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করে ২০১৬ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ নয় শুধু, এমন প্রাপ্তিতে দারুণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে গোটা দেশ। পরের বছর ২০১৭ সালে শীতল পাটি বুনন শিল্প ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। এর পর থেকে অনেকেই আশা করছিলেন আরও নাম এ তালিকায় জায়গা করে নেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি আর হয়নি।
কেন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, গত কয়েক বছর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শর্ত পূরণ না করে ত্রুটিপূর্ণ আবেদন ফাইল পাঠানো হয়েছে ইউনেস্কোতে। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ন্যাশনাল ইনভেন্টরির অভাব। আবেদনকারী দেশের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি সরকারি তালিকা থাকতে হয়। সে তালিকায় নাম থাকলেই কেবল সেটির স্বীকৃতির চাওয়া যায়। কিন্তু সরকারিভাবে প্রস্তুত করা কোনো ইনভেন্টরি বা তালিকা বাংলাদেশের ছিল না। সহসাই ইনভেন্টরি করা হবেÑ ইউনেস্কোর ইন্টারগভর্মেন্টাল কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হয়ে এমন আশ্বাস দিয়ে আসছিলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। এভাবে তারা সফলও হয়েছেন কয়েকবার। তবে ২০১৭ সালের পর ইনভেন্টরি বিষয়ে কী অগ্রগতি হলো তা আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে পরিষ্কার করতে পারেননি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জানা যায়, মূলত এ কারণে আর কোনো স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি।
অগত্যা কয়েক বছর আগে ইনভেন্টরি প্রস্তুত করার কাজটিকে মোটামুটি গুরুত্বের সঙ্গে নেয় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আগে না বুঝে দায়সরা এবং অগোছালোভাবে করলেও, সাম্প্রতিককালে এ কাজে গতি আসে। সর্বশেষ, শনিবার জাতীয় জাদুঘরে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দেশের ১০৯ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নাম সংবলিত ইনভেন্টরি প্রকাশ করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। তিনি বলেন, নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও বাংলাদেশ অনেক সমৃদ্ধ। প্রাথমিক একটি তালিকা দিয়ে ইনভেন্টরির কাজ শুরু হলো। এটি আরও দীর্ঘ হবে। যথাযথভাবে তালিকা তৈরি এবং ডকুমেন্টেশনের কাজ করা গেলে ইউনেস্কো থেকে আর বিফল হয়ে ফিরতে হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জানা যায়, ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ঐতিহ্য সংরক্ষণে মন্ত্রণালয়কে অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে। এই অর্থ মন্ত্রণালয় কতটা কাজে লাগিয়েছে? এমন প্রশ্ন সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে করা হলেও কোনো উত্তর দেননি প্রতিমন্ত্রী।
ইনভেন্টরি তৈরির কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান জানান, একটি ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ১০৯টি নির্বস্তুক ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে মোবাইল অ্যাপের সংযোগ স্থাপন করে জাতীয় ইনভেন্টরি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসের অফিসার ইনচার্জ মিজ সুজান ভাইজ। তিনি অবশ্য ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। বলেন, ইউনেস্কো বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশেরও এদিকে নজর দিতে হবে।
ইনভেন্টরি প্রস্তুত করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে নৃত্য সংগঠন সাধনা ও এর কর্ণধার বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী লুবনা মারিয়ম। দেশের প্রয়োজনে নিঃস্বার্থভাবে এ কাজে সহযোগিতা করছেন বলে জানান তিনি। এদিকে, একই দিন জাদুঘরে উদ্বোধন করা হয় দুই বাংলার কারুকলা উৎসবের। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা উৎসবে যোগ দিয়েছেন। জাদুঘরের বড় মিলনায়তনের লবিতে চলছে লোক ও কারুশিল্পের প্রদর্শনী। আর ভেতরে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। প্রদর্শনী এবং পরিবেশনার মাধ্যমে নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আয়োজক জাতীয় জাদুঘরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আসমা ফেরদৌসী। পশ্চিমবঙ্গের অংশগ্রহণকারীদের পক্ষে ড. মাধুরা দত্ত সবাইকে উৎসব উপভোগের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চারদিনের উৎসব চলবে মঙ্গলবার পর্যন্ত।