ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

চলছে উৎসব প্রস্তুতি

যুদ্ধজয়ের স্মৃতি জাগানিয়া ডিসেম্বর, ক্রমে পাচ্ছে বর্ণিল রূপ

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ৩ ডিসেম্বর ২০২২

যুদ্ধজয়ের স্মৃতি জাগানিয়া ডিসেম্বর, ক্রমে পাচ্ছে বর্ণিল রূপ

বিজয় দিবস সামনে রেখে শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি

যুদ্ধজয়ের নানা স্মৃতি এখন নতুন করে জেগে উঠছে। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ বেয়ে একাত্তরে প্রবেশ করেছিল বাঙালি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ নয় মাস অসীম সাহসের সঙ্গে লড়েছিলেন। তাদের হাত ধরেই এসেছিল চূড়ান্ত বিজয়। আর এ বিজয়ের ইতিহাসটি ধারণ করে আছে ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পরাস্ত করে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করেছিল বাঙালি। তখন থেকেই ১৬ ডিসেম্বর আলাদা গুরুত্বের। বর্তমানে এসে বিজয় দিবসে নয় শুধু, গোটা মাস ঘিরেই নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এবারও মাসের প্রথম দিন থেকে অপার আনন্দ মহা অর্জনের স্মৃতি নানা ভাব ও ভাষায় তুলে ধরা হচ্ছে। চলছে উদ্যাপনের জোর প্রস্তুতি।
সেই ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। নতুন ভৌগোলিক পরিচয় বাঙালিকে আশাবাদীও করেছিল বটে। অচিরেই আসল চেহারা নিয়ে সামনে আসে বর্বর পাকিস্তানিরা। এক বছরের মধ্যে ১৯৪৮ সালে মায়ের ভাষা বাংলার ওপর আঘাত হানে তারা। ভাষার অধিকার রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে হয় বাঙালিকে। একই সময় পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একের পর এক বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করতে থাকে পশ্চিমারা।

বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টা চলে। বাঙালিও শুরু থেকে বেছে নেয় সংগ্রামের পথ। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭১। যেটুকু দেখানোর বাকি ছিল সেটুকুও মার্চে দেখিয়ে দেয়  পাকিস্তানিরা। জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা প্রকাশ করে। এরই প্রেক্ষিতে আসে ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং অতঃপর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গোটা জাতির চাওয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তিনি। বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ডিসেম্বরে দ্রুতই বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঘন ঘন নাস্তানাবুদ করতে থাকে পাকিস্তানিদের। গেরিলা আক্রমণের পাশাপাশি সম্মুখ সমরে বড় বড় সাফল্য পেতে থাকেন। একের পর এক যুদ্ধজয়ের খবর প্রচারিত হতে থাকে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে। আর মিত্রশক্তি ভারত সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে নামলে  হানাদাররা পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান আর্মি। ওইদিনই ঢাকার রাস্তায়, বাড়ির ছাদে, অলিতে গলিতে যে যার মতো করে বিজয় উদ্যাপন করেন। গোটা দেশ সেদিন আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল।
বর্তমানে বিভিন্ন আলোচনার টেবিলে, উৎসব মঞ্চে বিজয়ের ইতিহাস বর্ণিত হচ্ছে। চলছে বিজয় দিবস উদ্যাপনের প্রস্তুতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও নিচ্ছে উৎসব প্রস্তুতি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিবারই বিশেষ বিজয় উৎসবের আয়োজন করে। সে ধারাবাহিকতায় আগামী ৯ ডিসেম্বর থেকে এবারের উৎসব শুরু করবে তারা। চলবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

জাদুঘরের পক্ষে কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে ডিসেম্বরে শত্রুমুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস হয়ে আছে।  দিবসটি তাই গুরুত্ব দিয়ে উদ্যাপন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রতিদিনের অনুষ্ঠানমালায় থাকবে স্বাধীন বাংলা বেতারের গান, গণসংগীত, নৃত্যায়োজন, কথা ও কবিতা। বিচিত্র পরিবেশনার মাধ্যমে একাত্তরে বাঙালির লড়াই, আত্মত্যাগ ও অর্জনের ইতিহাস তুলে ধরা হবে। এরই মাঝে আয়োজনের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলেও জানান তিনি।   
সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটও বর্ণাঢ্য বিজয় উৎসবের আয়োজন করবে। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্যাপিত হবে উৎসব। প্রথম দিন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে উৎসব উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। জোটের পক্ষে আহাম্মদ গিয়াস জানান, চার দিনের আয়োজন পরে ছড়িয়ে যাবে ঢাকার অন্যান্য প্রান্তে। রায়ের বাজার, মিরপুর, উত্তরা, ধনিয়া, পুরান ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় উৎসব উদ্যাপন করা হবে। এরই মাঝে শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি।
শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও বিভিন্ন প্রদর্শনী ও উৎসব অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর ঘিরে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে টিএসসি কেন্দ্রিক সংগঠনগুলোও। প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও  প্রস্তুতি চলছে।
এসবের বাইরে এখানে ওখানে উড়তে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। হ্যাঁ, বিশ্বকাপ ফুটবল চলায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে উন্মাদনার শেষ নেই। তবে নিজ দেশের পতাকা আলাদা মর্যাদার সঙ্গেই তুলে ধরা হচ্ছে। বিক্রেতারাও সবার ওপরে বাংলাদেশের পতাকা ঝুলিয়ে নিয়ে পথ হাঁটছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগানিয়া বিভিন্ন স্যুভেনির  বিক্রি হচ্ছে। টিশার্টে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে রণাঙ্গনের ইতিহাস। শীতে শালে, উত্তরীয়তে উঠে এসেছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। যার নামে মুক্তিযুদ্ধ সেই মহান নেতা শেখ মুজিব দৃশ্যমান হচ্ছেন বিচিত্র শিল্পভাষায়। এখন শুধু বর্ণিল উদ্যাপনের অপেক্ষা।

×