ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্নিগ্ধতার প্রতিচ্ছবি এঁকে রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২:২২, ২৫ নভেম্বর ২০২২

স্নিগ্ধতার প্রতিচ্ছবি এঁকে রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসবে সমবেত সংগীত পরিবেশনা

 বাঙালির মননে রয়েছেন তিনি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে। সুখ-দুঃখ থেকে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কিংবা বিপন্ন সময়ে প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে তার সৃষ্টির নির্যাস। বাঙালির সেই মনের মানুষ রবীন্দ্রনাথের সুরকে সঙ্গী করে কেটে গেল শ্রোতার সুন্দরতম সময়। সুরের আশ্রয়ে উচ্চারিত হয়েছে শান্তি ও সম্প্রীতির বারতা। দিনভর বিশ্বকবির সৃষ্টি স্নাত সেই সংগীতাসরটি অনুষ্ঠিত হলো সেগুন বাগিচার আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে।  ‘এই জীবনের ব্যথা যত এইখানে সব হবে গত’ স্লোগানে শুক্রবার ত্রয়োত্রিংশ জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসবের সূচনা হয়। সংস্কৃতির লড়াইকে বেগবান করার প্রত্যয়ে দুই দিনব্যাপী এই সংগীতাসরের আয়োজক বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা।

শুক্রবার সকালে উৎসবের উদ্বোধন হয়। সকাল থেকে দুপুর এবং বিকেল থেকে রাত অবধি রবীন্দ্র সুরের অনুরণনে প্লাবিত হয়েছে উৎসব আঙিনা।  কবিগুরুর প্রেম, পূজা, প্রকৃতিসহ নানা পর্যায়ের গানের পরিবেশনা রাঙিয়েছে সুররসিকদের  অন্তর। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী প্রদান করা হয় গুণীজন সম্মাননা। এই সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন স্বাধীন বাংলা  বেতার  কেন্দ্রের দুই কণ্ঠযোদ্ধা বাচিকশিল্পী আশরাফুল আলম ও সংগীতশিল্পী রফিকুল আলম। তাদের হাতে সম্মাননা স্মারক ও অর্থমূল্য তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ।
সম্মাননাপ্রাপ্তির অনুভূতি  প্রকাশে বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী আশরাফুল আলম বলেন, জগতের বিপুল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। আমি আজ তারই নামাঙ্কিত সম্মাননা পেলাম। রবীন্দ্রনাথের নামটি মিশে থাকায় এই প্রাপ্তি আমার কাছে অত্যন্ত সম্মানের।
অনুভূতি প্রকাশে রফিকুল আলম বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত এ সম্মাননা আমার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রাপ্তির মাধ্যমে আমার জীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো।  
সংস্থার সভাপতি তপন মাহমুদ বলেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দুই শব্দসৈনিককে সম্মাননা দিতে পেরে আমরা গর্বিত। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পীযূষ বড়ুয়া। সংবর্ধিত দুই গুণীর শংসাবচন পাঠ করেন সাগরিকা জামালী ও সীমা সরকার।
উদ্বোধনী অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে ছিল আমন্ত্রিত পাঁচটি দলের সমবেত পরিবেশনা। অংশ নেয় সংগীতভবন, উত্তরায়ণ, সুরতীর্থ, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা) ও বিশ্ববীণা। এই পর্বের শুরুতেই মঞ্চে আসেন সংগীতভবনের শিল্পীরা। অনেকগুলো কণ্ঠ মিলে যায় এক সুরে।  সম্মেলক কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- লহো লহো তুলে লহো নীরব বীণাখানি...। পরিবেশনায় হেমন্ত ঋতুর প্রতি ভালোলাগার অনুভবে সকলে গেয়ে শোনায়Ñ হেমন্তে কোন বসন্তেরই বাণী  পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি...। এরপর মঞ্চে আসে উত্তরায়ণের শিল্পীরা।  পরিবেশিত হয় ‘সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি, ভ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে’ ও  ‘প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে/ভয়-ভাবনার বাধা টুটেছে’ শীর্ষক সংগীত। সুরতীথের্র শিল্পীরা গেয়েছেন ‘কবে আমি বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে’ ও  ‘কান্নাহাসির- দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা।’ বুলবুল ললিতকলা একাডেমির (বাফা)  শিল্পীরা শুনিয়েছেন ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’ এবং ‘এখন আর  দেরি নয়।’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশন শেষ হয় বিশ্ববীণার শিল্পীদের গানের সুরে। পরিবেশিত ‘হায়  হেমন্তলক্ষ্মী,  তোমার নয়ন কেন ঢাকা... ’ এবং ‘একি মায়া, লুকাও কায়া/জীর্ণ শীতের সাজে।’
সংবর্ধিত কণ্ঠশিল্পী রফিকুল আলম গেয়ে শোনান ‘উত্তর বায় জানায় শাসন/পাতলো তপের শুষ্ক আসন’ ও ‘ওই জানালার কাছে বসে আছে/করতলে রাখি মাথা...’ শীর্ষক রবীন্দ্রসংগীত। তার আগে আরেক সংবর্ধিত শিল্পী আশরাফুল আলম ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’-এর কয়েকটি চরণ আবৃত্তি করেন।
অগ্রহায়ণের স্নিগ্ধ সকালে মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। উৎসবের সূচনা হয় জাতীয় সংগীতের সুরে। এরপর সংস্থা শিল্পীরা দুটি কোরাস পরিবেশন করেন। গেয়ে শোনায় ‘ও আমার দেশের মাটি  তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ এবং ‘তোমার  সুরের ধারা ঝরে  যেথায় তারি পারে।’
মাঝে বিরতি দিয়ে বিকেলে শুরু হয় প্রথম দিনের দ্বিতীয় অধিবেশন। একক কণ্ঠের পরিবেশনায় সজ্জিত এ পর্বে অংশ নেন প্রায় অর্ধশতাধিক শিল্পী।  পরিবেশনায় অংশ নেন খন্দকার খায়রুজ্জামান কাইয়ুম, বুলা মাহমুদ, তানজিমা তমা, অনিকেত আচার্য, সাগরিকা জামালী, বিষ্ণু ম-ল, কনক খান, সীমা সরকার আবদুর রশীদ, রিফাত জামাল মিতু, খোকন দাস, আজিজুর রহমান তুহিন, শর্মিলা চক্রবর্তী আহমেদ শাকিল হাশমী, সাজ্জাদ হোসেন, জাফর আহমেদ, রাবিতা সাবাহ, ছন্দা রায়, নির্ঝর  চৌধুরীসহ আরও অনেকে।
আজ শনিবার উৎসবের  দ্বিতীয় দিন একই মঞ্চে  বিকেল ৫টা থেকে হবে শুরু আবৃত্তি ও সংগীতানুষ্ঠান। এবারের উৎসবের সারা দেশ থেকে প্রায় ২০০ জন শিল্পী একক ও দলীয় পরিবেশনায় অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছেন বুলবুল ইসলাম, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, রোকাইয়া হাসিনা, অদিতি মহসিন, ড. অরূপ রতন চৌধুরী, চঞ্চল খান, লিলি ইসলামসহ বেশ কয়েক প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী।  দুই দিনের অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশনায় অংশ নিচ্ছেন বাকশিল্পী আশরাফুল আলম, জয়ন্ত রায়, বেলায়েত হোসেন. মাহমুদা আখতার ও রেজিওয়ালী লীনা।
৩৩তম উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে করোনাকালে প্রাণ হারানো শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতজনদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।
রাধারমণ লোকসংগীত উৎসব শুরু ॥  শুক্রবার থেকে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে শুরু হলো রাধারমণ লোকসংগীত উৎসব। রাধারমণ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র আয়োজিত তিন দিনের এ উৎসবে অংশ নিচ্ছেন দেশের নানা প্রান্তের লোকসংগীত শিল্পীরা। হাওড়বেষ্টিত অঞ্চলের লোকগান দিয়ে সাজানো হয়েছে এই উৎসব। রবিবার পর্যন্ত চলমান উৎসবে  প্রতিদিন বিকেল সাড়ে চারটা থেকে রাত সাড়ে আটটা অবধি বইবে লোকজ সুরের ¯্রােতধারা।
শুক্রবার বিকেলে উৎসব উদ্বোধন করেন সুনামগঞ্জের প্রবীণ কীর্তনীয়া যশোদা রানী সূত্রধর। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা ও নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। আলোচনায় অংশ নেন লোকংগীত গবেষক সুমন কুমার দাশ। সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্রের সভাপতি মাহমুদ সেলিমের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়।
এবারের উৎসবে  সিলেট বিভাগের চার  জেলা ছাড়া হাওড়বিধৌত ময়মনসিংহ,  নেত্রকোনা অঞ্চলের শতাধিক লোকসংগীত শিল্পী অংশ নিচ্ছেন। রাধারমণের গান ছাড়াও পরিবেশিত  উৎসবে যুক্ত হয়েছে মরমি লোককবিদের গান। সেই সুবাদে হাসন রাজা থেকে শুরু করে বিজয় সরকার, সৈয়দ শাহনূর, হাসন রাজা, আরকুম শাহ, উকিল মুন্সি, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, ফকির দীন হীন, কফিল উদ্দীন সরকার  প্রমুখের গানে সাজানো হয়েছে এই সংগীতাসর।  পরিবেশনায় অংশ নিচ্ছেন  লোকসংগীতের খ্যাতিমান থেকে প্রান্তিক শিল্পীবৃন্দ।  
প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে দলীয় সংগীত পরিবেশন করে রাধারমণ চর্চাকারী দল, সৃজনশীল গানের দল নিবেদন। একক কণ্ঠে গান শোনান অনিমা মুক্তি গোমেজ, আবু বকর সিদ্দিক, তুলিকা ঘোষ চৌধুরী, শুভ বণিক, লাভলী দেব, শাহনাজ বেলী, বাউল হারুন, খায়রুল ওয়াসি, অনামিকা চন্দ কেয়া, মিতালী রায়, পুষ্পিতা  সোম, মাধুরী তালুকদার, অনুপম দাস, অর্পিতা দাস, কৃষ্টি রায়, জয়ীতা ঘোষ, প্রাচ্য প্রত্যয়, সুমন মুন্না, সংগীতা দাস, সম্পা পাল চৌধুরী, এনামুল হক, নন্দিনী রায়, শিমুল নন্দী, অম্লান ঘোষ, ঈশিতা বড়ুয়া, শুভ্রা জোয়ার্দার, শাহীনা আক্তার পাপিয়া, সৃজ্যোতি রায়, অন্বেষা দাস, মাকসুদুর রহমান দিপু, মনিকা দাস ও পংকজ রায়। প্রথম দিনে রাধারমণের গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দন ও সুনামগঞ্জের নিপা সূত্রধর ও তার দল।
আজ শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনে বিকেল সাড়ে চারটা থেকে শুরু হবে পরিবেশনা।

 

×