ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রায়হান আহমেদ তপাদার

বৃটেনে বাংলাদেশীদের এগিয়ে চলা

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৩ মার্চ ২০১৬

বৃটেনে বাংলাদেশীদের এগিয়ে চলা

নানা দেশের বহু বর্ণের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে একত্রে বাস করে আসছে ব্রিটেনে। স্বাভাবিকভাবেই এরা রাজনৈতিক মতাদর্শে ভিন্নমত ও পথের সমর্থক। ব্রিটেনে বাংলাদেশী কমিউনিটির অবস্থান এখন অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক শক্ত এক ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানকার ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের এক বৃহৎ অংশ ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আইন ও বিচার ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও সমাজনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটিশ মূলধারার রাজনীতিতে বাঙালীদের অভিষিক্ত হওয়াই এর প্রমাণ। এদিকে ২০১৫ সালের ব্রিটেনের পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সে এমপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ৬ ব্রিটিশ নাগরিক। ব্রিটেনের রাজনীতিতে অতীতেও মেধার স্বাক্ষর রাখা এই ৬ জন হলেন- রুশনারা আলী, টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, রূপা আশা হক, আনোয়ার বাবুল মিয়া, মিনা সাবেরা রহমান ও প্রিন্স সাদিক চৌধুরী। রুশনারা আলী ১৯৭৫ সালে সিলেট জেলার বিশ্বনাথে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে লন্ডনে অভিবাসিত হন তিনি। টাওয়ার হ্যামলেটে বেড়ে ওঠা রুশনারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জনস কলেজে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তারপর ক্রমে জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশ রাজনীতিতে। উল্লেখ্য, লেবার পার্টির রুশনারা আলী হলেন এখন পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সংসদ সদস্য। ২০১৫ সালের সংসদ নির্বাচনে বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে বিজয়ী হয়ে ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে জায়গা করে নিয়েছেন আর দুইজন বাংলাদেশী কৃতী কন্যা সন্তান। তারা হলেন টিউলিপ সিদ্দিক এবং রূপা আশা হক। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০১০ সালে রুশনারা আলী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ১১,৫৭৪ ভোট বেশি পেয়ে। সে সময় ব্রিটেনে মুসলিম এমপিদের মধ্যেও অন্যতম হিসেবে দৃষ্টি কারেন তিনি। বর্তমানে বেশ সুনামের সঙ্গেই তিনি কাজ করে চলেছেন। কিছুদিন আগেই শ্যাডো মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলেন। যুক্তরাজ্যে প্রথমবারের মতো ভোটে অংশ নেয়া তরুণদের জন্য ‘মাই ভয়েস, মাই ভোট’ প্রচারাভিযান শুরু করেছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বেথনাল গ্রীন এ্যান্ড বো এমপি রুশনারা আলী। তরুণদের সামাজিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ বাড়ানো ও গণতান্ত্রিক কর্মকা-ে সক্রিয় করতেই তার এই প্রচারণা। টিউলিপ সিদ্দিক। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি, শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের লেবার পার্টিতে যোগ দেন তিনি। লন্ডনে জন্মগ্রহণ করলেও টিউলিপের ছোটবেলাটা কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও স্পেনে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এবং কিংস কলেজ লন্ডন থেকে নিজের পড়াশোনার পাঠ শেষ করেন টিউলিপ। ২০০৬ সালের ইংল্যান্ডের উপ-নির্বাচনেও অংশ নেন টিউলিপ। কিন্তু সেইবার জয়ের মুখ দেখেননি। এরপর ২০১০ সালে কামডেন নির্বাচনে টিউলিপ প্রথম বাঙালী নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। সেখানে তিনি ২০১৪ সালের মে মাস পর্যন্ত কালচার ও কমিউনিটির কেবিনেট মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর একবার আন্তর্জাতিক প্রচারণাতেও অংশ নেন তিনি। ২০০৮ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্যও প্রচারণা করেন তিনি। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্নের নির্বাচনে জয়লাভ করেন টিউলিপ। ২৩,৯৭৭ ভোট পেয়ে নির্বাচনে নিজের জয় নিশ্চিত করেন টিউলিপ। ২০১৫ সালের জুনে টিউলিপ সিদ্দিক অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ এগেইনিস্ট এন্টিমিটিজমের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেপ্টেম্বরে গিয়ে কালচার, মিডিয়া ও স্পোর্টসের শ্যাডো মিনিস্টারের স্থায়ী প্রাইভেট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এরপর একই বছরের নবেম্বরে পার্লামেন্টে টিউলিপের বক্তব্য বিবিসির সেরা সাত সংসদ সদস্যের বক্তব্যের একটি হয়। ২০১৩ সালে ১০০ শক্তিশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ক বাংলাদেশী ব্রিটিশের একজন হন তিনি। এছাড়া সানডে টাইমস তাকে লেবার পার্টির ‘উঠতি তারকা’ হিসেবেও অভিহিত করে। রূপা হক। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট নির্বাচনে আরেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। ৪৩ বছর বয়সী রূপা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল এ্যান্ড এ্যাকটন আসনের প্রতিনিধিত্ব করছেন। রূপা হক কেমব্রিজে পড়েছেন রাজনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান ও আইন নিয়ে। আর কিংস্টন ইউনিভার্সিটিতে দীর্ঘদিন পড়িয়েছেন সমাজ বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের মতো বিষয়। এর আগে ডেপুটি মেয়র হিসাবে স্থানীয় সরকারেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৭২ সালে ইলিংয়ে জন্ম নেয়া রূপা হক ১৯৯১ সালে লেবার পার্টির সদস্য হন। তিনি একাধারে লেখক, মিউজিক ডিজে, কলামনিস্ট হিসাবে পরিচিত। ব্যারোনেস মঞ্জিলা পলা উদ্দিন প্রথম বাংলাদেশী মুসলমান নারী হিসেবে হাউস অব লর্ডসে প্রবেশ করেছেন। তিনি নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী শপথও নিয়েছেন। আনোয়ার চৌধুরী দুই হাজার চার সালে বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। আর তিনিই প্রথম অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে কূটনৈতিক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. মোহাম্মদ আব্দুল বারী। আর মুরাদ কুরেইশী লেবার দলের রাজনীতিবিদ হিসেবে গ্রেটার লন্ডন এ্যাসেম্বলিতে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া অনেকেই ব্রিটেনে মিডিয়া, ব্যবসা বাণিজ্যে এবং আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় রকমের অবদান রেখে চলেছেন। যা গর্বের সঙ্গে আমাদের কমিউনিটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ রকম আরও কত নাম না জানা ব্রিটিশ বাংলাদেশী কৃতিত্বের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এবং বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে নিজের ও জাতির সম্মান বয়ে আনছেন। সবাই যে যার অবস্থানে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। একটা সময় ছিল যখন ব্রিটিশ বাংলাদেশীরা খুবই কষ্টের মধ্যে প্রবাস জীবন অতিবাহিত করেছেন। বলা চলে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আজ এখানে আমরা। একটা সময় আমাদের কমিউনিটির বেশিরভাগ মানুষ বেকার ছিল। তারা কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। এমনকি সন্তানদের স্কুলে দেয়াও অনেক সমস্যা ছিল। উনিশ শ’ সত্তর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে সহিংসার মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। অভিবাসন বিরোধী বেথনাল গ্রীন তখন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তারা তখন অভিবাসনবিরোধী লিফলেট বিতরণ করত। ‘স্কিন হেড’ বলে পরিচিত শেতাঙ্গরা তখন ব্রিকলেনে ভাংচুর করত, বাঙালী শিশুদের লক্ষ্য করে থুথু ছিটাত আর মহিলাদের নিগৃহ করত। এদের ভয়ে শিশুরা অনেক সময় স্কুল থেকে বেরিয়ে যেত, আর মহিলারা ও পুরুষরা দল বা জোট বেঁধে হাঁটা চলা এবং কাজ কর্ম করতেন। বাবা মায়েরা নিজেদের এবং সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সন্তানদের ওপর এক ধরনের কারফিউ জারি করে রাখতেন। আর বাড়ি ঘরকে অগ্নিসংযোগের হাত থেকে রক্ষা করতে আগুন প্রতিরোধী লেটার বক্স স্থাপন করে রাখতেন। এভাবে চলছিল বাংলাদেশীদের জীবন চলা। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালের ৭ মে কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আলতাব আলী নামের পঁচিশ বছরের এক তরুণকে তিন কিশোর হত্যা করে। একে জাতিগত উন্মাদনার ফল হিসেবেই ধরে নেয়া হয়। এ হত্যাকা-ের ফলে সেখানকার বাংলাদেশীরা একত্রিত হয়ে এ ধরনের হামলা প্রতিহত করার উদ্যোগ নেন এবং ন্যাশনাল ফ্রন্টের বিরুদ্ধে ব্রিকলেনে বাংলাদেশীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এর ফলশ্রুতিতেই বাংলাদেশ ইয়ুথ মুভমেন্ট নামের সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং ১৪ মে প্রায় সাত হাজারের মতো বাংলাদেশী জড়ো হয়ে আলতাব আলীর কফিন নিয়ে হাইড পার্কে এই সহিংসতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তখন অনেক বাঙালী তরুণ স্থানীয়ভাবে সংঘটিত হয়ে স্কিনহেডদের ওপর চড়াও হতে শুরু করে। আর তখন থেকে ব্রিটেনে বর্ণবাদী আন্দোলনের সঙ্গে আলতাব আলীর নাম জড়িয়ে যায়। এখনও সেটা ব্রিটেনের মানবাধিকার আন্দোলনের অংশ। ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বাংলাদেশী কমিউনিটির অবদানের কথা স্বীকার করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছিলেন, এখানকার কয়েক লাখ বাংলাদেশী সরাসরি এদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের আরও ভাল ভাল কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, ব্রিটিশ বাংলাদেশীরা একাডেমিক শিক্ষা ক্ষেত্রেও অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। জিসিএসি এবং এ লেভেল পরীক্ষায় ফলের ক্ষেত্রেও শীর্ষ স্থান দখল করে যাচ্ছেন। এমনকি উচ্চশিক্ষায়ও বাংলাদেশীরা এগিয়ে। বলা যায়, ব্রিটেনে বাংলাদেশীরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আগামী দিনে ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন। যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে এক অনুষ্ঠানে তিনি এমন আশার কথা শুনিয়েছেন। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দারুণ উৎসাহ যুগাবে। ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বহু দেশে বাংলাদেশীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এবং কত শত অবদান রেখে বাংলাদেশকে যেমন গর্বিত করছেন, তেমনি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। ব্রিটেনে ব্রিটিশ বাঙালীদের অবদান ও অর্জনকে তুলে ধরতে কাজ করছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশী বিজনেস ফোরামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এভাবেই বৃটেনে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশীরা। লেখক : বৃটেন প্রবাসী শিক্ষাবিদ
×