ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হাতছাড়া হচ্ছে

পূর্বাঞ্চলীয় রেলের ৪৮২ একর জমি বেদখল

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২২ মে ২০২২

পূর্বাঞ্চলীয় রেলের ৪৮২ একর জমি বেদখল

নয়ন চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশের সরকারী সম্পদের মধ্যে রেলওয়ের ভূমিই সবচেয়ে বেশি বেদখলে গেছে। এর প্রধান কারণ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাব। ফলে সরকার যেমন বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে তেমনিভাবে এসব জমি নিয়ে খুন খারাবি এবং বিভিন্ন দুর্ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ ৭ মে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ফরিদ নামের এক মোটর মেকানিককে তার পরিচিতজনরা পিটুনি দিয়ে হত্যা করে। এর নেপথ্যে রেলের জমি নিয়ে বিরোধ। বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রায় সাড়ে ২১ হাজার একর জমি রয়েছে, যার মধ্যে বেদখল প্রায় ৪৮২ একর। প্রভাবশালী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় এসব জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। ভূমি উদ্ধারে রেলওয়ে অভিযানে নামলেও সফলতা আসে না। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় উদ্ধার হওয়া জমি ফের হাতছাড়া হয়ে যায়। ভূমি নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য তৈরি করা হয় ভুয়া দলিল। এ ছাড়া অনুকূল হয় উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ। নি¤œআয়ের লোকজনদের এসব জমিতে ঘর-দোকান ভাড়া দিয়ে জনবল সৃষ্টির মাধ্যমে উচ্ছেদ অভিযানে বিঘœ ঘটায় সাবেক ও বর্তমান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, দখল হওয়া জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কথিত কার্যালয়, ক্লাব, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ দখলদারদের হাতে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের ভূমি। এর ফলে রেলওয়ের স্বনির্ভরতা কমছে দিন দিন। ভূমি উদ্ধারে একযোগে অভিযান চালিয়ে যদি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে যেমন সদ্ব্যবহার হবে তেমনিভাবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আয় দিয়েই যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন করা যাবে। রেলওয়ে ভূ-সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ, সিলেট বিভাগ, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা বিভাগ (ফরিদপুর জেলা বাদে)। এই বৃহৎ অঞ্চলজুড়ে বেদখলে থাকা ৪৮২ দশমিক ৫ একর জমির মধ্যে সরকারী, বেসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-স্থাপনা এবং প্রভাবশালীদের বস্তি, মার্কেট রয়েছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, টাইগারপাস হতে ফয়’স লেক এলাকা পর্যন্ত সিংহভাগ রেলওয়ের ভূমি অবৈধ দখলদারদের কব্জায়। আকবর শাহ, আমবাগান, পাহাড়তলী, আইস ফ্যাক্টরি এবং কদমতলী এলাকায় যত বস্তি রয়েছে তাতে আছে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব। টোকেন মানি দিয়ে বস্তির প্রভাবশালীরা কয়েক হাত বদলের মাধ্যমে এসব জায়গা থেকে ভাড়া তুলে নেয়। আর কর্মচারীদের জন্য বসবাস করার স্থাপনা ভাড়া দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গা জমি দখল করে কোটি কোটি টাকা অবৈধ আয় করছে রেলওয়ের কতিপয় কর্মচারী। এসব বেদখল ভূমিই নগরীর অপরাধের আখড়া। এসব স্থাপনা উচ্ছেদ শেষে ভূ-সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা অফিসে পৌঁছানোর আগেই বড় আঙ্গিকে পুনর্দখল হয়ে যায়। কাঁটাতার কিংবা সীমানা দেয়াল দিতে না পারার কারণে পুনর্দখল করে মালিক বনে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। রেলের বেদখল চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জমিতে বস্তি, মার্কেট গড়ে তুলে জাল কাগজপত্র তৈরি করেছে শক্তিশালী চক্র। তারা এসব জমির মালিকানা সত্ত্ব বিক্রি করার মত দুঃসাহস দেখিয়েছে খোদ রেল কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। অনেক মামলা এখন আদালতে। এসবের কারণে আদালতের স্থগিতাদেশের সুযোগে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ থেমে নেই। রেললাইনের দুই পাশের বস্তিতে মাদক বিক্রির বিষয়টি সারাদেশে ভাবমূর্তিও ক্ষুণœœ করেছে। আর এসব জায়গা অপরাধীদের আঁতুড়ঘর, তা ওপেন সিক্রেট। এসব জায়গায় উচ্ছেদ করা যায় না তদারকির অভাবে। উচ্ছেদ করা রেলের জমি পুনর্দখল করছে চট্টগ্রাম নগরীর প্রভাবশালীরা। আর কিছু এলাকায় মামলার কারণে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না, বলছেন রেলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, বেদখল ভূ-সম্পত্তি উদ্ধারে রেলওয়ে প্রায় অভিযান করছে। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে এলএ প্ল্যান অধিগ্রহণ হয়েছে কিন্তু খতিয়ানভুক্ত হয়নি। তাই অনেকেই নিজকে ভূমির মালিক দাবি করে। আর মামলাগুলোও নিষ্পত্তি করে ভূমি উদ্ধারে চেষ্টা করছি। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ভুয়া ও জাল দলিল তৈরি করে ভূমি দখল করে রাখা। তারাই আবার উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে ভূমির দাবিদার হয়ে। অনেকে লিজ নিয়েছে কিছু জমি। কিন্তু আশপাশের অনেক ভূমি দখলে রেখে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিয়েছে। আবার এরসঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীরা জড়িত। তারাই মূলত উচ্ছেদ বিলম্ব করার জন্য মামলা ঠুকে দেয় আদালতে। ওই সময়ে আবারও চলে দখল। রেলের ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালাকে সংস্কার করা হচ্ছে। গত দুই বছরে ৯১টি উচ্ছেদ অভিযানে প্রায় ৭০ দশমিক ৯৩ একর ভূমি উদ্ধার হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান চলবে। সূত্র জানিয়েছে, পূর্বাঞ্চল রেলে তাদের জমি সাড়ে ২১ হাজার একর। এর মধ্যে রেলওয়ে অপারেশনাল কাজে ব্যবহার করছে ১৩ হাজার ৭৮৯ দশমিক ৫০ একর। এ ছাড়া বাণিজ্যিক প্লট ও ভূমি ৬৮ দশমিক ৭৭৯, ৮ হাজার ৮৭৭ দশমিক ১৭ একর কৃষি, প্রায় ২৮৫ একর মৎস্য-পুকুর-জলাশয়, ৪৪ দশমিক ৯৩ একর নার্সারি এবং অন্যান্য কাজে প্রায় ৮৬৫ একর জমি লিজ দেয়া আছে। রেলের উর্ধতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বাধীনতা পূর্ব থেকেই একশ্রেণির দখলদার তাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম রেলের জমি দখল করে রেখেছে। আবার এক শ্রেণির সিন্ডিকেট রয়েছে যারা কিছু অংশ লিজ নিয়ে বিশাল জায়গা বেহাত করে গড়ে তুলেছে অপরাধের সা¤্রাজ্য। ভূমিদস্যু এবং রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ভাগভাটোয়ারা করে রেলের ভূমি গিলে খাচ্ছে যুগের পর যুগ। রেলের জায়গা নিয়ে বিরোধে খুন খারাবি ॥ চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে মোটর মেকানিক মো. ফরিদ রেলওয়ের জায়গায় দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছিল। এসবের বিরোধে তাকে ৭ মে হত্যা করা হয়। হত্যার ঘটনায় পরিবারের করা মামলায় দুজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। ৮ মে রাতে ফরিদের বোন রাশেদা আক্তার ডবলমুরিং থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। আসামিরা এলাকায় রেলওয়ের জমি দখল বাণিজ্যে জড়িত। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত ফরিদ (৪৫) পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনিতে একটি মোটর ওয়ার্কশপ চালাতেন। পাশাপাশি রেলওয়ের জায়গায় দোকান নির্মাণ করে ভাড়াও দিয়েছিল। সেদিন রাতে পাহাড়তলী রেলওয়ে স্টেশন জামে মসজিদের কাছে তাকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। পরে ভোরে চমেকে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
×