ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

উম্মে কুলসুমের এগিয়ে চলা

প্রকাশিত: ০০:১৫, ১৭ মে ২০২২

উম্মে কুলসুমের এগিয়ে চলা

চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত, রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়া মোসাম্মত উম্মে কুলসুমের শৈশব-কৈশোর কাটে নিজ গ্রামের নির্মম চৌহদ্দিতে। ৬ ভাই ৪ বোনের সংসারে পিতা-মাতার দায়-দায়িত্বের কমতি ছিল না। কিন্তু প্রচলিত সমাজ সংস্কারে আটকে থাকার গতানুগতিক মানসিকতায় ১০ ভাই বোনই গৃহে অবস্থান করে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যান। তবে অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজীর জন্য যথানিয়মে গৃহশিক্ষক রাখাও ছিল পিতার অকৃত্রিম দায়বদ্ধতা। তবে পুত্র-কন্যাদের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব না হওয়ার দৃশ্য এখনও কুলসুমের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পরবর্তীতে সবাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় অনুপ্রবেশ জীবন চলার পথের এক আবশ্যকীয় কর্মযোগ। তবে উম্মে কুলসুমের মনে আছে তিনি প্রথম ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণীতে। তাও আবার বছরের শেষ সময়ে। সেপ্টেম্বর মাসে। ‘কৃষ্ণ গোবিন্দ গার্লস হাইস্কুল’ এ অঞ্চলের এক ঐতিহ্যম-িত নারী শিক্ষার নতুন যাত্রাপথ। উচ্ছ্বসিতভাবেই বললেনÑ নাচোলে বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্রের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি তাকে এখনও প্রাণিত করে। ইলা মিত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শুরু করলেও পরবর্তীতে তা মাধ্যমিকের পর্যায়ে উন্নীত হতে সময় লাগেনি। এই মহান বিদ্যাপীঠ থেকেই কুলসুমের ১৯৮৬ তে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। পরে নবাবগঞ্জ সরকারী কলেজ থেকে ১৯৮৮তে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। আর থামতে হয়নি। সেশন মোতাবেক ১৯৮৮’র শেষ পর্যায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়া জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পালাক্রম। স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন তাও যেন সামনে এগিয়ে চলার অনন্য মাইলফলক। শিক্ষাজীবন চলে স্বাভাবিক গতিধারায় আপন ইচ্ছার দৃঢ়প্রত্যয়ে। ফলে আর কোন বাধা প্রতিবন্ধকতা চলার পথকে বিপন্ন করতে না পারাও বড় ধরনের সফলতা। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) পরীক্ষা দিয়ে মেধা ও মনন যোগ্যতায় পেশাগত জীবন তৈরি করাও এক অবিস্মরণীয় কর্মদ্যোতনা। প্রথমেই কর্মজীবন শুরু করেন শরীয়তপুরের গোসাইহাট উপজেলায় সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে। তবে লক্ষণীয় সে সময় আর কোন মহিলা এই প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করতেন না। একাই পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে পেশাগত জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে চলমান রাখার অভিজ্ঞতাও বেশ স্বস্তিদায়ক। বাংলাদেশ ছোট হলেও চাঁপাই থেকে শরীয়তপুর খুব একটা কাছেও ছিল না। পরে রাজশাহীর কাছাকাছি নওগাঁয় বদলি হওয়াও অনেকটা আনন্দদায়ক। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার হিসেবে একই পদে যোগ দিয়ে (২০০৯-২০১৯) আরও ৭টি বছর পার করতে হয়। ইতোমধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন মোহাম্মদ আবু হাসিবের সঙ্গে ১৯৯৭ সালে। স্বামী মূলত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতক স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করা এক উদার, মানবিক মানুষ। বাম ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আবু হাসিব স্ত্রীর কর্মজীবনে এগিয়ে চলার পথে বাধা তো হনইনি বরং যতখানি সাহায্য-সহযোগিতা করতে প্রয়োজন সবটাই দিতে একেবারে দ্বিধাহীন ছিলেন। স্বামীর দেয়া অবারিত স্বাধীনতায় বিবাহিত জীবনে কখনও কোন দুর্যোগ নেমে আসতে পারেনি। এক পুত্র সন্তানের জননী হওয়া যেমন আনন্দঘন অনুভব- সেখানে কিছুটা কষ্ট ভোগও যেন নিয়তির অমোঘ বিধান। জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক দৌর্বল্যে কারিব যেন ব্যতিক্রমী ধারায় গড়ে উঠতে থাকে। মা হিসেবে কোন কিছুতেই কার্পণ্য করেননি কুলসুম সন্তানের শরীর ও মনের সার্বিক পরিচর্যায়। রাজশাহীর শহীদ কামরুজ্জামান মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছেলে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। পারিবারিক এবং পেশাগত জীবনে অনেকটাই সফল উম্মে কুলসুমের লক্ষ্য সন্তানের একটি সুস্থ, সুন্দর ভবিষ্যত তৈরির মহাপরিকল্পনা। দোয়া থাকল এমএ কারিবের প্রতি যাতে সে একটি সম্ভাবনাময়, নতুন জীবনকে বরণ করে নিতে পারেন। বর্তমানে কুলসুম রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে সমাজসেবা কার্যালয়ে উর্ধতন কর্মকর্তার মর্যাদায় উপ-পরিচালক হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন। সেখানে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া গরিব, দুস্থ রোগীদের ওষুধপত্রসহ নানামাত্রিক শারীরিক ও মানসিক সেবা দিয়ে যাওয়াও বর্তমান কর্মযোগের অনন্য ব্যবস্থাপনা। উন্নয়নের অভিযাত্রায় দুরন্তগতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের নারীর অবস্থান নিয়ে কথা বলেন এই সরকারী কর্মকর্তা। ১৯৯৬ সালে যখন পিএসসি পরীক্ষা দেন সে সময় উত্তীর্ণ ১৬০ জনের মধ্যে মাত্র ২০ জন নারী ছিল। তবে এখন তাদের সংখ্যা দ্রুততার সঙ্গে বেড়ে যাওয়াও সময়ের ন্যায্য দাবি। শিক্ষায় মেয়েদের অগ্রগামিতা স্বস্তিদায়ক। বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নারীদের উচ্চপদে আসীন হওয়াও এখন দৃষ্টিনন্দন। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো জায়গায় নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবেও নিজেদের তৈরি করতে পেছনের দিকে তাকাচ্ছে না। বুটিক শিল্প, নকশিকাঁথা, হাতের তৈরি হরেক রকম কারুকার্যখচিত সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে আমের স্বর্গরাজ্য চাঁপাইয়ে এখন নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত হয়ে নিজের অংশীদারিত্ব প্রমাণ করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীতেও নারী শ্রমিকের সম্পৃক্ততা এখন নজরকাড়া। তবে পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় নারীদের মজুরি এখনও কম। শ্রম মজুরিতে এই বৈষম্য কোনভাবেই কাম্য নয়। সময় এবং কাজের ফারাক ব্যতিরেকে শুধু মজুরিতে দৃষ্টিকটু বৈষম্য নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার ছাড়া অন্য কিছু নয়। এমন সব তারতম্য যত তাড়াতাড়ি দূর করা সম্ভব হবে ততই বাংলাদেশ সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন উম্মে কুলসুম। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×