ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আহসান হাবিব

ভোজ্যতেলের বাজার কার হাতে

প্রকাশিত: ২১:০০, ১৩ মে ২০২২

ভোজ্যতেলের বাজার কার হাতে

ঈদ উৎসবের ডামাডোলের মধ্যেই ভোজ্যতেলের বাজার থেকে এলো আরও বড় দুঃসংবাদ। এখন থেকে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে হবে ১৯৮ টাকা আর প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল কিনতে লাগবে ১৮০ টাকা। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনের নির্ধারণ করা এই দরে সায় দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে তেলের দাম একবারে এত বাড়েনি। এক লিটার সয়াবিনের দরও কোন সময় এই দামে পৌঁছায়নি। এই মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে রেকর্ড গড়ল ভোজ্যতেল। ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে পুরো রমজানে ভোজ্যতেলের সরবরাহে টান ছিল। ঈদের সপ্তাহখানেক আাগে সয়াবিন তেলের জন্য শুরু হয় রীতিমতো হাহাকার। বাজার থেকে হাওয়া হয়ে যায় সয়াবিন ও পাম অয়েল। এ সময় বাড়তি দাম দিয়েও অনেকেই কিনতে পারেনি সয়াবিন তেল। এই সঙ্কটের মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার (৫ মে) নতুন দর নির্ধারণ করল ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর সমিতি। দর নির্ধারণের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে ‘সাধারণ নাগরিক সমাজ’ নামে একটি সংগঠন দাবি করেছে, নতুন করে তেলের দাম বাড়িয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকেই পুরস্কৃত করেছে। টিসিবির তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি বেড়েছে ৮০ টাকা। ২০২১ সালের ৫ মে বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১১৮ টাকা। গত চার বছরে যেসব ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম সয়াবিন ও পাম অয়েল। সর্বশেষ, গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন তেলের দাম বাড়িয়েছে। তখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮, খোলা সয়াবিনের দাম ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৪৩, বোতলজাত ৫ লিটারের দাম ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ৭৯৫ ও পাম তেল ১৫ বাড়িয়ে ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবার নতুন দাম নির্ধারণের ফলে এখন থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হবে ১৯৮ টাকা। ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা এবং খোলা পাম তেল ১৭২ টাকায় বিক্রি হবে। টিসিবির তথ্যানুয়ায়ী, ২০১৯ সালে দেশের বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১০৪ টাকা। ২০২০ সালে সেটি বেড়ে হয় ১১৩, ২০২১ সালে ১৩০ এবং ২০২২-এর শুরুতে এসে হয় ১৬৮ টাকা। এ ছাড়াও পামওয়েলের লিটার (খোলা) ২০১৯ সালে ছিল ৫৮ টাকা, ২০২০ সালে ৭৮, ২০২১ সালে ১০৭ এবং ২০২২ সালের শুরুতে হয় ১৫০ টাকা। তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে গত মার্চ মাসে কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে মাত্র ৫ শতাংশ বহাল রেখে আমদানি, পরিশোধন ও ভোক্তাপর্যায়ে সব ধরনের ভ্যাট তুলে নেয় সরকার। শুল্ক কমানোর পর গত ২০ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে লিটারে ৮ টাকা কমিয়ে নতুন দাম ঘোষণা করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন। ওই ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৩৬ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া পাঁচ লিটারের এক বোতল তেল ৭৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর আবারও মূল্য বাড়ল। তেলের দাম বাড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে সিন্ডিকেটের মুখস্থ করা কথা হলো- বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে। সবকিছুর পর এটাই সত্যি, গত এক বছরেও সয়াবিনের বাজার স্থিতিশীল করা গেল না। প্রশ্ন জাগে, বাজার যারা অস্থিতিশীল করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেউ কি নেই? বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের বর্তমান মূল্য প্রতি টন ১২শ’ থেকে বেড়ে ১৮শ’ ডলারে উঠেছে। এজন্যই দেশের বাজারে দাম বাড়াতে হচ্ছে। এই সরল ব্যাখ্যা দিয়ে যারা মুনাফা লুটে নিচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করলে বাজার নিয়ন্ত্রণ হতে পারে। ঈদ করে মানুষজন যখন শহরে ফিরছে তখন অধিকাংশই কপর্দকশূন্য। এ সময়ে যেভাবে তেলের দাম বাড়ানো হলো তাতে মানুষ মহাসঙ্কটে পড়বে। অক্টোবর থেকে মে পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম চারবার ওঠানামা করল। এর মধ্যে তিন দফায় দাম বেড়েছে, কমেছে একবার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা অজুহাতে অনেক দিন ধরেই ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির। এ অবস্থায় দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানির ওপর ১০ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং বিপণন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে। এর আগে এলসি কমিশন ও মার্জিন প্রত্যাহার করা হয়। এরপরও বাজারে তেলের দাম কমেনি। তখন সরকার ২০ মার্চ তেলের দাম প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা থেকে ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু ওই দামে বাজারে তেল পাওয়া যায়নি। দাম নির্ধারণের পরও প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৮০ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার ফের দাম বাড়ানো হলো। নতুন করে বেঁধে দেয়া পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন ৯৮৫ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটি কিনতে ক্রেতার নাভিশ্বাস উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে মিল মালিকদের চাপে আবারও সরকারের পক্ষ থেকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হলো। মিল মালিক এবং কালোবাজারি চক্রের কারসাজিতে আবার বেসামাল হয় ভোজ্যতেলের বাজার। ১৫ রোজার পর মিল থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়। এই সুযোগে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারাও কারসাজি করেন। ঈদের দুদিন আগে থেকে ঈদের দুদিন পর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত খুচরা বাজারে বোতলজাত তেল পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়। আর কয়েকটা দোকানে পাওয়া গেলেও লিটার ২১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২২০ টাকা। বৃহস্পতিবার ঢাকা শহরের জিনজিরা বাজার, নয়াবাজার, রায়সাহেব বাজার ও মালিবাগ কাঁচাবাজার ঘুরে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। মালিবাগ কাঁচাবাজারের একটি দোকানে পাওয়া গেলেও ২১০ টাকা লিটার বিক্রি হয়েছে। অথচ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরকারের বেঁধে দেয়া দর ছিল ১৬০ টাকা। আর খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ২১০-২২০ টাকা। সরকারের বেঁধে দেয়া দর ১৩৬ টাকা। বর্তমানে অভিযান চালিয়ে যতটুকু অবৈধ মজুদ তেল উদ্ধার হচ্ছে, তা কিয়াংশ মাত্র। দাম আরও বাড়বে আগামী শীতে। তেলের দাম একসঙ্গে এই পরিমাণ বাড়ার পর অন্যসব দ্রব্যমূল্য যেমন- চাল, ডাল, কাঁচা তরিতরকারিতেও এর প্রভাব পড়েছে। আড়তের চেয়ে মহল্লার বাজারে এবং মহল্লার দোকানগুলোতে কাঁচা তরিতরকারির দাম আকাশ-পাতাল তফাত। যে যেমনে পাচ্ছে ভোক্তাদের কাছ থেকে লুটেপুটে নিচ্ছে। সাধারণ ভোক্তারা ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ায় মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। কিন্তু মানুষের বেতন তো বাড়ছে না। তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? বাজার কেন অস্থিতিশীল হয়, কিভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটা সরকারের জানা। দেশের সিংহভাগ মানুষের কথা ভেবে বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে, এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর সঙ্গে আমাদেরও। লেখক : সাংবাদিক
×