ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

পুলিশের নতুন উদ্যোগ

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ১৩ মে ২০২২

পুলিশের নতুন উদ্যোগ

গত ৭ মে ২০২২ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনের বিষয়ে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পুলিশে অগ্রসরমান পরিবর্তনের স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বিষয়টি হচ্ছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ পুলিশেও নানাবিধ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং কিয়দংশ হলেও বাস্তবায়ন করেছে। উন্নত বিশে^র পুলিশিংয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ পুলিশও অপরাধীদের নিষ্ক্রিয় করতে নবতর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে চেষ্টার কোন ঘাটতি নেই। তথাপি পুলিশকে নিয়ে মুখরোচক আলোচনারও কমতি নেই। এ কথাও উল্লেখ করতে হবে, পুলিশের অনেক সদস্যই যেমন দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, আবার অনেকেই দুর্নীতি থেকে যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করে। দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধ এবং পুলিশ বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সকল ধরনের কর্মকা- পর্দায় মনিটর করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ৬৪ জেলার সাড়ে ৬ শতাধিক থানায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের এই জনগুরুত্বপূর্ণ আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে পুলিশ সদর দফতর। এ প্রকল্পের শুরুর দিকে রেঞ্জ ও মেট্রো অফিসে পরিকল্পনা প্রণয়নের পর পর্যায়ক্রমে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে তা কার্যকর করা হবে। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের সব অঞ্চল সিসি ক্যামেরার আওতায় চলে আসবে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে সব তদারক করা সম্ভব হবে। পুলিশ সদর দফতর কর্তৃক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, জনবান্ধব পুলিশিং, হয়রানি বন্ধ, প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করা, সব ধরনের কার্যক্রমকে মনিটরিং করা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ঢাকা রেঞ্জের ১৩ জেলার ৯৬টি থানায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব উদ্যোগের ফলে পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব ক্রমান্বয়ে কমে আসছে এবং জনসাধারণও এর সুফল পাচ্ছে। তারই ফলে পুলিশ সদর দফতর অন্যান্য রেঞ্জকে ঢাকা রেঞ্জকে অনুসরণ করতে নির্দেশনা প্রদান করেছে। যদি কোন সিসি ক্যামেরা কোন কারণে অকেজো হয়ে পড়ে তাৎক্ষণিক তা মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দও প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে কোন খামখেয়ালির সুযোগ নেই। পুলিশ বাহিনীর নিকট জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিতই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সাধারণত দেখা যায়, সাধারণ ডায়েরির ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে তেমন তদারকির নজির দেখা যায় না। কিন্তু সাধারণ ডায়েরিগুলোকে দ্রুত মনিটরিং-এর আওতায় এনে তদন্ত কাজ শেষ করে প্রতিবেদন উপস্থাপনের জন্য নির্দেশনা এসেছে। জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯-এর ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছে। এর অধীনে পরিচালিত সকল কার্যক্রমের বিস্তারিত জানাতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এমন নির্দেশনা এসেছে। থানায় পুলিশী সেবা গ্রহণে কোন ধরনের লেনদেনের প্রয়োজন হয় না- এমন বার্তা জনসাধারণকে জানাতে হবে। থানায় জিডি, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন সংক্রান্ত কোন ধরনের লেনদেনের দরকার হয় না- এমন প্রচার-প্রচারণা চালানোর নির্দেশনাও এসেছে পুলিশ সদর দফতর থেকে। অর্থাৎ পুলিশী সংক্রান্ত সব ধরনের সেবা সম্বন্ধে জানাতে হবে জনসাধারণকে। জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশে^ রোল মডেল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যে কোন পরিস্থিতিতে যে কোন সময় সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করতে বদ্ধপরিকর- এমন বার্তা ইতোমধ্যে সবাই পেয়েছে। শুধু তাই নয়, এদের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শূন্য সহিষ্ণু নীতি অনুসরণ করে। কাজেই এদের সম্পর্কে তথ্য জানা মাত্রই পুলিশকে অবহিত করতে হবে। জনসাধারণ যেন এ ধরনের তথ্য গোপন না করে সে মর্মে কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। জনসাধারণকে সচেতন করতে এবং জঙ্গীবাদের ভয়াবহতাকে সাধারণের সামনে উপস্থাপন করতেও কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। পাশাপাশি মোবাইল, ইন্টারনেট, সাইবার ক্রাইম সম্বন্ধে জনগণকে সচেতন করতে হবে। চোর, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, ডাকাত ইত্যাদি সম্পর্কে পুলিশ যেমনভাবে জনগণকে অবহিত করবে, ঠিক তেমনিভাবে জনগণও পুলিশকে যথাযথ তথ্য প্রদান করবে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার স্বার্থে। এলাকাবাসীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসাররা নিয়মিত আলোচনা করবেন। এলাকাবাসী আলোচনার প্রেক্ষিতে ভাড়াটিয়াদের তথ্য পুলিশ অফিসারদের সরবরাহ করবেন নিরাপত্তার স্বার্থে। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে যে সকল জায়গায় সিসি ক্যামেরা নিজেদের উদ্যোগে বসানো প্রয়োজন সে ব্যাপারে দ্বিপাক্ষিক মতামতের মাধ্যমে নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করা যায়। গুজবের বিষয়ে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করে পুলিশ সদস্যদের অবহিত করা প্রয়োজন। প্রবাসে কর্মরত ব্যক্তির পরিবারের কেউ কোন সমস্যায় উপনীত হলে তাদের সমস্যাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মনিটরিং করার বিধান নির্দেশনায় উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুজব ও অন্যান্য বিশৃঙ্খলা এড়ানোর স্বার্থে অফিসারদের মাধ্যমে মনিটরের নির্দেশনা প্রদান করে বিজ্ঞপ্তি উল্লেখ করেছে পুলিশ সদর দফতর। সিসি ক্যামেরা অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আবার সাধারণ অনেকেই মনে করেন সিসি ক্যামেরা বসানো মানে টাকার অপচয় করা। কিন্তু প্রকৃত বিষয়টি তা নয়। কেননা, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে যাবতীয় বিষয়ের রেকর্ড সংরক্ষিত থাকে বিধায় অপরাধীকে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠে। নিরাপত্তা প্রহরীর তুলনায় সিসি ক্যামেরা বেশ ফলপ্রসূ এবং কম খরচেই সেটা সম্ভব। আমরা সকলেই জানি, অপরাধী অপরাধ করার মুহূর্তে যে কোন একটি প্রমাণ ঘটনাস্থলে রেখে আসে। এ সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়েই প্রকৃত দোষীকে সাব্যস্ত করা সম্ভব। তাই অপরাধীরা পারতপক্ষে সিসি ক্যামেরা জোনে অপরাধ করার দুঃসাহস দেখায় না। কারণ, অপরাধীরা অপরাধ করার আগে লাভ-ক্ষতির হিসাব জেনে-বুঝে অপরাধে উদ্যত হয়। অপরাধী যখন বুঝতে পারবে অপরাধ করলে সেটির প্রমাণ সিসি ক্যামেরায় রক্ষিত থাকবে তাহলে সে স্বাভাবিকভাবেই সিসি ক্যামেরা অধ্যুষিত এলাকায় অপরাধ করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে না। অর্থাৎ সিসি ক্যামেরা অপরাধীকে অপরাধপ্রবণতা থেকে বিরত এবং সমগ্র এলাকাকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখে। কাজেই পারিবারিক বাজেটে সিসি ক্যামেরা বসানো ও পরিচালনা বাবদ খরচ কোনভাবেই খরচের অপচয় নয়। বরং সিসি ক্যামেরা অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সিসি ক্যামেরার প্রয়োজনীয়তা ও অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কাজটিও পুলিশ বাহিনী আলোচনার মাধ্যমে করতে পারে। পুলিশ সম্বন্ধে বিভিন্ন নেতিবাচক কথা চালু রয়েছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষও পুলিশের এহেন নেতিবাচক আচরণের কথা স্বীকার করেছে এবং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অগ্রগামী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে সারাদেশে পুলিশের সকল কার্যক্রমকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা এবং কেন্দ্রীয়ভাবে সেটি মনিটরিং করার বিধান রেখেই কার্যক্রম পরিচালিত হবে। অভিযোগ রয়েছে, থানায় পুলিশী সেবা গ্রহণ করতে জনসাধারণকে হেনস্তার সম্মুখীন হতে হয়। টাকা লেনদেন করতে হয় সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ জিডি করা, কোন অভিযোগ দাখিল করা ইত্যাদি সংক্রান্ত কাজে ঘুষ লেনদেন করতে হয় এমন অভিযোগ পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে থানার কার্যক্রম যখন সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা হবে তখন পুলিশ সদস্যরা বিভাগীয় শাস্তির ভয়ে কোনভাবেই অপরাধ কার্যক্রমে তথা ঘুষ লেনদেনে সচেষ্ট হবেন না। বিভাগীয় শাস্তি ও বিভাগীয় নিয়মনীতি এবং শৃঙ্খলার কারণে পুলিশ সদস্যরা এসব থেকে বিরত থাকবেন। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ ও প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হলে বাংলাদেশ পুলিশের কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হবে। বিগত একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, একটি প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে দুটি উপায়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে আজকের নিবন্ধে বলতে চাই একটি বাহিনী কিংবা সরকারের একটি বিভাগ সাধারণত দুটি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। প্রথম প্রক্রিয়ায় বলা চলে, প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক সদস্য যদি দেশমাতৃকার টানে, পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ জায়গায় সৎ ও শৃঙ্খল উপায়ে দায়িত্ব পালন করে তাহলে প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চিতভাবে দুর্নীতিমুক্ত ও সকলের নিকট আস্থাভাজন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি সৎ ও দায়িত্বশীল হয়ে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে উদ্যোগী হয়ে কাজ শুরু করেন তাহলেও প্রতিষ্ঠানটি একটি স্বচ্ছ ও শৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সর্বোপরি সকলের নিকট একটি গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমান আইজিপি মহোদয় তার দীর্ঘদিনের একাডেমিক ও পেশাগত অভিজ্ঞতার সম্মিলনের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর যুগোপযোগী ও কার্যকর পরিবর্তনের উদ্যোগ হিসেবে দেশব্যাপী থানাগুলোতে সিসি ক্যামেরা বসানোর যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে জনবান্ধব পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে বিরাট এক পরিবর্তন সাধিত হবে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে। আমরা পুলিশের এই যুগোপযোগী ও কার্যকর উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আশা রাখি উদ্যোগটি পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। পরিশেষে বলা যায়, সিসি ক্যামেরা বসানোর যে উদ্যোগ পুলিশ বাহিনী নিয়েছে সেটি জনসাধারণকে একটি সুস্পষ্ট ও পরিকল্পিত বার্তা প্রদান করে। অর্থাৎ পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যে যে অঘোষিত দূরত্ব রয়েছে সেটি ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। একটি উন্নত পরিবেশ তৈরি হবে, যেখানে জনসাধারণ ও পুলিশের মধ্যকার আস্থা ও বিশ^াসের জায়গায় দৃঢ়তা তৈরি হবে। সঙ্কট নিরসন হবে এবং জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা প্রদানে পুলিশ বাহিনীর প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করবে। একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উন্নত বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশ বাহিনী নবতর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা নিশ্চিতে নিরলস কাজ করে যাবে আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×