ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আলা উদ্দিন

টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে বাঙালী জাতির পিতা

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ১৫ মার্চ ২০২২

টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে বাঙালী জাতির পিতা

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ (বর্তমানে জেলা) মহকুমার অন্তর্গত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বসবাসরত শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জের দেওয়ানি আদালতে সেরেস্তাদার ছিলেন। বাবা-মা মুজিবকে ‘খোকা’ বলেই ডাকতেন। ভাইবোন ও গ্রামবাসীর কাছে তিনি ছিলেন ‘মিয়াভাই’। ত্রিশ পার হওয়ার আগেই তিনি পাকিস্তানীদের কাছে পরিণত হন অকুতোভয় সংশপ্তকে। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ভীষণ ভয় পেত। যে কারণে তাঁকে বার বার কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। তবে জেলখানায় বন্দী থাকলেও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা আর সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে পারেনি। বাঙালীর জন্য তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ পঞ্চাশ পেরনোর আগেই তাঁকে অভিহিত করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ (১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি) হিসেবে। সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দৃঢ় মনোবল এবং সর্বস্তরের বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালীকে উপহার দিলেন একটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। আর বাঙালী তাকে বরণ করে নিল জাতির পিতা হিসেবে। শেখ মুজিবের বয়স যখন ১২ বা ১৩ বছর, তখন তাঁর বিয়ে হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন- ‘আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তাঁর স্ত্রীর নাম ফজিলাতুন নেসা (রেণু); তাঁর বয়স ছিল তিন বছর। তাঁরা পরস্পর আত্মীয় ছিলেন। তাঁদের মোট পাঁচ সন্তান। বড় সন্তান শেখ হাসিনা, তার পরের জন শেখ কামাল, তারপর শেখ রেহানা, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে তাঁর সারা জীবনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, মানুষের চাওয়া-পাওয়া ও আকাক্সক্ষার আদলে সাজাতে সম্পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ষড়যন্ত্রে তিনি বিপথগামী সৈনিকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। তাঁর দুই কন্যা, তারা তখন জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন, প্রাণে বেঁচে যান। বড় কন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তবে তাঁর পিতার ন্যায় এই সংগ্রামে তিনিও অনেকটা একা। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করেছে। অথচ বঙ্গবন্ধু তাঁর সারাটা জীবন বাঙালী জাতির জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। তাঁর ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় ১৩ বছর তিনি ছিলেন কারাবন্দী। কারাগারে থেকেও তিনি দেশের জন্য সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। তিনি তার প্রথম দুই সন্তানের জন্মের সময় উপস্থিত থাকতে পারেননি। বড় কন্যার জন্মের সময় (২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭) তিনি কলকাতায় ব্যস্ত ছিলেন পড়াশোনা ও রাজনীতি নিয়ে। নবজাত কন্যাকে দেখতে এসেছিলেন অনেকদিন পর। দ্বিতীয় পুত্র সন্তানের জন্মের সময় (৫ আগস্ট ১৯৪৯) তিনি টানা দুই বছর ছিলেন জেলে। এ প্রসঙ্গে তাঁর বড় কন্যা শেখ হাসিনার একটি আবেগঘন স্মৃতির উল্লেখ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক: ১৯৫২ সালের শুরুর দিকে আব্বাকে (বঙ্গবন্ধুকে) একবার গোপালগঞ্জ কারাগারে দেখতে গিয়েছিলাম। আমি যখন বার বার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, কামাল শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানার পুকুরের পাশে বড় খেলার মাঠ, হঠাৎ কামাল আমাকে জিজ্ঞেস করল ‘হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি’ (শেখ হাসিনা, ২০২১, পৃ. ৩০)। যিনি তাঁর নিজের জীবনকে জাতির জন্য উৎসর্গ করেছেন, তাঁর পরিবার অপেক্ষা বেশি প্রাধান্য দিতেন, তাঁকেই কিনা সপরিবারে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হলো তাঁর অধীনস্থ সেনাকর্মীদের হাতে। ইতিহাসে এমন নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা বিরল। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালে হত্যা করা হয়েছে সত্য। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা এতটুকুও কমেনি। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল না সেই সময়েও বাঙালীর হৃদয়ে তাঁর স্থান অক্ষুণœ ছিল। যে কারণে ২০০৪ সালের বিবিসি জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই জরিপে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিতীয় ও কাজী নজরুল ইসলাম তৃতীয় হয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি বাঙালী জাতিকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছেন এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এভাবে টুঙ্গিপাড়ার সেই রোগা খোকা ক্রমান্বয়ে পরিণত হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। এত গেল দেশের ভেতরে তাঁর ভালবাসা এবং ভালবাসার স্বীকৃতি। বিশ্ববাসীর কাছেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন এক অনুকরণীয় মহামানব হিসেবে। এ প্রসঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা, প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কথা উল্লেখ করা যায়- (১৯৭৩)- ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ব্রিটিশ সাংবাদিক সিরিল ডন বলেছেন- ‘তিনি এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি তার বজ্রকণ্ঠে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারতেন। তিনি একজন বিশাল মাপের মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিত্ব, ভাষা, আচার-আচরণ ও পোশাকে তিনি একজন প্রকৃত রুচিশীল বাঙালী ছিলেন। তিনি খুব বন্ধুত্বপূর্ণও বটে। এমনকি তার শত্রুদের সঙ্গেও তিনি বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। এটা ছিল তার নেতৃত্বের একটি বড় গুণ।’ ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের অনুষ্ঠানে কূটনীতিক ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বিশ্বব্যাপী মানবিক ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের জন্য বিশ্ববন্ধু হিসেবে আখ্যা দেন। ২০২০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন যেমনটি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শ বিশ্ববাসীর জন্য এবং বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য অনুকরণীয়। বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া, এবং গোটা বিশ্বের জন্য এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর এই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি তাঁর এবং তাঁর দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরবের। এই বিশাল অর্জন থেকে বোঝা যায়, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, হোক সেটা কারাবাস কিংবা পরলোক; তাঁর অবস্থান ও আবেদন বাংলাদেশ এবং বাঙালীর সীমানা ছাড়িয়ে সবার হৃদয়ে, বিশ্ব মসনদে অনুকরণীয় মানবিক ও দূরদর্শী রাজনৈতিক দৃষ্টান্তস্বরূপ। এই গৌরব বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শ (যেমন- গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমতা ও ন্যায়বিচার) বাস্তবায়নের মাঝে নিহিত। লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×