ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কে- বের হয়ে আসছে

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কে- বের হয়ে আসছে

শংকর কুমার দে ॥ ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য ইভান স্টেফানেক আবারও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক তৎপর। এই ইভান স্টেফানেক মাস দেড়েক আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বিষয়ে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনের জন্য বিদেশে যেতে অনুমতি দেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এবার তিনি দিন পনেরো আগে বাংলাদেশের র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) নিষেধাজ্ঞা দিতে চিঠি দিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্র দফতরে। একের পর এক এলিট ফোর্স র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বিদেশী রাষ্ট্র ও সংস্থার কাছে চিঠি দেয়ার নামে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে- তার আলামত স্পষ্ট হচ্ছে। রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে নাটের গুরু কে বা কারা তার ‘থলের বিড়াল বের হয়ে আসছে’ বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, একের পর এক র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বিদেশের মাটিতে ষড়যন্ত্রমূলক হয়রানির তৎপরতার আসল উদ্দেশ্য ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। গত ২০ জানুয়ারি র‌্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দিতে ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বরাবর চিঠিটি দেন ইভান স্টেফানেক। এর আগে র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক মিলে সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর জাতিসংঘে চিঠি দিয়ে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আহ্বান জানায় ১২ আর্ন্তজাতিক মানবাধিক সংস্থা। ঝিকে মেরে বৌকে শিক্ষা দেয়ার সেই প্রবাদের মতোই র‌্যাবের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক এবং সরকারকে শিক্ষা দেয়ার জন্য যে তৎপরতা শুরু হয়েছে- তা ক্রমেই খোলসা হচ্ছে। ইভান স্টেফানেক র‌্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দিতে ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বরাবর দেয়া চিঠিতে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের অমানবিক আচরণ প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনের ফল পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই পরিস্থিতি বর্তমানে খুবই মারাত্মক। কারণ, মার্কিন সরকার বর্তমান পুলিশের আইজিপি যিনি আগে র‌্যাবের প্রধান ছিলেন, তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বিশেষত, টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হককে ২০১৮ সালের মে মাসে হত্যা করার জন্য এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ম্যাগনিটাইনেজ গোবাল প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশের আরও পাঁচজন উর্ধতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সিনেট সদস্য বছরের পর বছর ধরে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলে আসছিল। দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস বলছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে, পুলিশ এবং র‌্যাবের দ্বারা ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২১ সাল পর্যন্ত এক হাজার ১৩৪টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে আমি আপনাকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য আপনার ক্ষমতা ব্যবহারের অনুরোধ করছি।’ প্রশ্ন উঠেছে, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য ইভান স্টেফানেক তার লেখা চিঠিতে বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষেই কি বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে ? যেই বাংলাদেশ এক সময়ে তলাবিহীন ঝুড়ি ছিল, সেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন, সমৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছে, যা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। আর যেই র‌্যাব জঙ্গীবাদ, মাদক, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখিয়ে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে বলে বিদেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্র, সরকারপ্রধান ও সরকারের কর্মকর্তাদেরই স্বীকৃতি অর্জন করেছে, অথচ ইভানের দেয়া চিঠিতে আর বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে কোন সাদৃশ্য তো নেইই, বরং কারও পক্ষে ভাড়াটিয়া হিসেবে যে তিনি বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, তারই প্রমাণ বহন করছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। ইভান স্টেফানেক তার চিঠিতে আরও লিখেছেন, গত ১০ ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দফতর। এরপর গত ২০ জানুয়ারি র‌্যাবকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। চিঠিতে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরায় প্রকাশিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন’ প্রসঙ্গ টেনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য লিখেছেন, আল-জাজিরা কর্তৃক প্রকাশিত ‘সবাই প্রধানমন্ত্রীর লোক’ ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল, পুলিশ, মিলিটারি এবং সন্ত্রাসীদের মধ্যে একটা গোপন চুক্তি হয়েছে। এই গোপন চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতি করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা। এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। যেখানে মাফিয়াদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সরকার দুর্নীতি করছে এবং পুলিশ সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশের জনগণ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, অবৈধ এবং অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে বসবাস করছে। বোরেলকে লেখা চিঠিতে স্টেফানেক আরও লিখেছেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশে গুম হওয়া নাগরিকদের সংখ্যা আরেকটি ভীতিকর পরিসংখ্যান। এই সংখ্যা শত শত, পাঁচশ’র বেশি। এক শ্রেণীর মানুষ কর্তৃক এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। আরও দুঃখজনক যে, গুম হওয়া মানুষদের মাঝখান থেকে অনেককেই মৃত অবস্থায় ফেরত পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ এ বিষয়ে একটি তদন্তও করেছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ইভান স্টেফানেক গুম হওয়ার বিষয়ে যে অভিযোগ করেছেন, তা তো ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার অভিযোগেরই কথা। ইভান স্টেফানেকের চিঠির সারমর্ম গুমের বিষয়টি, আর ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চিঠির বিষয়বস্তু এক হওয়ায় বোঝা যায়, দুই পক্ষকে ভাড়া করেছে বিদেশের একটি মহলই। সেই মহলটি কে বা কারা তার খোঁজ নিলে পরিষ্কার হবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদেশে কারা র‌্যাবের বিরোধিতার নামে অপতৎপরতা শুরু করেছে? বোরেলকে লেখা চিঠিতে স্টেফানেক আরও লিখেছেন, ২০২৬ সালে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির সুপারিশে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ একটা দূরদর্শী বিষয়। পরপর দুইবার ২০১৮ এবং ২০২১ সালে মাথাপিছু আয় মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে মান উত্তরণের জন্য এই স্ট্যাটাস বাংলাদেশ পাবে। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশের চেয়ে অনেকগুলো সূচকে এগিয়ে আছে। বিশেষত, দুই দশক ধরে ছয় শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। আসন্ন অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলে বাংলাদেশের আরও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের একটা বড় বাধা হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য ইভান স্টেফানেক দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতি দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন, সেই ইভান স্টেফানেক কীভাবে মানবাধিকার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন? বিদেশী মহলের কাছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে হয়রানি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান-অনুরোধ জানানোর নামে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য যে অপতৎপরতা চালাচ্ছে, ক্রমেই তার নেপথ্য কাহিনী বের হয়ে আসতে শুরু করেছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি।
×