ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

উচ্চ পর্যায়ের বার্তা নিয়ে জাফর ইকবাল দম্পতি সিলেটে আবেগঘন পরিবেশে পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙ্গালেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফান্ডে নিজের লেখার সম্মানীর ১০ হাজার টাকা দিলেন দাবি দাওয়া পূরণের আশ্বাস আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা শিক্ষার্থীদের আটক সাবেক

অবশেষে অনশন ভঙ্গ ॥ শাহজালালের ঘটনায় কিছুটা স্বস্তি

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২৭ জানুয়ারি ২০২২

অবশেষে অনশন ভঙ্গ ॥ শাহজালালের ঘটনায় কিছুটা স্বস্তি

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ইস্যুতে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। শিক্ষার্থীরা অনশন কর্মসূচী থেকে সরে আসায় ঝুঁকির মাত্রা কিছুটা কমেছে। নিজ বাসভবনে ভিসির অবরুদ্ধ অবস্থা অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলনের পরবর্তী গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভাবনা চিন্তায় রয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ সময়ের অনশনে শিক্ষার্থীরা কাহিল হয়ে পড়েছেন। কনকনে ঠা-া, সর্বত্র ওমিক্রনের বিস্তার, ক্যাম্পাসে খোলা মেলা অবস্থান স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনশনরত শিক্ষার্থীরা অবশেষে ১৬৩ ঘণ্টা পর তাদের অনশন ভেঙ্গেছেন। শাবির সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের আশ্বাসে তারা অনশন ভাঙ্গেন। তার সঙ্গে স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হকও ছিলেন। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে শাবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জুম মিটিং করেন জাফর ইকবাল। এরপর তারা সিলেটে রওনা দেন। বুধবার ভোর রাত ৩টা ৫৪ মিনিটে জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক শাবির প্রধান ফটকে পৌঁছেন। এরপর ৪টার দিকে তারা যান অনশনস্থলে। সেখানে আন্দোলনরতদের সঙ্গে কথা বলেন জাফর ইকবাল। অনশনকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা জানো না, কত বড় আন্দোলন তোমরা করেছ। এখন সব বিশ্ববিদ্যালয় কাঁপছে। তোমরা যেটা চেয়েছ, সেটা পাবে। এটা তোমাদের ক্যাম্পাস। তোমরা যেভাবে সাজাতে চাও, এই ক্যাম্পাস সেভাবে সাজানো হবে। কিন্তু এখন অনশন ভাংতে হবে। তোমাদের আন্দোলনের কারণে ৩৪ জন ভাইস চ্যান্সেলরের ঘুম নেই। তোমরা অনশন না ভাংলে আমিও যাব না। এখানেই থাকব। তোমাদের না খাইয়ে আমি যাব না’। শিক্ষার্থীরা পুলিশের মামলার কথা বললে জাফর ইকবাল বলেন, ‘চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আশ্বাস দিচ্ছি, মামলা প্রত্যাহার করা হবে’। তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর একটা স্মারকগ্রন্থের জন্য আমার কাছে লেখা চাওয়া হয়েছিল। সেই লেখাটার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাকে ১০ হাজার টাকা সম্মানী দেয়া হয়েছে। আমি এই সম্মানীর টাকাটা নিয়ে এসেছি। এই আন্দোলনের ফান্ডে টাকাটা দিচ্ছি। তোমরা রাখো। এবার পারলে আমাকে এ্যারেস্ট করুক’। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দেন জাফর ইকবাল। এদিকে ঢাকা থেকে আটক শাবির সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীকে জামিন দিয়েছেন আদালত। স্যারকে জড়িয়ে ধরে কান্না ॥ প্রিয় স্যারের আশ্বাসে শেষ রাতেই অনশন ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও অনশনরতদের বেশিরভাগ হাসপাতালে থাকায় অনশন ভাঙ্গার সময় গড়ায় সকাল পর্যন্ত। ঘড়িতে তখন সকাল সোয়া ১০টা। কুয়াশায় আচ্ছন্ন ক্যাম্পাসে তখন ভিন্নধরনের সুর। রাত থেকে ‘প্রিয় স্যার’ ও তার স্ত্রীর কোমল আবদার, অন্যদিকে একরকম পরাজয়ের গ্লানি- সবমিলিয়ে কঠিন এক পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখে ছিল হতাশার ছাপ। অনেকের চোখে ছিল পানি। ঠিক এই সময় নিজেদের ধরে রাখতে পারলেন না তারা। ‘প্রিয় স্যারকে’ জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন অনেকক্ষণ। কান্নার ধাক্কায় এ সময় তাদের কথা আটকাচ্ছিল গলায়। পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারছিলেন না চাপা কষ্টগুলো। অবশেষে ১০টা ২০ মিনিটের সময় পরম স্নেহের পরশে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে পানি তুলে দিলেন সেই ‘প্রিয় স্যার’। ১৬৩ ঘণ্টা পর ‘আমরণ অনশন’ ভেঙ্গেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ শিক্ষার্থী। আন্দোলনের ১৩ তম ও অনশনের ৮ম দিনে বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটের সময় বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙ্গান। তবে অনশন ভাংলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা ওই সময়। ঘটনার তথ্য ও ভিডিও চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ॥ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ জানুয়ারি বিকেলে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষে আহত হন অর্ধশতাধিক। এ ঘটনায় পরদিন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি এখন ঘটনার তথ্য ও ভিডিও চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বুধবার একটি স্থানীয় পত্রিকায় তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক শাবির স্কুল অব ফিজিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোঃ রাশেদ তালুকদার ‘গণবিজ্ঞপ্তি’ শীর্ষক এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শাবিতে গত ১৬ জানুয়ারি সংঘটিত ঘটনার সুষ্ঠু ও যথাযথ তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট গঠিত তদন্ত কমিটি প্রত্যক্ষদর্শীদের নিকট থেকে প্রকৃত তথ্য ও প্রমাণাদি সংগ্রহের উদ্দেশে সকল মহলের সহযোগিতা কামনা করছে। ১৬ জানুয়ারি সংঘটিত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য এবং ভিডিওক্লিপ আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে ডিন, ফিজিক্যাল সায়েন্সেসের অফিস কক্ষের সামনে রক্ষিত বাক্সে জমা দেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। বক্তব্য অথবা তথ্যসমূহ ইমেইলে প্রেরণ করা যাবে। এক্ষেত্রে তথ্য প্রদানকারীর বক্তব্য পিডিএফ করে বর্ণিত ইমেইলে প্রেরণ করতে হবে। চলমান আন্দোলন এখনই থামছে না ॥ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিবিরোধী চলমান আন্দোলন এখনই থামছে না। এই আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে শাবির অনশনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙ্গান অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম অপূর্ব সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন যে, আমাদের অনশন ভাঙ্গার প্রক্রিয়াটা আসলে শুরু হয়েছে কিভাবে। আমাদের শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যার ও ইয়াসমিন হক বুধবার ভোর রাতে এসেছেন। তারা আমাদের বিশ্বাস ও আশ্বাস দুটোই দিয়েছেন যে, তাদের কাছে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এসেছিলেন এবং বলেছেন যে, আমাদের যে দাবিদাওয়া আছে তা পূরণ করে দেয়া হবে। উনারা আমাদের কাছে অসম্ভব শ্রদ্ধার মানুষ। আমরা তাদের কথায় অসম্ভব বিশ্বাস করি। এবং তাদের কথাতেই আমরা বিশ্বাস করে অনশন ভেঙ্গেছি।’ অপূর্ব বলেন, ‘আন্দোলনটা তো ভিসির পদত্যাগ পর্যন্ত চলার কথা, আমরা আগেই বলেছি। আমরা আপাতত অনশন কার্যক্রম বন্ধ করে রাখছি। এ ছাড়া আমাদের আন্দোলন কার্যক্রম চলবে। আমরা হয়তো বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাব। এটা অবস্থান কর্মসূচী হতে পারে, মশাল মিছিল হতে পারে। পরবর্তীতে আমরা আলোচনার মাধ্যমে এটা জানিয়ে দেব।’ ‘উচ্চ পর্যায়ের বার্তা’ পেয়েই জাফর ইকবাল শাবিতে ॥ জাফর ইকবাল জানিয়েছেন, সরকারের ‘উচ্চ পর্যায়ের বার্তা’ পেয়েই তারা শাবিতে এসেছেন। ‘উচ্চ পর্যায়’ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের সব দাবিদাওয়া ‘পূরণ করা হবে’। গত ১৩ জানুয়ারি রাতে শাবিতে ছোট্ট ঘটনায় আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে সেই আন্দোলন উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯ জানুয়ারি থেকে অনশন শুরু করেন ২৪ শিক্ষার্থী। শিক্ষামন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, শিক্ষকবৃন্দ সবাই চেষ্টা করেও শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙ্গাতে পারেননি। অবশেষে বুধবার প্রায় ১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভেঙ্গেছেন শিক্ষার্থীরা। শাবির সাবেক দুই শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হকের চেষ্টায় তারা অনশন ভাঙ্গেন। সকালে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙ্গার পর তারা দুজনেই শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি পারমিশন ছাড়া ঢুকে গেছি। কাজেই আমি টেকনিক্যালি স্পিকিং, আমি বহিরাগত।’ তখন এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার, ক্যাম্পাসটা আমাদের স্যার। প্রশাসনের না। ডিসিশন আমাদের হবে।’ জাফর ইকবাল বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের! এ সময় ইয়াসমনি হক বলেন, ‘(অনশনকারীদের জন্য) একেকটা ঘণ্টা ম্যাটার করে। ভেবেছিলাম, আজকে সকালে আসব। কিন্তু তোমরা যারা বসা ছিলে জুম মিটিংয়ে, বলেছিলে আজকেই রওয়ানা হোন। মঙ্গলবার রাত ৮টা বাজে প্রায় তখন। আমরা তখনই ডিসাইড করে রাতে রওয়ানা হয়ে গেছি। এরপর জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি, কারণ আমাকে একদম উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, তোমাদের দাবিদাওয়া পূরণ করা হবে। আমি সেজন্যই এসেছি।’ শিক্ষার্থীরা তখন হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে, তোমাদের সকল দাবিদাওয়া লিখে উনাদের পৌঁছে দিতে। তখন শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘স্যার, আমাদের দাবি একটাই ভিসির পদত্যাগ। জাফর ইকবাল বলেন, ‘শুধু একটা দাবি না, আরও দাবি আছে। এসময় এক মেয়ে শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার, এমন মানুষের কাছে আমাদের কুক্ষিগত করে রাখবেন না, যে কথায় কথায় আমাদের ওপর গুলি চালাবে। জাফর ইকবাল তখন খানিকটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘তোমরা কেন কুক্ষিগত হয়ে থাকবে? বুঝাও আমাকে? তোমাকে কে বলছে? ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই ক্যাম্পাসে কোন স্বাধীনতা নাই, স্যার।’ এ পর্যায়ে জাফর ইকবাল বলেন, ‘স্বাধীনতা নাই মানে কী? তোমরা যদি বলো স্বাধীনতা আছে, তাহলে স্বাধীনতা আছে। এটা তোমাদের ক্যাম্পাস।’ তখন এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার, আবার যে ওয়াটার ট্যাঙ্ক, রায়ট (কার) আসবে না, এটার নিশ্চয়তা নাই স্যার।’ জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, ‘না, আসবে হয়তো। তোমরা ঠেকাবে আরেকবার, যেভাবে ঠেকাইছো। সারা বাংলাদেশের সমস্ত তরুণ প্রজন্ম তোমাদের পেছনে। সমস্ত মানুষজন তোমাদের পেছনে। তোমরা সুস্থ হও। উদাহরণ তৈরি করো। যে উদাহরণ বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে উদাহরণ অনুসরণ করবে।’ এ পর্যায়ে অধ্যাপক ইয়াসমিন হক বলেন, ‘আমাদের যদি ওপরের মহল থেকে একদম আশ্বাস দেয়া না হতো যে, তোমাদের সব দাবিদাওয়া মেনে নেয়া হবে, আমরা কী আসি?’ অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমরা কোন মুখে আসতাম? তৎক্ষণাৎ ইয়াসমিন হক বলেন, ‘না, আসতাম! এসে বলতাম, নিজে নিজে এসে গেছি ! তাই না?’ পরে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব যে, তোমরা অনশন ভেঙ্গেছ। এখন তোমাদের হাসপাতালে যেতে হবে, তোমাদের রিকভার করতে হবে। এরপর ইয়াসমিন হক জানান, গত ১৬ জানুয়ারি পুলিশ শিক্ষার্থী- সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০০ শিক্ষার্থীর রিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে এবং শাবির সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, তা ‘ড্রপ করা হবে’ বলে ‘ওপর মহল থেকে জানানো হয়েছে’। তখন শিক্ষার্থীরা হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। পরে জাফর ইকবাল বলেন, ‘তোমরা নিজেরা নেতৃত্ব দিয়েছ, এতো সুন্দর একটা আন্দোলন করেছ, সারাদেশের মধ্যে উদাহরণ তৈরি করেছ।’ সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি জাফর ইকবাল দম্পতি ॥ ইয়াসমিন হক বলেন, ‘এদের অনশনে একেক ঘণ্টা এদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খুবই ভাল লাগছে, ওরা (শিক্ষার্থী) কথাটা শুনেছে, আমাদের কথাটা রেখেছে। এতজন, ২৭ জন আমার মনে হয় আজকে ছিল, এরা অনশন ভেঙ্গেছে। আমাদের জন্য এটা সবচেয়ে বড় পাওনা। আমরা তো এখন নাই এখানটায় (শাবিতে), তিন বছর, প্রায় আড়াই-তিন বছর হতে চলল আমরা নাই এখানে।’ তিনি বলেন, ‘আমি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। স্যারও বলেছেন, থ্যাঙ্ক ইউ। আসলে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারব না।’ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে ‘দানব’ বলেছেন। সেই ‘দানবের’ কাছে আপনারা শিক্ষার্থীদের রেখে যাচ্ছেন। এই বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়াসমিন হক বলেন, ‘না, না, এটা তো আমাদের ডিসিশন না...’। তার কথা কেড়ে নিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘শোনেন, ছাত্রদের আন্ডারএস্টিমেট করবেন না। কে, কাকে, কার কাছে রেখে যাচ্ছি, সেটা সময়েই বলে দেবে। পরে ভিসির পদত্যাগ বা অপসারণ সংক্রান্ত দাবির প্রসঙ্গে আরেক প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি যখন বলেছি যে, তারা (সরকার) দাবিদাওয়া মেনে নেবেন বলেছেন, তখন দাবির মধ্যে এই দাবিটাও তো পড়ে। কিন্তু সরকারেরও তো নিজস্ব টেকনিক্যাল ব্যাপার থাকে, রাজনৈতিক ব্যাপার থাকে, সেটার জন্য তাদের হয়তো একটা প্রসেস থাকে। গোপালগঞ্জের ভাইস চ্যান্সেলরকে তারা একভাবে সরিয়েছে, অন্য ভাইস চ্যান্সেলরকে অন্যভাবে সরিয়েছে। কাজেই সেটা তাদের ব্যাপার। আমার প্রাইমারি কনসার্ন ছিল, ওদের অনশন থেকে বের করতে পারি কিনা।’ এ সময় ইয়াসমিন হক বলেন, ‘আমার মনে হয়, যা যা হয়েছে, আমরা এটা দেখি, ওয়াচ করি।’ আন্দোলনে বহিরাগতদের কোন ইন্ধন ছিল বা আছে কিনা, এরকম এক প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি এই ছেলেদের দেখে মুগ্ধ। ওরা যত সুন্দরভাবে ম্যানেজ করেছে..এই ধরনের একটা আন্দোলন, যেটা হয়েছে, আমাদের দেশের কোন রাজনৈতিক দল এরকম একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। যেখানে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা প্রায় তরুণ-তরুণী হার্ট দিয়ে যেটা অনুভব করবে। এই আন্দোলন যখন হয়, তখন সেই ফায়দা নেয়ার জন্য সবসময় অন্যরা ভেতরে ঢুকে লিডারশিপটা নেয়ার চেষ্টা করে। এরা কিন্তু সেটা করতে দেয় নাই। আমি দেখেছি যে, এরা সাধারণ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে কোন উচ্চভিলাষ নাই। পুলিশ ওদের গায়ে এরকম নির্মমভাবে হাত তুলেছে, কাজেই ওদের মনের ভেতর একটা ক্ষোভ হয়েছে, সংঘত কারণেই। সেজন্যই তারা এই আন্দোলনটা করছে। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ি নাই, অহেতুক কোন দাবি নাই। ওদের দাবি শতভাগ যৌক্তিক দাবি।’ ইয়াসমিন হক বলেন, ‘বহিরাগত যেটা বলছেন, এইগুলা সব হলো, এখানে আসার পর এক ছাত্রী বললো, স্যার, ম্যাডাম, এটা আমাদের তিন বছরের ক্ষোভ। সব এখন বের হয়ে আসছে।’ জাফর ইকবাল যোগ করেন, ‘আমি তিন বছর আগে যখন নাকি অবসরে চলে যাই, তখন একটা চিঠি লিখে উনাকে (ভিসি) দিয়ে যাই। সেই চিঠিতে আমি বলে দিয়েছিলাম অনেকগুলি। আমি সেখানে লিখেছিলাম স্পষ্ট করে, আপনি যদি এগুলো না করেন, ছাত্রদের এখন যে ক্ষোভ আছে, তা বিক্ষোভে রূপ নেবে। একদম অক্ষরে অক্ষরে আমার কথাটা ফলেছে।’ পুলিশী হামলার সময় শিক্ষকদের নিরব থাকা ও প্রতিবাদ না করা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক....যখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে, তখন টিচারদের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিল যে, খবরদার! তোমরা এটা করতে পারবা না। একজন টিচারও সেটা করেননি।’ ‘একজন শিক্ষকের এরকম মেরুদ-হীন হওয়ার কোন কারণ নাই’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। পুলিশী হামলার ঘটনায় ইয়াসমিন হক ‘একদম শকড’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, কখন এটা কাটিয়ে উঠব।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে টং দোকান, রোড পেইন্টিং, নাটক, কনসার্ট বন্ধ বলে অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। তারা এটাকে ‘মুক্তবুদ্ধির চর্চা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে’ বলে অভিহিত করে এটাকে ‘তালেবানি সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে জাফর ইকবাল দম্পতি কী ভাবছেন? এমন প্রশ্নে জাফর ইকবাল বলেন, ‘এটা তো অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার যে, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কাজগুলো (বন্ধ) হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রেংথ ছিল, আমাদের এমন কোন সংগঠন নাই যেটা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না। কার্টুন আঁকার সংগঠন থেকে শুরু করে, সায়েন্সের, নাটকের, ফটোগ্রাফি থেকে শুরু করে এমন কোন সংগঠন নাই, যেটা ছিল না।’ তিনি যোগ করেন, ‘সেটা যখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তখনই বোঝা গেছে, এই মানুষটা (ভিসি) আর যাই হোক, উনি একাডেমি বুঝেন না।’ পেছনের ঘটনা ॥ শাবির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের অসদাচরণের প্রতিবাদে গত ১৩ জানুয়ারি রাতে ওই হলের ছাত্রীদের মাধ্যমে সূচিত হয় আন্দোলন। গত ১৫ জানুয়ারি আন্দোলনরতদের ওপর ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। এতে নতুন মাত্রা পায় আন্দোলন। হলের প্রভোস্টের অপসারণ, অব্যবস্থপনা দূর, ছাত্রলীগের হামলার বিচার চেয়ে পরদিন (১৬ জানুয়ারি) সকল শিক্ষার্থী আন্দোলনে শামিল হন। সেদিন উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। তাকে মুক্ত করতে গেলে পুলিশকে বাধা দেন শিক্ষার্থীরা। এতে উভয়পক্ষের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আহত হন। এদিকে, গত ১৬ জানুয়ারির পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষের ঘটনায় দুই থেকে তিন শ’ অজ্ঞাত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পরদিন (১৭ জানুয়ারি) রাতে মামলা করে পুলিশ। মামলার এজাহারে পুলিশ লিখেছে, সেদিন শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর গুলিও ছুড়েছিল। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) উত্তপ্ত ছিল শাবি ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের অপসারণ, প্রক্টর ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন ধরনের স্লোগানে মুখর ছিল ক্যাম্পাস। এ সময় কিছুসংখ্যক পুলিশ সদস্যকে সতর্ক অবস্থানে দেখা যায়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে যান আওয়ামী লীগ নেতারা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেলের সাথে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আশফাক আহমদ, মহানগরের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক বিধান কুমার সাহা ও সিসিক কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান। ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আটক সাবেক ৫ শিক্ষার্থীর জামিন ॥ ঢাকা থেকে আটক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীর জামিন দিয়েছেন আদালত। বুধবার সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক সুমন ভূঁইয়া তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে আসামিদের আদালতে নিয়ে আসা হয়। পরে বিচারকের খাস কামরায় তাদের জামিন শুনানি হয়। শুনানির পর বিচারক তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন পাওয়া পাঁচজন সাবেক শিক্ষার্থী হলেন- টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর দারিপাকা গ্রামের মতিয়ার রহমান খানের ছেলে হাবিবুর রহমান খান (২৬), বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানার লক্ষ্মীকোলা গ্রামের মুইন উদ্দিনের ছেলে রেজা নুর মুইন (৩১), খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গা ১২৫/১১ ছাত্তার বিশ্বাস রোডের মিজানুর রহমানের ছেলে এএফএম নাজমুল সাকিব (৩২), ঢাকা মিরপুর মাজার রোডের জব্বার হাউসিং বি-ব্লকের ১৭/৩ বাসার একেএম মোশাররফের ছেলে একেএম মারুফ হোসেন (২৭) এবং কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার নিয়ামতপুর গ্রামের সাদিকুল ইসলামের ছেলে ফয়সল আহমেদ (২৭)। এর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাদের আটক করে। পরে তাদের এসএমপি সিলেট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগের ২৫ জানুয়ারি রাতে সিলেট মহানগরীর জালালাবাদ থানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে তাদের বিরুদ্ধে মামলা (নং-১১(০১) ’২২) দায়ের করা হয়। শাবির উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে রাষ্ট্রপতিকে খোলা চিঠি ॥ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্যের পদত্যাগসহ ৫ দফা দাবিতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদকে খোলা চিঠি দিয়েছে প্রগতিশীল শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।’ বুধবার এই চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে সই করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ জন শিক্ষক। তাদের অন্য দাবিগুলো হলো- ক্যাম্পাসে পুলিশী হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করা, আন্দোলনে অর্থায়নের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সাবেক শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করা এবং আন্দোলনকারীদের পরিবারের ওপর পুলিশী হয়রানি বন্ধ করা।-ওয়েবসাইট
×