রহিম শেখ ॥ দেশে গত বছর যে পরিমাণ কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়েছে তার মধ্যে রফতানি ও স্থানীয় ব্যবহার মিলিয়ে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি পাট অব্যবহৃত অবস্থায় মজুদদারদের গুদামে রয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এক হাজার মণের বেশি কাঁচা পাট এক মাসের বেশি সময় ধরে মজুদ করা যাবে না। কিন্তু দেশের অন্তত ১২ জেলায় মজুদ রয়েছে বিপুল পরিমাণে কাঁচা পাট। অবৈধ মজুদদাররা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে পাটের মূল্য বাড়াচ্ছে। ফলে কাঁচা পাটের দর বেশি হওয়ায় মিল মালিকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকেই উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হওয়ার পথে। অবৈধ মজুদদারির বিরুদ্ধে পাট অধিদফতরের মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথা থাকলেও তা শুধু কাগজকলমেই। অন্যদিকে বিদেশী ক্রেতারা নির্ধারিত মূল্যে পাটপণ্য না পেয়ে বিকল্প পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। এতে আন্তর্জাতিক পাটপণ্যের বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ। এই অবস্থায় অবৈধ কাঁচা পাট মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আগামী রবিবার পাটমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেবে বাংলাদেশ জুট মিলস এ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ), বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) ও বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ)।
পাট অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৯০ লাখ ৯১ হাজার বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়েছে। তার আগের বছর পাট উৎপাদিত হয়েছিল ৮৪ লাখ ৫৫ হাজার বেল। বেসরকারী পাটকলগুলোর জন্য বছরে ৬৫ লাখ বেল কাঁচা পাট প্রয়োজন। আর গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য দরকার পাঁচ লাখ বেল। সরকারী পাটকলগুলো বন্ধ থাকায় দেড় বছর ধরে সার্বিকভাবে কাঁচা পাটের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কিছুটা কমেছে। গত বছর আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে কাঁচা পাটের মণপ্রতি দাম সাত হাজার টাকা ছুঁয়েছিল। তা নিয়ে পাটকল মালিকরা সোচ্চার হলে ধীরে ধীরে দাম কমে। গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া চলতি মৌসুমে কাঁচা পাটের দাম ছিল আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা মণ। পাট অধিদফতরের দেয়া কাঁচা পাট উৎপাদনের তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে কেন দাম বাড়ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বিজেএসএর পরিচালক মোঃ জাহিদ মিয়া বলেন, লাইসেন্স না থাকলে কাঁচা পাটের ব্যবসা করা যায় না। কিন্তু পাট ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, এমন মানুষজনও অতিমুনাফার লোভে কাঁচা পাট কিনে মজুদ করেছেন। পাট অধিদফতর আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে কাঁচা পাটের অবৈধ মজুদদারি বন্ধ হতো। অধিদফতর অভিযান পরিচালনা করলেও সেটি অনেকটাই কাগজে-কলমে বলে অভিযোগ করেন তিনি। পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির ৬০ শতাংশই হচ্ছে পাটের সুতা, যা দিয়ে কার্পেট তৈরি করা হয়। একাধিক পাটকল মালিক জানান, কাঁচা পাটের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় বিদেশী ক্রেতারা ঝুট কাপড়, তুলা ও পিপি সুতার দিকে ঝুঁকছেন। তাই কাঁচা পাটের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পাটের সুতার বিকল্প পণ্যগুলোই স্থায়ীভাবে জায়গা দখল করবে।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, লাইসেন্স না থাকলে কাঁচা পাটের ব্যবসা করা যায় না। একই সঙ্গে এক হাজার মণের বেশি কাঁচা পাট এক মাসের বেশি সময় ধরে মজুদ করার নিয়ম নেই। অথচ দেশের অন্তত ১২ জেলায় বিপুল পরিমাণে কাঁচা পাট মজুদ রয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে-ফরিদপুর, পাবনা, টাঙ্গাইল, নাটোর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মাগুরা, রংপুর, ময়মনসিংহ, লালমনিরহাট, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদাহ। মূলত পাট ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, এমন মানুষজনও অতিমুনাফার লোভে কাঁচা পাট কিনে মজুদ করেছেন। পাট অধিদফতর অভিযান পরিচালনা করলেও সেটি অনেকটাই কাগজে-কলমে বলে অভিযোগ রয়েছে। কাঁচা পাটের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবারও বিপাকে পড়েছেন পাটকল মালিকরা। তারা বলছেন, ‘দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তাই পূর্ণ উৎপাদনক্ষমতায় কারখানা চালাচ্ছেন না। কেউ কেউ উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। কাঁচা পাট নিয়ে গতবারের অরাজকতার জন্য অনেক বিদেশী ক্রেতা হারিয়েছি। চলতি বছরও সেটির পুনরাবৃত্তি হলে পাটকলগুলো রুগ্ন শিল্পে পরিণত হবে। মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতিতে পাটকলমালিকদের তিন সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস এ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) এবং বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) নেতারা গত সপ্তাহে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তারা প্রতিমণ উচ্চমানের পাট সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা ও নি¤œমানের পাট ২ হাজার ৫০০ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত নেন। যা বৃহস্পতিবার থেকে দাম কার্যকর করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বাজারে পাটের দুষ্প্রাপ্যতা ও উচ্চমূল্য নিয়ে অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই সভায় সদস্যরা বলেন, এভাবে পাটের মূল্য বাড়লে দেশের পাটশিল্প ধ্বংসের প্রান্তে চলে যাবে। মিল মালিকরা যে দরে পাটজাত পণ্য বিক্রি করার জন্য বিক্রয় আদেশ পান, কাঁচা পাটের দর অনেক বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ তার চেয়ে বেশি পড়ে যায়। ফলে মিল মালিকরা বিক্রীত মাল সরবরাহ করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছেন। সদস্যরা বলেন, এক শ্রেণীর অবৈধ মজুদদার কাঁচা পাটের ব্যবসায়ী বেআইনীভাবে কাঁচা পাট মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে পাটের মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। অবৈধ কাঁচা পাট মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আগামী রবিবার পাটমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, গত বছর দেশে পাটের যে উৎপাদন হয়েছে তাতে ৬০-৭০ শতাংশ কাঁচাপাট এখনও উদ্বৃত্ত রয়েছে। নিয়মানুযায়ী, ১ হাজার মনের বেশি পাট মজুদের সুযোগ নেই। কিন্তু কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে এক শ্রেণীর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে কাঁচা পাটের মজুদ গড়ে পাটের মূল্য বাড়াচ্ছে। ফলে কাঁচা পাটের দর বেশি হওয়ায় মিল মালিকেরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকেই উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছেন। এতে কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বিদেশী ক্রেতারা নির্ধারিত মূল্যে পাটপণ্য না পেয়ে বিকল্প পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে পাট অধিদফতরের নিয়মিত অভিযান করার নির্দেশনা থাকলেও আমরা সেটি দেখতে পাই না। আমাদের একটা নীতিমালা থাকা উচিত কিংবা ভারতের মতো একটা পাট কমিশন তৈরি করা দরকার। যাতে এ খাতে নৈরাজ্য বন্ধে কমিশন বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের উচিত যারা কাঁচা পাট মজুদ করবেন তাদের সবাইকে কর শনাক্তকরণ নাম্বার নিতে বাধ্য করা। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে একই সঙ্গে করের আওতায় আসবে পাটখাত সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ) সাবেক চেয়ারম্যান ও শিপার্স কাউন্সিল অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোঃ রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের হিসেবে এখনও ৩৫ থেকে ৪০ লাখ বেল কাঁচা পাট মজুদ রয়েছে। সরকারের আইন অনুযায়ী ১ হাজার মনের বেশি কেউ কাঁচা পাট মজুদ করতে পারে না। সে হিসেবে কৃষকের কাছে এত পাট থাকার সুযোগ নেই। অবৈধভাবে এসব পাট মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা মজুদ করে রেখেছেন। এসব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে অচিরেই অনেক মিল বন্ধ হয়ে যাবে। একই সঙ্গে রফতানি কার্যক্রম ব্যহত হবে। এই অবস্থায় অবৈধ মজুদদারির বিরুদ্ধে পাট অধিদফতরের মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরী বলে তিনি মনে করেন।
কাঁচা পাটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বহুমুখী পাটপণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিপদে পড়েছে। ক্রিয়েশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ রাশেদুল করিম বলেন, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ব্যবসাও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তবে কাঁচা পাটের দাম উর্ধমুখী থাকায় ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে। গতবার মুনাফা করা যায়নি। তিনি আরও বলেন, এবারে দেশে পাটের ভাল ফলন হয়েছে। মণপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়েছে দুই হাজার টাকার মতো। তারপরও দাম কেন সাড়ে তিন হাজারে যাবে? বাংলাদেশের জুট গুডস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ইসরাত জাহান চৌধুরী বলেন, ‘পাটের বেশি দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের প্রোডাক্টের দাম বাড়াতে হয়েছে, কিন্তু রফতানি ভলিউম বাড়েনি। ফলে তারা সুইচ করে অন্য প্রোডাক্টে চলে যাচ্ছে। দামটা এরকম ওঠানামা করলে ভালর চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে।’ তিনি বলেন, পাটের দাম একটি স্থিতাবস্থায় বেঁধে দেয়া সম্ভব হলে কৃষক ও ব্যবসায়ী- উভয়েই লাভবান হবে।
জানা যায়, বাংলাদেশে পাট দিয়ে পাট সুতা, দড়ি, বস্তা, প্যাকিং সরঞ্জাম, ব্যাগ বা থলে, হাতে বাছাই করা আঁশ, পাটজাত কাপড় বহুদিন ধরে তৈরি হয়। এখন সেই সঙ্গে পাটের তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্যের রফতানিও বেড়েছে। পাটের তৈরি টব, খেলনা, জুট ডেনিম, জুয়েলারি, ম্যাটস, নারী-পুরুষের জুতা স্যান্ডেল, বাস্কেট, পাটের শাড়ি, পাঞ্জাবি ও পাটের তৈরি গৃহস্থালি নানা সরঞ্জামের বিদেশে চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রধানত আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোয় এই জাতীয় পণ্য রফতানি করা হয়। আফ্রিকান দেশগুলো বস্তা ও পাটজাত দড়ি বেশি রফতানি হয়। পাটের আঁশের পাশাপাশি পাটখড়িরও একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে বলে তিনি জানান। এসব পণ্য দিয়ে পার্টিকেল বোর্ড, কম্পোজিট, সেলুলয়েডে ব্যবহার হয়।