ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অস্তিত্ব¡ ও মোহের অলক্ষিত রসায়ন

প্রকাশিত: ২২:১৮, ২১ জানুয়ারি ২০২২

অস্তিত্ব¡ ও মোহের অলক্ষিত রসায়ন

‘অগ্নিকা আঁধার’ প্রেম এবং তার অপরাজেয় আকুতি নয়, বরং প্রতিষ্ঠার অভিঘাতে অনৈতিক সম্পর্কের বিষণ্ণ করুণ রূপরেখায় এই উপন্যাসের উৎসজাত হলেও ইতিহাস ঐতিহ্য আন্দোলন সংগ্রামের তাৎপর্যময় কথকতাও উঠে এসেছে প্রসঙ্গত। অগ্নিকা আঁধার’ সৃষ্টিতে রকিবুল হাসানের যতটা যা অভিঘাত, অনেকটাই তাঁর বাস্তবলব্ধ অভিজ্ঞতার অভিক্ষেপ। আঁধারেও যে বহ্নি জ্বলে, দ্রোহের অনল জ্বলে-তা এই ঔপন্যাসপাঠে আলাদা অনুভবের মাত্রা-গন্ধ-ইঙ্গিতই বলে দেয়। বেশিরভাগ বেসরকারী শিক্ষাঙ্গন-শিক্ষাকে পুঁজি করে উচ্চমাত্রার রুজি যোগাড় করা নিয়ে ব্যস্ত। বৈশ্বিক চলমান লাভজনক বিষয়ই তাদের কাছে গুরুত্ববহন করে। কারণ নিশ্চয়, তাঁদের পরিবারে হয়ত কেউ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করেনি, ভাষা আন্দোলনে যায়নি-এমনকি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেও অংশ নেয়নি! ভাবটা এদের অনেকটাই এ রকম। বেসরকারী শিক্ষাঙ্গনে বাংলা বিভাগ চালু এবং তা সক্রিয় রেখে সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস চর্চা করে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেলে এদের কি লাভ! উপন্যাসের পাঁচ পর্বের দুই-তিনটি চরিত্র বাদে প্রায় প্রত্যেক চরিত্রের মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। শুধু তৃতীয় আখ্যানের ‘নষ্টরাজের ফাঁদ’র পর্বে আলোকবর্তিকা হয়ে অনিন্দ অর্ঘ্য শুধু বাংলা বিভাগই নয় পুরো বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি সুনাম বয়ে আনতে থাকে। দেশী-বিদেশী আলোচকদের প্রবন্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে সুমান বয়ে আনে; বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারের খবর চার দিকে চাউর হয়ে যায়। গুণীদের পুরস্কার দেয়া হয়। একেবারে আমূল বদল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ড. ফারজানার পর, ড. এলিনা রহমানের সঙ্গে সিসি করিমের অশুভ পাঁয়তারাও কোন কাজে আসেনি। চতুর্থপর্বে ‘বিধায়কের বিধান’ আশালতার বীজ প্রস্ফুটিত। অনিন্দ অর্ঘ্যও পশ্চিমবাংলার খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজে সেমিনারে যোগ দিয়ে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ধরে রাখে। সেখানকার অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা চক্রবর্তীর সঙ্গে কথোপকথনে দুই বাংলার শিল্পসাহিত্যের বহুমাত্রিক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। দেশভাগ, পদ্মা-গঙ্গা, ফারাক্কা, তিস্তার জল নিয়েও স্ব-স্ব দেশের পক্ষে কথা বলেছেন। এই পর্বের শেষে দেখা যায় আবারও আলোর আঁধার। নষ্টদের দখলে থাকা ভিন্ন চরিত্রের নষ্টদের আবির্ভাবে নতুন চরিত্রহীন ভিসি, সিসি এসেই অনিন্দ অর্ঘ্যরে বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করে সরিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করে। কখনও চরিত্রের আত্মকথন, কখনও স্বগতোক্তির ভেতর দৃশ্যগুলো, মুহূর্তগুলো পাঠক পাঠান্তে কখন যেন চেনা মানুষকেই সেখানে আবিষ্কার করবেন। গল্পের ভেতরে ইতিহাস, অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কথা, ভাষান্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা, সর্বোপরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথাও উঠে এসেছে অনিবার্যভাবে। কি দারুণ দ্যুতিময় সংলাপও লক্ষ্য করা গেছে। বিপ্লবী বাঘা যতীন প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীদের সঙ্গে নেতাজির কথাও। বাঘা যতীনের বিপ্লবী মৃত্যুতে কাজী নজরুল ইসলামের ‘নব ভারতের হলদিঘাট’ কবিতার অংশ এসেছে। এসেছে আরও বিচিত্রতা। শেষপর্ব : ‘তবুও আলো’ তে সনিষ্ঠাবান মেধাবী অনিন্দ অর্ঘ্যরে ওপরে আরোপিত দায় ও দোষ মিথ্যা বলেই শেষমেশ প্রমাণিত হয়। ঔপন্যাসে ইতিহাসের কাক্সিক্ষত সূত্রধরদের অনিবার্যভাবে তুলে আনার দায়িত্ব লেখকেরও বর্তায়। অগ্নিযুগের অগ্নিকা আর বর্তমানের আঁধারে অগ্নিকা আঁধার অন্যরূপালোকে প্রবেশ করেছে। ঔপন্যাসিক অনৈতিক আঁধারে ডুবে যাওয়া বুদ্বুদকে আলোয় এনে আবারে অন্ধকারে অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিলেন! যা সর্বোপরি রূঢ়ভাষী অথচ বাস্তবতা। অবশ্য ঔপন্যাসিকের এই দায় নয় যে, পরামর্শ বা প্রেসক্রিপশন আকারে সমাধানের পাতা বের করা, এই দায়িত্ব যথাপোযুক্ত কর্তৃকারকের! শিল্পবিচারে তা শব্দেরবোমা হয়ে আলোরপথ দেখিয়েছে-এখন দেখার দায়িত্ব দরবারের! এই সকল দিক বিবেচনা করলে রকিবুল হাসান কিছু পরিমাণে স্বতন্ত্র দ্বীপবাসী। সময়ের এবং সময়ের মানুষের প্রয়োজনেই সমাজ-বাস্তবতার প্রকাশে লেখককে প্রবক্তার ভূমিকায় দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে কিছু অমোঘ সত্যভাষণ বলতেই হয়। অবচেতন, অর্ধচেতন এবং শ্রেণী বিভক্ত সমাজে-লোভী শাসন এবং শোষণে আক্রান্ত নানা ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের চিরকালীন বিবেক ও মূল্যবোধের পৌনঃপুনিক উদ্বোধন ঘটানো একজন সৎ লেখকের সামর্থ্যরে অন্তর্গত ব্যাপার। সমাজ বিবর্তনের ধারায় সাহিত্যেরও বিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের বিপর্যয় ও বিভ্রান্তিই এ যুগের নিয়ন্তা। যুগের হাওয়া দ্রুতলয়ে বদলাচ্ছে। সেজন্য নানা কারণেই জটিলতা নেমে আসে মানুষের জীবনে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত জীবনের চরম অবমাননা; সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আত্মিক সর্বক্ষেত্রে একটা দুঃসহ সঙ্কট, সম-সময়ের দোলাচল, দ্বন্দ্ব সংশয়ের ঘটনা প্রকাশেও যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন লেখক। রকিবুল হাসান অন্যান্য লেখকের মতো বিমুগ্ধ আবেগ ও মননের সাথী না হয়ে নতুন চিন্তা চেতনার পথ ধরে হাঁটতে থাকেন। সময় সচেতনতা এবং অনুভবের নান্দনিক স্বতঃস্ফূর্ততার থেকেই জন্ম নেয় সার্থক ও সময় অতিক্রান্ত ঔপন্যাস। অগ্নিকা আঁধার এইরূপ এক ঔপন্যাস। একেএম খালেকুজ্জামানের প্রচ্ছদে বটেশ্বর বর্ণন থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত এই ঔপন্যাস।
×