ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দ্রুত আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে

ইসি সার্চ কমিটিতেই

প্রকাশিত: ২৩:২২, ১৯ জানুয়ারি ২০২২

ইসি সার্চ কমিটিতেই

শরীফুল ইসলাম ॥ সাংবিধানিক কোন দুর্বলতা রাখতে চায় না বর্তমান সরকার। তাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে দ্রতই ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ মাসেই জাতীয় সংসদে ইসি গঠনের আইন পাস করে এ আইনের বলে ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। এই সার্চ কমিটির মাধ্যমেই গঠন করা হবে নতুন নির্বাচন কমিশন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর হলেও সংবিধান অনুসারে আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন। এদিকে, ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছেন রাষ্ট্রপতি। ৩২টি দলকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানান তিনি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ ২৫টি দল সংলাপে অংশ নিলেও বিএনপিসহ ৭টি দল অংশ নেয়নি। সংলাপে অংশ নেয়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করে। অবশ্য সোমবার সংলাপ শেষ হওয়ার দিনই কেবিনেট মিটিংয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইনের একটি খসড়া অনুমোদন নেয়া হয়। বিএনপি রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ না নিলেও তাদের সমমনা কটি দল সংলাপে অংশ নিয়ে আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের পক্ষে মতামত দিয়েছে। আর এখন এ নিয়ে কিছু না বললেও এক সময় বিএনপিও আইন করে ইসি গঠনের কথা বলেছে। সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন করতে একটি বিল জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে এটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে। সময় কম থাকায় এ মাসের মধ্যেই আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। এর পর এ আইনের বলে ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটি অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিদের সার্চ করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সুপারিশ করবেন। এসব প্রক্রিয়া শেষ করে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তায় গঠন করা হবে নতুন নির্বাচন কমিশন। ১৪ ফেব্রয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নির্বাচন কমিশন ৫ বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ২০ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেন। প্রথম দিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করে জাতীয় পার্টি। আর ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপ শেষ হয়। এখন আইন প্রণয়নের অপেক্ষা। ইতোমধ্যেই আইন মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশন গঠনে আইনের খসড়া প্রণয়ন করে এবং ইতোমধ্যেই কেবিনেটে পাস হয়। এখন খসড়াটি চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। দ্রুতই জাতীয় সংসদে আইনটি পাসের ব্যবস্থা করা হবে। এ মাসের শেষ দিকেই আইনটি পাস করার জন্য যাবতীয় প্রস্ততি নেয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের বিষয়ে এত দিন তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। বর্তমান সরকার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েও একপর্যায়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ প্রান্তে চলে আসায় শেষ পর্যন্ত আইনটি করার বিষয়ে গতি স্লথ করে। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং বিদেশী কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি উঠলে সরকার এ বিষয়ে আবারও গতি বাড়ায়। এ কারণে কিছুটা তাড়াহুড়া করেই ১৭ জানুয়ারি আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উত্থাপন ও অনুমোদন করা হয়। অবশ্য এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এত অল্প সময়ের মধ্যে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদান করবেন। সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন। ২০১২ সালে জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে সার্চ কমিটির মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়। আর ২০১৭ সালে বর্তমান নির্বাচন কমিশনও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। আইমন্ত্রী আনিসুল হক এর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতি যে প্রক্রিয়ায় সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করছেন সেটাও আইনী প্রক্রিয়া। এতে সংবিধানের লঙ্ঘন হয় না। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। আইন মন্ত্রণালয়ে ভোটিংয়ের পর আইন প্রণয়নের জন্য একটি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে। এর পর এটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাবে। সংসদীয় এ কমিটি বিলের ওপর একটি রিপোর্ট পেশ করবে। এর পর বিলটির ওপর বিভিন্ন যাচাই-বাছাই ও ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার পর কণ্ঠভোটে তা সংসদে পাস করা হবে। এর পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে এবং এ আইন বাস্তবায়নের জন্য বিধি করার প্রয়োজন পড়বে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের খসড়া অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, সংবিধানের ১১৮(১)-এর বিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। সংবিধানে এ বিষয়ে আইন করার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর কোন সরকারই আইন করেনি। এত দিন রাষ্ট্রপতি সরাসরি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিতেন। রাষ্ট্রপতি বিগত ২টি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। খসড়া আইন অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার নিয়োগ দিতে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে এ সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনের জন্য যোগ্যদের নাম সুপারিশ করবে। খসড়া আইনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার কারা হতে পারবেন এবং তাদের যোগ্যতা কী হবে সে ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে, কোন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী, আধা-সরকারী বা বেসরকারী বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাহলেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন। খসড়া আইনে অযোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে যদি কেউ অপ্রকৃতস্থ হিসেবে ঘোষিত হন, দেউলিয়া ঘোষণার পর দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্ত না হন, অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, নৈতিক স্খলন এবং সে ক্ষেত্রে যদি ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দুবছরের কারাদ-ে দ-িত হন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দ-িত হন, তিনি এ কমিটির সদস্য হতে পারবেন না। এ ছাড়া কেউ রাষ্ট্রীয় পদে থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারবেন না। নতুন আইন অনুসারে সার্চ কমিটিতে থাকবেন ৬ জন। এক নম্বরে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগের একজন বিচারপতি, তিনি কমিটির চেয়ারম্যান হবেন। এর পর থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক এবং কম্পট্রলার এ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পিএসসির চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত ২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের পর ওই কমিটির সদস্যরা বসে অভিজ্ঞ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্যদের নিয়ে একটি তালিকা করে রাষ্ট্রপতির কাছে এই তালিকা হস্তান্তর করবেন। আর সার্চ কমিটির সুপারিশ করা নামের তালিকা থেকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। এর মধ্যে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ৪ জনকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। এর আগে ২০১৭ সালে ৫ বছরের জন্য গঠন করা হয় বর্তমান নির্বাচন কমিশন। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে যচ্ছে এ কমিশনের মেয়াদ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিতে বিগত কয়েক মাস ধরেই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কিছু নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সোচ্চার হয়ে ওঠে। সরকারী দল আওয়ামী লীগ সার্চ কমিটির মাধ্যমে একটি ভাল নির্বাচন কমিশন গঠন হবে বলে আগে থেকেই বলে আসে। তবে আওয়ামী লীগ আগে আইন করার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ বললেও পরে অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতির সংলাপে গিয়ে আইন করার বিষয়ে প্রস্তাব করে।
×