ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজারবাগের পীর গোপালগঞ্জের নাম ‘গোলাপগঞ্জ’ লিখে তাদের পত্রিকায় প্রচার করে

প্রকাশিত: ২২:৩২, ৬ ডিসেম্বর ২০২১

রাজারবাগের পীর গোপালগঞ্জের নাম ‘গোলাপগঞ্জ’ লিখে তাদের পত্রিকায় প্রচার করে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজারবাগের পীরের কাজে উগ্রবাদ ছড়ানোর শঙ্কা রয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটিটিসির) প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজারবাগ পীর ও তার অনুসারীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের নাম বদলে ‘গোলাপগঞ্জ’ করে তাদের আলোচ্য পত্রিকার (দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত) মাধ্যমে প্রচার করছে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা ও তথাকথিত জিহাদকে উস্কে দিচ্ছে। এ দেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলো যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের মতবাদ প্রচার করছে ও কার্যক্রম চালাচ্ছে, রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর, তার সহযোগী ও অনুসারীদের কার্যক্রম জঙ্গীদের কার্যক্রমের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এদিকে রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমানসহ তার তিন সহযোগীর কর্মকা-ের ওপর সর্বক্ষণিক নজর রাখতে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সিআইডি, কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বলা হয়েছে, চাইলে তদন্তের স্বার্থে তাদের দেশত্যাগ বা বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে। পুলিশের সিআইডি ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্ত প্রতিবেদনে জঙ্গী সম্পৃক্ততাসহ বেশকিছু অভিযোগ উঠে আসায় রাজারবাগ দরবারের পীর দিল্লুর রহমানসহ তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা চাইলে মামলা করতে পারবেন বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সরকারী সংস্থাগুলোর তদন্ত চলাকালে পীর ও তার অনুসারীদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবেন বলেও আদেশে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়ে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেছেন। হাইকোর্টের নির্দেশের পর রাজারবাগ পীর ও অনুসারীদের জঙ্গী সম্পৃক্ততা নিয়ে তদন্তে নামে সিটিটিসির কাউন্টার টেররিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম। তদন্ত শেষে হাইকোর্টে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজারবাগ পীর ও তার অনুসারীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের নাম বদলে ‘গোলাপগঞ্জ’ করে তাদের আলোচ্য পত্রিকার (দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত) মাধ্যমে প্রচার করছে। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে নূরানীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও জেলার নাম পরিবর্তন করে নূরগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাম পরিবর্তন করে আমানবাড়িয়া- এরকম আরও কয়েকটি জেলা ও স্থানের নাম পরিবর্তন করে তারা নিজেদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব সারাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ। মানুষের এই ধর্মানুভূতি কাজে লাগিয়ে এই পীর এবং তার দরবার শরিফ সামাজিকভাবে কুসংস্কার, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পীর দিল্লুর রহমানের দরবার থেকে প্রকাশিত আলোচিত দুটি পত্রিকা ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ ও ‘দৈনিক আল ইহসান’-এর মাধ্যমে গুটি কয়েক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রচার মাধ্যমে নানাভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটাচ্ছে। তাদের এসব কার্যক্রম সরাসরি সরকারী নীতিমালা, দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরোধী। দেশের বিভিন্ন থানায় রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর ও তার মুরিদদের বিরুদ্ধে রুজুকৃত মামলা ও মামলাগুলো তদন্তের ফলাফলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সিটিটিসির প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়েছে, রাজারবাগ দরবারের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ দৈনিক আল ইহসান’ ও ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা, তাদের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত বিভিন্ন বই, ইতোপূর্বে তাদের কার্যক্রম এবং বিভিন্ন জেলায় তাদের অনুসারীদের কার্যক্রমের কারণে রুজুকৃত মামলা ও মামলাগুলোর তদন্তের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- তারা ইসলাম ধর্মের নামে এবং অনেক ক্ষেত্রে পবিত্র কোরান ও হাদিসের খন্ডিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেশের ধর্মভীরু মানুষকে ভুলপথে পরিচালিত করে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা ও তথাকথিত জিহাদকে উস্কে দিচ্ছে। এ দেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলো যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের মতবাদ প্রচার করছে ও কার্যক্রম চালাচ্ছে, রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর, তার সহযোগী ও অনুসারীদের কার্যক্রম জঙ্গীদের কার্যক্রমের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন মতাবলম্বী ও ভিন্ন ধর্মের মানুষকে, তাদের ভাষায় মাল’উনদের হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব উল্লেখ করে ফতোয়া এবং এক্ষেত্রে কতল করার আদেশ দিয়েছে; যা মূলত বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের মানুষকে হত্যা করার ফতোয়ার অনুরূপ। এটি ইসলামের নামে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনগুলোর মতো একই প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করার ও ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার কৌশল। তাদের এ ধরনের বক্তব্য মানুষকে জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত করবে, অসহিষ্ণু করবে, অসাম্প্রদায়িক চেতনা নষ্ট করতে ভূমিকা রাখবে। আদালত বলেছেন, রাজারবাগ দরবার শরিফের পীরের বিষয়ে মামলার তদন্তের স্বার্থে সিআইডি, কাউন্টার টেররিজম ও দুদক চাইলে পীরের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে। রাজারবাগের পীর ও তার সহযোগীরা কোরান ও হাদিসের খন্ডিত ব্যাখ্যা দিয়ে দেশের ধর্মভীরু মানুষকে ভুল পথে পরিচালনা করে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা ও তথাকথিত জিহাদকে উস্কে দিচ্ছে। তাদের কার্যক্রম জঙ্গীদের কার্যক্রমের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাদের (রাজারবাগের পীর ভক্ত) কার্যক্রমে উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। হাইকোর্টে জমা দেয়া প্রতিবেদনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। রাজারবাগ পীর সিন্ডিকেটের দায়ের করা ৪৯ মামলার বাদীদের খুঁজতে ব্যবসায়ী একরামুল আহসান কাঞ্চনের এবং অপর আটজনের দায়ের করা রিটে দেয়া আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সিটিটিসি এমন প্রতিবেদন জমা দেয় আদালতে। এ বিষয়ে করা রিট আবেদনের শুনানি রবিবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে আছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ও এমাদুল হক বশির।
×