ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কামরুল ইসলাম খান

স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ ॥ প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক আগে

প্রকাশিত: ২২:২৩, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ ॥ প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক আগে

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অগ্নিঝরা দিন, তারও আগে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনাগুলো ভেসে উঠছে স্মৃতির পটে। ১৯৬৭ সালে ৭ জুন বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা দিবস পালন করতে গিয়ে তৎকালীন সাতক্ষীরা মহকুমা সদরে ছাত্রলীগের উদ্যোগে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করা হয়। সেখান থেকে আমরা গ্রেফতার হই। সেই প্রথম জেলখাটা এবং ছাত্র রাজনীতির শুরু ওখান থেকেই। অব্যাহত আন্দোলন সংগ্রামে ক্রমশ সামনের কাতারে চলে আসি। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখি ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়। ওই সময় গ্রেফতার হয়ে আবারও জেলে যাই। গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রলীগের তৎকালীন সাতক্ষীরা মহকুমা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাই। ’৭০-এর নবেম্বরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলজুড়ে এক ভয়াবহ সাইক্লোন আঘাত হানে। আমরা সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্রদের পক্ষ থেকে রিলিফ নিয়ে দুর্গত এলাকায় যাই। কয়েক সহকর্মীকে নিয়ে পটুয়াখালীর কলাপাড়া, ছোট বাইজদিয়া, বড় বাইজদিয়ায় ত্রাণ বিলি করি। এক পর্যায়ে ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। আমরা আশা করি এবার বাঙালীরা ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সে আশা ফিকে হয়ে আসে। শুরু থেকেই সচেতনভাবে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি ঘটনাপ্রবাহ। মুক্তিযুদ্ধ তাৎক্ষণিক কোন সিদ্ধান্ত ছিল না, দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল নয় মাসের যুদ্ধ। এই মুক্তি সংগ্রামের অনেকটা জুড়ে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পরই বাঙালী জাতি বুঝতে পেরেছিল তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি, শোষকের হাতবদল হয়েছে মাত্র। সেই সময় থেকেই শুরু হয় মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি। প্রথম আঘাত আসে মাতৃভাষা বাংলার ওপর। ধীরে ধীরে তা গ্রাস করে আর্থ-সামাজিক সকল ক্ষেত্রে। দুই পাকিস্তানের চরম বৈষম্য বাঙালীকে মুক্তির পথে চালিত করে দ্রুত। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা এবং বাঙালীর জন্য ভালবাসা তাকে মুক্তি সংগ্রামের চালকের আসনে প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর গভীর দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ এবং আপোসহীন নেতৃত্বে বাঙালী জাতি এগুতে থাকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন এবং নির্বাচনের অঙ্গীকারে ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। ছাত্র-যুবকদের ধারণা দেয়ার চেষ্টা করি, ভোটের মাধ্যমে সংগ্রাম শেষ না হয়ে শুরু হতে পারে লড়াই। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনের সময় আমরা ভোটের প্রচারের পাশাপাশি ছাত্র যুবকদের সংগঠিত করার কাজে হাত দেই। যেখানে যেদিন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জনসভা থাকত আমরা সেদিন সেখানে গিয়ে ছাত্র যুবকদের মধ্যে ওই চিন্তার বীজ বুনতাম। বলতাম আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলেও পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র থামবে না। বাঙালীদের হাতে তারা ক্ষমতা তুলে দিতে চাইবে না। ভোটে জিতেও যদি আমরা ক্ষমতায় যেতে না পারি তবে বাঙালীর সামনে স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকবে না। ছাত্র যুবকদের সে বিকল্প মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা তাদের বলতাম মাস্টার দা সূর্যসেন, নেতাজী সুভাষ বোসের আত্মত্যাগের কথা। ‘আমি সুভাষ বলছি’, ‘বিনয় বাদল দীনেশ’, ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ কিংবা ‘ইউরোপীয় ক্লাবে আক্রমণ’ ইত্যাদি বই আমরা তাদের হাতে তুলে দিতাম। এলাকায় একটি গ্রুপকে আমরা উদ্বুদ্ধ করে নামিয়ে দিতাম আরও ছাত্র যুবকদের সংগঠিত করতে। এ কাজে আমার সঙ্গে প্রধানত ছিল হাবলু, এনামুল, মাসুদ, নাজমুল, গোলাম সাবদার সিদ্দিকী, কিসমত, রবি, দিদারুল, খসরু প্রমুখ। আরও অনেকের নাম আজ আর মনে নেই। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে এ গ্রুপের অধিকাংশই ওই কমিটির অন্তর্ভুক্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা গড়ে তুলি বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী (বামুবা)। তখন এটি কোন সশস্ত্র সংগঠন ছিল না। এটি ছিল আমাদের গ্রুপের তৎপরতার একটা প্রেরণার নাম। বামুবার তৎপরতার মধ্যে ছিল স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়ে পোস্টারিং করা ও দেয়াল লিখন। সে সময় আমাদের কাজ যথেষ্ট সাড়া ফেলে। বলাবাহুল্য বামুবার তৎপরতা চলত গোপনে। তবে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে সূচী নির্দিষ্ট করা হতো। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর রচিত বিভিন্ন বই পঠিত হতো এই পাঠচক্রে। ’৭০ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে শুরু হয় টানাপোড়েন। চলতে থাকে আমাদের বামুবার কার্যক্রম। হাতে লেখা পোস্টারে আহ্বান জানানো হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের। শেষের দিকে মুক্তি সেনা (মুস) নামেও পোস্টার লাগানো হয়। বামুবা বা মুস নামে পোস্টার সে সময় এলাকায় তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। তখন ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (ইপিসিপি) বা নকশাল তৎপরতা ছিল এই এলাকায়। গোয়েন্দারা সন্দেহ করত এগুলো এদেরই কাজ। তবে গোপন আন্দোলনের এই গ্রুপটি বামুবা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। পোস্টারে লেখা হতো ‘এওঠঊ গঊ ইখঙঙউ ও ডওখখ এওঠঊ ণঙট ঋজঊঊউঙগÑঘঊঞঅঔও ঝটইঅঝঐ ইঙঝঊ’ সুভাষ বোসের সেই বিখ্যাত উক্তি। আরও লেখা হতো ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা,’ ‘জয় বাংলা,’ ইত্যাদি। এ নিয়ে সহকর্মীদের প্রশ্ন ছিল, নেতাজীর লেখা এই উক্তি কেন আমরা ব্যবহার করছি। জবাবে তাদের জানিয়েছিলাম, নেতাজীর মহান আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের কথা। কি দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন নেতাজী এবং তিনি বেছে নিয়েছিলেন সশস্ত্র লড়াইয়ের পথ। তারই প্রদর্শিত আজাদ হিন্দ ফৌজের পথ ধরেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে যেতে পারে। সে জন্যই তার উদ্ধৃতি আমরা প্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করছি। সময় গড়াতে থাকলে বাঙালীর আশা ভঙ্গ হয়। জিতেও বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি। তখন যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বামুবার প্রয়োজনও সে সময় কমে যায়। গোপন তৎপরতা তখন প্রকাশ্যে চলে আসে। তবে বামুবার মাধ্যমে আমরা কয়েকজন ছাত্র-যুবক সংগঠিত থাকায় সাতক্ষীরায় যুদ্ধ সংঘটিত করার প্রাথমিক কাজ শুরু করতে পেরেছিলাম। এ সময় শরণার্থীদের ভারত অভিমুখে ঢল নামে। সাতক্ষীরার অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে ও খুলনা বরিশালসহ দূর-দূরান্ত থেকে শরণার্থীরা আসতে থাকে। পথে তারা অনেক স্থানে বাধার সম্মুখীন হয়। তাদের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসতে হয় এই গ্রুপকে। মার্চের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সাতক্ষীরায়ও বিক্ষোভ, মিছিলের কর্মসূচী গ্রহণ করি। ওই বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে আমরা কয়েকজন চাপড়া লজে বন্দুকের দোকান লুটের পরিকল্পনা করি। তৎকালীন পাওয়ার হাউসের সামনে বসে আমরা কয়েকজন আলাপ-আলোচনাও করি। ওই দিন বিক্ষোভ মিছিলকে নির্ধারিত রুট বাদ দিয়ে চাপড়া লজের সামনের রাস্তায় নিয়ে আসা হয়। তবে অস্ত্র লুট চেষ্টা সফল হয়নি। তার আগে মিছিল পাওয়ার হাউস অতিক্রম করার সময় চাপড়া লজ থেকে মিছিলের ওপর গুলি চালানো হয়। শহীদ হন রিকশাচালক আবদুর রাজ্জাক। অহেদ মিয়া, খলিলুল্লাহ ঝড়ু ও নিজামসহ কয়েকজন আহত হয়। এই ঘটনায় সাতক্ষীরায় ছাত্র যুব সমাজের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম হয়। পতাকা উত্তোলন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ২৩ মার্চ সারাদেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন দিবস পালনের ডাক দেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে আমরা সাতক্ষীরা শহরেও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেই। সুলতানপুর বাজারে এক দর্জির কাছ থেকে আমরা বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরি করি। ২৩ মার্চ শহরের পাকাপোলের মোড়ে আমরা কয়েকজন ওই পতাকা উত্তোলনে অংশ নেই। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক হিসেবে আমাকে ওই পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করতে হয়। আনসার-পুলিশসহ অনেক বাহিনীর সদস্যরা ওই পতাকাকে স্যালুট করে সম্মান জানান। ২৬ মার্চের পর মহকুমা হাকিমের দফতরে (এসডিও অফিস) পতপত করে উড়ছিল চাঁদতারাখচিত পাকিস্তানী পতাকা। ২৯ মার্চ সকাল ১০টা সাড়ে ১০টা হবে। আমি, সালাম ভাই, আজিবর, কালো খসরু, হাবলু, মাসুদসহ কয়েকজন কোর্টের সামনে কথা বলছিলাম। দেখলাম এসডিও সাহেবের অফিসে ওই পতাকা তখনও এদেশের বুকে শোভা পাচ্ছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ওটা ওখান থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাম ভাই লোহার সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ল একতলা সেই ভবনের ছাদে। তারপর পতাকা খুলে নিয়ে নিচে এলো। এরপর কোর্টের গেটে ওই পতাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। (চলবে) লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, জনকণ্ঠ
×