ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের অবরোধ যানজট, ভোগান্তি

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ২৮ নভেম্বর ২০২১

শিক্ষার্থীদের অবরোধ যানজট, ভোগান্তি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাসে হাফ ভাড়া নেয়ার দাবিতে বেশ কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলনের সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে নটরডেম কলেজ শিক্ষার্থী নাঈমের মৃত্যুর বিচার ও সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সব শিক্ষার্থীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবি। একইসঙ্গে ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়কের দাবিগুলোও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এসব দাবি নিয়ে শনিবারও রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। মিরপুর, ধানমন্ডি-২৭ ও ৩২, পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা ও যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়ক অবরোধ করে তারা এসব দাবি জানান। এতে ওইসব এলাকার সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে, ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে। শনিবার বেলা সোয়া ১১টার পরে ধানমন্ডির রাপা প্লাজার সামনের সড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী মধ্যে তেজগাঁও কলেজ, আইডিয়াল কমার্স কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, মিরপুর দুয়ারীপাড়া কলেজ, নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজসহ নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। তারা গোলচত্বর অবরোধ করে স্লোগান দিতে থাকেন। এভাবে কয়েক ঘণ্টা ধরে জনবহুল ওই সড়কটি অবরোধ করে রাখেন তারা। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, ৯ দফা দাবি আদায়ে গত বৃহস্পতিবার তারা সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে গিয়েছিল। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এক সপ্তাহ সময় চেয়েছে। আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে তাদের দাবি মেনে প্রজ্ঞাপন জারি করা না হলে ওইদিন দুপুরে শিক্ষার্থীরা বিআরটিএ কার্যালয় ঘেরাও করবে। তবে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আজ রবিবার ও আগামীকাল সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ চলবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা আরও জানিয়েছে, সড়কে ফিটনেসবিহীন ও লাইসেন্সবিহীন যানবাহন যাচাই কার্যক্রমও চলবে। আমরা কোন ধরনের ভাংচুর করার জন্য সড়কে নামেনি। ২০১৮ সালের আন্দোলনের সময় ৯ দফা দাবি তুলেছিল। সরকার বলেছিল, দাবিগুলো মানা হয়েছে। কিন্তু একটি দফাও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এবার ৯ দফা মানা না হলে আগামী মঙ্গলবার থেকে আরও কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি হচ্ছে- নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈমসহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সব শিক্ষার্থীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত সব যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা, সড়ক, নৌ ও রেলপথে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস নিশ্চিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা, বৈধ-অবৈধ যানবাহন চালকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈধতার আওতায় আনা, বিআরটিএ’র সব কার্যক্রমে নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, সারাদেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয় আধুনিকায়ন এবং পরিকল্পিত নগরায়ন সুনিশ্চিত করা, গণপরিবহনে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতা বন্ধ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও পরিকল্পিত বাস স্টপেজ, পার্কিং স্পেস নির্মাণ এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দুপুরে রাপা প্লাজার সামনে গিয়ে দেখা যায়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে স্লোগানের পাশাপাশি ধানমন্ডির বিভিন্ন সিগন্যালে থাকা প্রাইভেটকার, বাস এবং মোটরসাইকেল চালকের লাইসেন্স আছে কিনা, তা চেক করছেন। যে সকল চালকের লাইসেন্স ঠিকঠাক রয়েছে, তাদের যেতে দেয়া হচ্ছে। যাদের কাগজপত্র ঠিক নেই তাদের চাবি নিয়ে পাশে থাকা পুলিশ সদস্যদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনের সময় যেমন জরুরী লেন, ব্যক্তিগত গাড়ির লেন ও পাবলিক বাসের লেন সিস্টেম করেছিল শিক্ষার্থীরা, শনিবারও ধানমন্ডি-২৭ এ রকম লেন সিস্টেম করে গাড়ি চলতে বাধ্য করেন তারা। তবে এ্যাম্বুলেন্স, পরীক্ষার্থীর গাড়ি ও জরুরী সেবার গাড়ি যেতে দিতে দেখা গেছে। বেলা ২টার দিকে ধানমন্ডি-২৭ এর দিক থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসার সময় একজন কনস্টেবলকে দাঁড় করান শিক্ষার্থীরা। তারা ওই কনস্টেবলের লাইসেন্সসহ বাইকের কাগজ দেখতে চান। কিন্তু কনস্টেবল কোন কাগজই দেখাতে পারেননি। পরে পাশে থাকা তেজগাঁও বিভাগের এডিসি রুবাইয়াত জামানের কাছে ওই পুলিশ সদস্যকে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। লাইসেন্স ও বাইকের কাগজ না থাকলে সার্জেন্ট ডেকে ওই কনস্টেবলকে মামলা দেয়া হবে, এডিসির এমন আশ্বাসের পর শান্ত হন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামার খবরে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার, ওই বিভাগের এসি, এডিসিসহ অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। ডিসি সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জানান, ডিসি বলেছেন, তারা আমাদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে একমত। কিন্তু এভাবে আন্দোলন না করতে অনুরোধ করেছেন। পুলিশের অনুরোধেও আন্দোলন স্থগিত করেননি শিক্ষার্থীরা। ফলে মূল সড়কের চতুর্দিকে গণপরিবহনের জটলা সৃষ্টি হয়। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে দেখা গেছে। শনিবার ব্যাংকের পরীক্ষা থাকায় অনেক পরীক্ষার্থীকে পায়ে হেঁটে কেন্দ্রে যেতেও দেখা গেছে। মাহমুদুল হাসান নামের একজন পরীক্ষার্থী জানান, লালমাটিয়া মহিলা কলেজে তার ব্যাংক পরীক্ষার আসন পড়েছে। তিনি পুরান ঢাকা থেকে বাসযোগে রওনা দেন। কিন্তু ধানমন্ডি-২৭ এ এসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে আটকা পড়েন। পরে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যান। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের অনুরোধ জানিয়ে মাহমুদুলসহ বেশ কয়েকজন বলেন, শনিবার ব্যাংকের চাকরি পরীক্ষা আছে। পেছনের বাসগুলোতে অনেক পরীক্ষার্থী আটকা পড়েছে। বাসগুলো এখনই না ছাড়লে তাদের কেউ পরীক্ষা দিতে পারবে না। তবে তাদের কিছুই করার নেই বলে ¯্র্েরফ জানিয়ে দিয়েছেন সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। পরে বেলা আড়াইটার দিকে ৯ দফা দাবি জানিয়ে নিজ থেকে রাস্তা ছেড়ে চলে যান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। জনকণ্ঠের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদদাতা জানান, বাসে হাফ ভাড়া নেয়া ও নাঈম হত্যার বিচারের দাবিসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে বেলা ১১টার দিকে পুরান ঢাকার সদরঘাটগামী সড়ক অবরোধও করে বিক্ষোভ করেছেন কবি নজরুল সরকারী কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারী কলেজের শিক্ষার্থীরা। বাসে অর্ধেক ভাড়া বা হাফ পাস চালুর দাবিতে তারা লক্ষ্মীবাজার থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রায়সাহেব বাজার মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেন। এ সময় রায়সাহেব বাজার মোড় ব্লক করে সেøাগান দেন। এতে ওই এলাকায়ও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভ চলাকালীন শিক্ষার্থীরা পুলিশের গাড়ি, সদরঘাটগামী বাসগুলোর লাইসেন্স চেক করেন। অবরোধে অংশ নেয়া ফাহমিদা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, এই রুটের বাসগুলোতে হাফ ভাড়া দেয়ায় শিক্ষার্থীদের বাসে তোলে না। ছাত্রী দেখলে দরজা বন্ধ করে রাখে। হাফ ভাড়া দিতে চাইলে বাস থেকে নামিয়ে দেয়। আমরা সুশৃঙ্খলভাবে বাসে চলাচল করতে চাই। এ দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছি। শিক্ষার্থীরা জানান, সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমাদের জন্য হাফ পাস নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। ছাত্রীদের লাঞ্চিত করা হয়। আমাদের দেখলে বাসের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এগুলো অতিদ্রুত বন্ধ করতে হবে। তারা বলেন, শুধু বিআরটিসি বাসে হাফ পাস নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে আমাদের কোন লাভ হয়নি। কারণ সদরঘাটে বিআরটিসি’র কোন বাস আসে না। এই সময় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণ ও নটরডেম কলেজ ছাত্র নাঈমসহ সড়কে শিক্ষার্থী মৃত্যুর দ্রুত বিচারের দাবি জানান। একই দাবিতে বেলা দেড়টার দিকে যাত্রাবাড়ীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ ও যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা যাত্রাবাড়ী মোড় এলাকায় একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এ দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচীতে যাত্রাবাড়ী মোড় ও আশপাশের যান চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে। গাড়িচাপায় নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হওয়ার ঘটনায় সঠিক বিচার এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে যাত্রাবাড়ী মোড়ে বিভিন্ন স্লেগান দেন শিক্ষার্থীরা। মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল হক বলে, দ্রুত নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা চালু করার দাবিতে আমরা রাস্তায় এসেছি। প্রতিবাদ জানাতেই এ কর্মসূচী গ্রহণ করা। শিক্ষার্থীরা যখন সড়ক অবরোধ করে তখন যাত্রাবাড়ী থানা-পুলিশের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আশপাশের থাকা সাধারণ মানুষদের সরিয়ে দেন পুলিশ সদস্যরা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর সরকার ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও এ অজুহাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিচ্ছে না রাজধানীর গণপরিবহনের শ্রমিকরা। হাফ ভাড়া নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মারামারি, হট্টগোল লেগেই আছে। ফলে হাফ ভাড়ার দাবিতে সড়কে নামে রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এরইমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটরডেম কলেজ ছাত্র নাঈমের মৃত্যু হয়। হাফ ভাড়ার পাশাপাশি নাঈমের মৃত্যুর বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবিতেও বৃহস্পতিবার থেকে আন্দোলন শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাদের এ আন্দোলন দিনদিন ফুলে ফেঁপে উঠছে।
×