ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

বিসিবিকে ধন্যবাদ

প্রকাশিত: ২১:০৭, ২৪ নভেম্বর ২০২১

বিসিবিকে ধন্যবাদ

পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সাম্প্রতিক সফর নিয়ে এই মুহূর্তে উত্তাল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। কাঁপছে মিডিয়াও। বাংলাদেশকে টি-২০ সিরিজে এরই মধ্যে হারিয়েছে পাকিস্তান। সর্বশেষ টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ক্রিকেট দলের পারফরমেন্স বিবেচনায় এমন ফল অবশ্য অপ্রত্যাশিতও ছিল না। ক্রিকেটে একটা বাজে সময় যাচ্ছে বাংলার বাঘদের। অতএব, সিরিজের ফলাফলে জাতি ব্যথিত হলেও তা সংবাদপত্রের শিরোনামের কারণ হয়নি। শিরোনামটা হয়েছে পাকিস্তান দলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ আর তাদের সমর্থনে এদেশীয় কিছু নির্লজ্জ দালালের নির্লজ্জতম দালালির কারণে। মিরপুর স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে প্র্যাকটিস করা আন্তর্জাতিক কনভেশন এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যার জন্য এক বছর কারাদ-ের বিধান আছে আমাদের দ-বিধিতে। আইসিসি স্বীকৃত কোন ক্রিকেট ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটোর পতাকা উত্তোলনের যে বিধানটি রয়েছে এটি আর সেটি এক বিষয় নয়। পিসিবি অবশ্য এসবের থোরাই পরোয়া করে। কোনরকম প্রটোকল বা অনুমতির তোয়াক্কা না করেই পাকিস্তানী ক্রিকেটাররা দিনের পর দিন পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে মিরপুরে প্র্যাকটিস করেছে। তারপর যখন বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় তুমুল লেখালেখি তখন তারা দায়সাড়া অনুমতি চেয়েছে বিসিবির কাছে। যদিও এ ধরনের অনুমতি দেয়ার কোন এখতিয়ারই বিসিবির নেই। পিসিবি আর পাকি ক্রিকেটারদের এমন বেপরোয়া আচরণের শক্তিটা কোথায় তা অবশ্য দুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। মাঠে বাংলা মায়ের কিছু কুলাঙ্গার সন্তান পাকিস্তানী জার্সি গায়ে, পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে, নেচে-গেয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিজয় উদ্যাপন করেই শুধু ক্ষান্ত হয়নি, একাধিক টিভি চ্যানেলে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্ট্যাটাসে ম্যাচ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সীমানার চূড়ান্ত লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশ আর পাকিস্তান একই দেশÑ এমন মন্তব্য থেকে শুরু করে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান কিংবা একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ায় হতাশা, পশ্চিম পাকিস্তানকে অভিনন্দন, পরবর্তী ম্যাচে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শুভ কামনা- এসবই ত্রিশ লাখ শহীদ আর পাঁচ লাখ সম্ভ্রমহারা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে মুজিব জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর যুগপৎ উদ্যাপনকে কলঙ্কিত করেছে। আর এ সমস্ত কারণেই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে উত্তাল বাংলাদেশ। বিসিবির এক সময় নাম ছিল বিসিসিবি, অর্থাৎ বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড। নামটি একটু স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে যায় বলেই সম্ভবত পরবর্তীতে কন্ট্রোল শব্দটি বাদ দিয়ে এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, সংক্ষেপে বিসিবি। দুষ্টুলোকে বলছে, সমস্যাটা আসলে হয়ে গেছে সেখানেই। নাম থেকে কন্ট্রোল শব্দটি বাদ দিয়ে বিসিবি এখন সবরকমের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কাজেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে, মুজিব জন্মশতবর্ষে আনকোরা একটা বাংলাদেশ জাতীয় দলকে পাকিস্তানের মুখোমুখি করাটা তাদের কাছে সমস্যা বলে মনে হয়নি আদৌ। অনেকে আবার বলছেন বিষয়টি এমন ভাবে না দেখার জন্য। খেলায় হারলেই কি দেশ হারে নাকি? আমিও এর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত। কিন্তু বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে যখন পাকিস্তানের সিটিং ক্যাবিনেট মন্ত্রী ঘোষণা করে যে, এর মাধ্যমে ইসলামের বিজয় সূচিত হয়েছে। বেমালুম ভুলে যায় যে, এর আগে ভারতের কাছে তাদের দফায় দফায় টি-২০ পরাজয় মানে ইসলামের পরাজয় ছিল না, তখন ওই সারমেয় শাবকরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ডিসেম্বরের ঠিক আগে আগে এই সিরিজ জয়টিকে কিভাবে মূল্যায়ন করছে তা বলাই বাহুল্য। কাজেই বর্ণবাদের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট টিম যে দশকের পর দশক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে ছিল সেই উদাহরণ না টেনে এনেও চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি যে, এই বিষয়টিকে আমাদের উদারভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। তবে অন্য একটি কারণে ক্রিকেট বোর্ডের কাছে কৃতজ্ঞ। এই সময়টায় পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে বাংলাদেশে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসে তারা আমাদের মানসচক্ষু খুলে দিয়েছে। পাকিস্তানে তৈরি আর পাক সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সরবরাহ করা যে আর্জেস গ্রেনেডগুলোয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল বাংলাদেশ সেই আঘাতের ক্ষত সরাসরি বহন করেও ক্রিকেট বোর্ড যখন এমনই সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ঢাকায় উড়িয়ে আনল তখন আমাদের ক্ষোভের চেয়ে বিস্ময়বোধ হয়েছিল অনেক বেশি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যে, এতে আসলে শাপে বরই হয়েছে। গত কিছুদিন ধরেই পাকিস্তানের মূলধারার আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসার ফল্গুধারা বইছিল। বলা হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষেই পাকিস্তান সফরে যাবেন। আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, একাত্তরে বাংলাদেশের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর ভ্রাতুষ্পুত্র ইমরান খান নিয়াজীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরের গুজব তো এখন ইথারে ইথারে। ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনারের প্রধানন্ত্রীর সঙ্গে সাম্প্রতিক রুটিন সাক্ষাতের পর গুজবটি আরও ডালপালা মেলতে শুরু করেছিল। কয়লা ধুলে হয়ত ময়লা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান যে যেইকার তাই রয়ে গেছে, এ বিষয়টি এ যাত্রায় ওরাই আমাদের আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভালমতো বুঝিয়ে দিয়ে গেল। ২০০০ সালে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ানোর প্রতিবাদ করায় সে সময়কার ৬৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কামাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করেছিল ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের দুই কুলাঙ্গার ছেলে। গত তেরটি বছর ধরে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি টানা ক্ষমতায় থাকায় আমাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টি চলে এসেছিল যে, এই বাংলাদেশ বোধ হয় সেই জায়গা থেকে অনেক দূর সরে এসেছে। সেই ভুলটাও এ যাত্রায় আমাদের ভালমতোই ভেঙ্গে গেছে। আমরা যে জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল আর জনৈক নারীর ‘মেরি মি আফ্রিদির’ জমানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি এমনটি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও নয়, এমনকি আওয়ামী লীগ তেরো বছর টানা ক্ষমতায় থাকার পরেও নয়, সেটা বুঝতে আমাদের এখন আর বাকি নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা সকাল-বিকেল হাইব্রিড-হাইব্রিড বলে যতই চিৎকার করি না কেন, শুধু যে হাইব্রিডই নয়, বরং আমাদের পোড়খাওয়া মানুষগুলোর অবক্ষয়ও যে দেশের জন্য বড় সমস্যা সেই শিক্ষাটা আমাদের এ যাত্রায় হয়ে গেল। পাশাপাশি আমরা যারা কথায় কথায় আমাদের আদর্শিক অবক্ষয়ের জন্য ধর্মীয় শিক্ষাকে দায়ী করি তাদেরও বোধ হয় মিরপুর গ্যালারিতে আধুনিক পোশাক পরিহিতা আধুনিক বাঙালী ললনাদের নির্লজ্জ পাকিস্তানপ্রীতিতে বুঝতে আর বাকি নেই যে, এই প্রজাতিটিও ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কাজেই বিসিবিকে ধন্যবাদ না দিয়ে আর পারলাম না। লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×