
ছবি: প্রতীকী
দিন শুরু হয় ঘুম ভাঙার মধ্য দিয়ে। আর এই ঘুম ভাঙার পরের প্রথম এক ঘণ্টা আপনার সারাদিনের মেজাজ, শক্তি ও মানসিক প্রস্তুতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তাই এই সময়টাকে অবহেলা না করে একটু যত্নের সঙ্গে শুরু করাই ভালো। আধুনিক জীবনযাত্রায় আমরা অনেকেই সকালে চোখ মেলেই ফোনে মুখ গুঁজে ফেলি, তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছাড়ি কিংবা চা-কফির খোঁজে রান্নাঘরের দিকে দৌড়াই। কিন্তু বিজ্ঞান ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রথম ঘণ্টার আচরণ বদলে ফেললেই বদলে যেতে পারে আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা।
ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথমেই একটা দম নিয়ে চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে শরীরটাকে জাগিয়ে তোলা উচিত। চোখ মেলেই সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠা শরীরের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করে। বিশেষ করে রক্তচাপের হঠাৎ পরিবর্তন মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে। বরং কয়েক মিনিট সময় নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসা, মাথা ঘুরে কি না তা বোঝা এবং শরীরের প্রতিটি অংশকে সচেতনভাবে নড়াচড়া করানো স্বাস্থ্যকর অভ্যাস।
যা একদমই করবেন না, তা হলো ফোনে ঢুকে পড়া। অনেকেই ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ, সোশ্যাল মিডিয়া বা খবরের অ্যাপে চোখ রাখেন। এটা শুধু সময় নষ্টই করে না, বরং সকালবেলা আপনার মস্তিষ্কে চাপ বাড়িয়ে দেয়। ঘুম থেকে ওঠার পর আমাদের মন একটা হালকা ধীর গতির অবস্থায় থাকে, যেটাকে বলে “হাইপোন্যাগোগিক স্টেট”। এই সময়টা সৃষ্টিশীল চিন্তা ও পরিকল্পনার জন্য উপযুক্ত। অথচ এই সময় আমরা যদি ইন্টারনেটের বিশৃঙ্খলায় ডুবে যাই, তাহলে মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক প্রস্তুতির সুযোগটাই মিস হয়ে যায়।
তাই দিনের শুরুটা হোক প্রযুক্তিমুক্ত। জানালার পর্দা সরিয়ে প্রাকৃতিক আলো ঢুকতে দিন। সূর্যের আলো শরীরের বায়োলজিক্যাল ক্লককে রিসেট করে দেয়, মনকে সতেজ করে তোলে। সম্ভব হলে বারান্দায় বা উঠোনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকুন, পাখির ডাক শুনুন, গাছের পাতায় তাকিয়ে থাকুন। এমনকি ছোটখাটো গৃহস্থালি কাজ যেমন- বিছানা গুছিয়ে রাখা বা গাছগুলোতে পানি দেওয়া— এইটুকু শারীরিক কাজও আপনাকে সকালের গতি এনে দিতে পারে।
অনেকেই মনে করেন, সকালে চা বা কফি না খেলে মাথা কাজ করে না। তবে ঘুম ভাঙার পরপরই ক্যাফেইন নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞরা দেন না। ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শরীর নিজেই কর্টিসল নামের একধরনের হরমোন উৎপন্ন করে, যা আপনাকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। এই প্রাকৃতিক জাগরণের ওপর সঙ্গে সঙ্গে চা বা কফি নিলে কর্টিসলের প্রভাব কমে যেতে পারে, আর ভবিষ্যতে ক্যাফেইনের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে পারে। তাই অন্তত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করে তারপর কফি বা চা খাওয়াই ভালো।
অতিরিক্ত ভারী নাস্তা বা একেবারেই না খাওয়াও ভুল। ঘুম থেকে ওঠার পর শরীরের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়, তাই হালকা ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। একটি ফল, কয়েকটা বাদাম, বা সামান্য ওটমিল হতে পারে ভালো সকাল শুরুর সঙ্গী। তবে কার্বোহাইড্রেট বেশি এমন খাবার এড়িয়ে যাওয়াই ভালো, কারণ এতে ঝিমুনি আসতে পারে।
আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে, সকালে কিছু সময় নিজের সঙ্গে কাটানো। অনেকেই নামাজ, মেডিটেশন বা ধ্যান করেন, কেউ হয়তো জার্নাল লেখেন। এই অভ্যাসগুলো মনের ভার কমায়, সারাদিনের প্রস্তুতি নেয়। আপনি চাইলে শুধু কয়েক মিনিট চুপ করে বসেও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিতে মনোযোগ দিতে পারেন। এতে মন শান্ত হয়, অস্থিরতা কমে যায়।
সবশেষে, ব্যায়াম। সকালের ব্যায়াম শুধু শরীর ফিট রাখে না, মনকেও সতেজ করে। এটা না পারলেও অন্তত হাঁটাহাঁটি, কিছু স্ট্রেচিং বা যোগব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে নড়াতে পারলে ভালো। বিশেষ করে যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন, তাদের জন্য সকালের এই নড়াচড়া অত্যন্ত জরুরি।
সারকথা হলো, ঘুম থেকে ওঠার পরের প্রথম এক ঘণ্টা হোক যতটা সম্ভব শান্ত, স্বস্তিদায়ক আর নিজের নিয়ন্ত্রণে। দিনের যন্ত্রণা, দৌড়ঝাঁপ বা দুশ্চিন্তা তো আসবেই, কিন্তু তার আগে অন্তত নিজের জন্য কিছু সময় রাখা উচিত। এক ঘণ্টা না হোক, অন্তত ২০-৩০ মিনিটের সচেতন অভ্যাস আপনাকে এনে দিতে পারে এক নতুন সকালের অনুভূতি।
এম.কে.