ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার রায়

খাদ্য নিরাপত্তায় রুপালি ইলিশ

প্রকাশিত: ০১:১৯, ৭ নভেম্বর ২০২১

খাদ্য নিরাপত্তায় রুপালি ইলিশ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রুপালি ইলিশের অবদান অনস্বীকার্য এবং পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১২ ভাগ আসে ইলিশ মাছ থেকে যার মূল্য প্রায় ৮ হাজার ১২৫ কোটি টাকা, জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান ১৫ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ আহরিত হয় বাংলাদেশ থেকেই। প্রতিবছর ইলিশ মাছ রফতানি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। যদি প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা ও জাটকা নিধন বন্ধ থাকে, তাহলে ২১ থেকে ২৪ হাজার কোটি নতুন পরিপক্ব ইলিশ পাওয়া যাবে। এতে বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ইলিশের বাজার সৃষ্টি সম্ভব হবে বাংলাদেশে। এই প্রাকৃতিক সম্পদ রুপালি ইলিশের আহরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও রফতানিসহ এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছে দেশের ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ মানুষ। মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ টনেরও বেশি ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে, যা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৯-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। গত নয় বছরের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। আগামী মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে ৬ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে; যার বাজার মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক ইলিশ। ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই মাছ, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এক সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক অর্জন। প্যাটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদফতরের সূত্রমতে, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডেক্স বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ইলিশ মাছের নাম নিবন্ধন ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তদানুসারে ইলিশ এখন বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। সাম্প্রতিক কালে ৬৮,৩০,৫৬৮ টন ইলিশ রফতানি করে ৪২৮৭ দশমিক৬৪ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সরকারের মৎস্য অধিদফতরের নানমুখী পদক্ষেপের ফলেই ইলিশের এই উল্লেখযোগ্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। গবেষকগণ ও সম্প্রসারণ ব্যক্তিবর্গ বলেছেন ইলিশের সহনশীল উৎপাদন বজায় রাখার লক্ষ্যে ডিমওয়ালা মা ইলিশ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই লক্ষ্যে ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর (১৯ আশ্বিন থেকে ৯ কার্তিক, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত মোট ২২ দিন দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার জলসীমায় মা ইলিশ ধরা নিষেধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। দেশে ইলিশের অভয়াশ্রম রয়েছে ছয়টি জেলায়, যেমন, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ¥ীপুর, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর যার মোট আয়তন ৪৩২ কিলোমিটার। ২০২১ সালে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে দেশের ৩৮টি জেলা ও ১৭৪টি উপজেলাকে। নিষেধাজ্ঞা আইন অমান্যকারীকে কমপক্ষে ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, সেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ লাখ ৫০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে; যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ যার চলতি বাজারমূল্য প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। তথ্য বলছে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে ভারতে ২০০২ থেকে ২০১৮ সালে ইলিশের জোগান যেখানে ৫৬ শতাংশ কমেছে, সেখানে বাংলাদেশে ১৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ করেছে এবং এর সময়সীমা ও মাছের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। মৎস্য সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ অনুযায়ী ১ নবেম্বর থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ ইঞ্চির ছোট জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা ফেব্রæয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মোট ৪ মাস প্রদান করা হয়। ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে প্রতি অর্থবছরে সরকার বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২ কোটি টাকা। বর্তমান অর্থবছরে সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত যা বর্তমানে ১৭৪টি উপজেলার প্রবাহিত নদীতে, পদ্মার শাখানদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওড়েও ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, একটি ইলিশ একসঙ্গে কমপক্ষে ৩ লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম ছাড়ে, এসব ডিমের ৭০-৮০ শতাংশ ফুটে রেণু ইলিশ হয় যার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত টিকে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে ইলিশে রূপান্তরিত হয়। ইলিশ দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রফতানি ছাড়াও ইলিশের নডুলস, স্যুপ ও পাউডার তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে ইতোমধ্যে তা বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। সরকার ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় ২৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে বলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, প্রকল্পের অনুমোদনের সময় ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে খাঁচায় অন্যান্য মাছ চাষের জন্য প্রশিক্ষণের তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ইলিশ আহরণে নিয়োজিত ৩০ হাজার জেলে পরিবারের জন্য সৃষ্টি করা হবে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ। জেলেদের ১০ হাজার বৈধ জাল বিতরণ ও প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হবে।
×