ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস বদলে দেয়া এক জয়

প্রকাশিত: ০০:৩৩, ২৭ অক্টোবর ২০২১

ইতিহাস বদলে দেয়া এক জয়

খেলা শেষ হতে না হতেই প্রধাণমন্ত্রী ইমরান খানের টুইট, ‘অভিনন্দন তোমরা পাকিস্তানকে গর্বিত করেছ।’ আতশবাজির রোশনাইয়ে আলোকিত করাচী থেকে লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি থেকে দুবাই। শারজাহ, আবুধাবিতে আনন্দ মিছিল। নিজেদের বিশ^কাপ ইতিহাসে এই প্রথম চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে জয়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান। ইতিহাস গড়লেন বাবর আজম। এমন ইতিহাস যা ১৯৯২Ñএর বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরানও পারেননি! যে কোন ঘারনার বিশ্বকাপে এই প্রথম কোন ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে হারাল পাকিস্তান! পারেননি মিসবাহ উল হক, শহীদ আফ্রিদি কিংবা সরফরাজ আহমেদ; অবশেষে ‘সেনসেশনাল’ বাবরের হাত ধরে প্রায় তিরিশ বছরের অপেক্ষার অবসান। দুবাইয়ে উন্মাদনার ম্যাচে ১০ উইকেটের রেকর্ডগড়া জয়ের পথে বিরাট কোহলিদের ¯্রফে উড়িয়ে দিয়ে টি২০ বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে পাকিস্তান। ১৯৯২-২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচ, ২০০৭-২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচÑ সর্বোপরি ১২ হারের পর অবশেষে বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতের বিপক্ষে এল পাকিস্তানের বহু কাক্সিক্ষত এই জয়! অধিনায়ক হিসেবে নিজের নামটা স্বর্ণের অক্ষরে খোদাই করে রাখলেন তরুণ বাবর আজম। প্রথমে ব্যাট করে শাহিন শাহ আফ্রিদির দুর্দান্ত বোলিংয়ে ভারত নির্ধারিত ২০ ওভারে তুলতে পারে মাত্র ১৫১ রান। জবাবে শুররু থেকেই নিখুঁত ব্যাটিং করে পাকিস্তান। ভারতীয় বোলারদের কোন সুযোগ না দিয়ে, ১৩ বল বাকি রেখে, কোন উইকেট না হারিয়েই নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায় পাকিস্তান। জাসপ্রিত বুমরাহ, ভুবনেশ্বর কুমার, বরুন চক্রবর্তীদের নিয়ে রীতিমতো ছেলে খেলা করলেন বাবর ও রিজওয়ানরা। রিজওয়ান ৫৫ বলে ৬ চার ও ৩ ছক্কায় ৭৯ এবং অধিনায়ক বাবর ৫২ বলে ৬ চার ও ২ ছক্কায় ৬৮ রানে অপরাজিত থাকেন। ১৭.৫ ওভারে দু’জনে মিলে তুলে নেন ১৫২ রান, যে কোন উইকেট জুটিতে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের এটি নতুন রেকর্ড। ম্যাচসেরার পুরস্কার পান শাহিন আফ্রিদি। ম্যাচের শেষে কীভাবে ভারতকে হারানোর পরিকল্পনা করেছেন, তা নিয়ে কথা বলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজম। অনায়াস জয় নিশ্চিত করা উদ্বোধনী জুটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘ওপেনার হিসেবে আমরা খুব সাধারণভাবে ব্যাট করে একটা বড় জুটি গড়তে চেয়েছি। যত সময় যাচ্ছিল, ব্যাটিং করা তত সহজ হয়ে যাচ্ছিল। ফলে আমরা ম্যাচের শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করতে চেয়েছিলাম এবং সেটা আমরা করেছিও। ভারতকে হারিয়েছি বলেই যে বাকি টুর্নামেন্ট আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে, বিষয়টি মোটেও এমন নয়। তবে এই ম্যাচ জয়ের আত্মবিশ্বাস সামনের ম্যাচগুলোতে আমাদের অনেক সাহায্য করবে। আমরা এক ম্যাচ এক ম্যাচ করে এগিয়ে যাব। এখনো এই টুর্নামেন্টের অনেক খেলা বাকি।’ ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের রেকর্ড খুব খারাপই ছিল। ১২ ম্যাচের সব কটিতেই হারার রেকর্ড নিয়ে কাল মাঠে নেমেছিল পাকিস্তান। কিন্তু খেলার আগে অতীত ইতিহাস মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন বাবর, ‘আমরা খুব ভালোভাবে এই ম্যাচের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম এবং অতীতের রেকর্ড নিয়ে কোন চিন্তাই করিনি। আমরা আমাদের অনুশীলন, বিশ্বকাপের আগের প্রস্তুতি ম্যাচ এবং ঘরোয়া লিগ থেকে প্রচুর আত্মবিশ্বাস পেয়েছি।’ শাহিন আফ্রিদি খেলার শুরুতেই রোহিত শর্মা ও লোকেশ রাহুলের উইকেট নিয়ে জয়ের ভিত গড়ে দেন। এরপর পাকিস্তানী অন্য বোলাররাও আঁটসাঁট বোলিং করে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের একমুহূর্তের জন্যও স্বস্তি পেতে দেননি। তাই বোলারদের প্রশংসা করতেও ভুললেন না টি২০ র‌্যাঙ্কিংয়ের দুইয়ে থাকা এই ব্যাটসম্যান, ‘দলীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এ জয় পেয়েছি। তবে বোলারদের ধন্যবাদ দিতেই হবে। শুরুতে ভারতের দ্রুত উইকেট পড়ে যাওয়ায় গোটা ম্যাচ আমাদের জন্য সহজ হয়ে গেছে। ফলে আমাদের স্পিনাররাও আত্মবিশ্বাস পেয়েছে এবং তারাও ভাল বোলিং করেছে। আমাদের প্ল্যান মোতাবেক আমরা মাঠে খেলতে পেরেছি বলেই আমরা জিততে পেরেছি।’ প্রথম ওভারে রোহিত শর্মা, তৃতীয় ওভারে লোকেশ রাহুল, ভারতের হারের পিছনে শুরুতে এই উইকেট হারানোকেই কারণ হিসেবে তুলে ধরেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। লজ্জার হারের পর সাংবাদিক বৈঠকে মেজাজ হারানো কোহলি শিশির অথবা দলগঠনকে দায়ী করতে রাজি নন। তাঁর মতে পাকিস্তান কোনও সুযোগই দেয়নি ভারতকে। ১০ উইকেটে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হারল ভারত। তবে কোহলী পড়ে থাকলেন প্রথম তিন ওভারে দুই ওপেনারকে হারানোর দুঃখ নিয়েই, ‘নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলতে পারিনি। পাকিস্তান আমাদের সব বিভাগেই হারিয়ে দিয়েছে। শুরুতেই তিন উইকেট হারালে কাজ কঠিন হয়েই যায়। শিশির পড়বে জানাই ছিল। ব্যাট হাতে পেশাদারদের মতো খেলল পাকিস্তান। যত সহজে ওদের ব্যাটার খেলেছে, এই পিচে খেলা ততটা সহজ ছিল না। আরও ১০, ২০ রান দরকার ছিল আমাদের। কিন্তু পাকিস্তানের দুর্দান্ত বোলিং আমাদের সেটা করতে দেয়নি।’ তবে এখনই ভেঙে পড়ছেন না কোহলি, ‘আমরা এখনই আতঙ্কিত হচ্ছি না। প্রতিযোগিতা সবে শুরু হলো। এটাই শেষ নয়।’ বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথম বার পাকিস্তানের কাছে হারল ভারত। এ বারের বিশ্বকাপে টস বড় নির্ধারক হতে পারে বলে মনে করছেন কোহলি, ‘টস বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে। আগে ব্যাট করলে অন্তত ১০,২০ রান বেশি করতেই হবে।’ অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি আলোর শহর দুবাইতে। ঝকঝকে ভারত, আর ‘ওয়েস্টার্ন ব্লকের’ কাছে অবহেলিত পাকিস্তান। এই ম্যাচ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীতে বার বার জয়ী হিসেবে নাম উঠে আসছিল ভারতের। আর বলা হচ্ছিল, কেবল ভারত ভুল করলেই পাকিস্তান জিততে পারে। তেমনটাই তো মনে করা উচিত। ভারতের ক্রিকেটাররা বিশ্বকাপের ঠিক আগে প্রায় এক মাস ধরে এই আমিরাতেই বিশ্বকাপের তিন ভেন্যুতে খেলেছেন আইপিএল। ১৫ জনের দলের প্রত্যেকে এই টুর্নামেন্টের জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে নিয়েছেন সেরা প্রস্তুতি। লোকেশ রাহুল, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, ঋষভ পন্থ, যশপ্রীত বুমরাহ, ভুবনেশ্বর কুমার, মোহাম্মদ শামি ও বরুণ চক্রবর্ত্তীকে নিয়ে সাজনো এক ভয়ঙ্কর ব্যাটিং- বোলিং দল। তাছাড়া বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে দাপটের সঙ্গে। অন্যদিকে পাকিস্তান! বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিতে তারা চেয়েছিল ঘরের মাঠে নিউ জিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি২০ সিরিজ খেলে। কত্ত আয়োজন, কত্ত নিñিদ্র নিরাপত্তা। ভিভিআইপি মর্যাদা দিয়ে নিউ জিল্যান্ডকে রেখে দিতে পেরেছে মাত্র কয়েক দিন। হুট করে নিরাপত্তা শঙ্কা দেখিয়ে সিরিজ শুরুর দিন পাকিস্তান ছাড়ে নিউজিল্যান্ড। তাদের দেখাদেখি ভিন্ন অজুহাতে ইংল্যান্ডও সফর বাতিলের আগাম ঘোষণা দেয়। ব্যস, পাকিস্তানের মাথায় হাত! কিন্তু তারা দমে যায়নি। ঘরোয়া টুর্নামেন্ট ন্যাশনাল টি২০ কাপে নীরবে প্রস্তুতি নিয়েছেন বাবর-রিজওয়ানরা। এতটা নীরবে যে কেউ তাদের খোঁজই নেয়নি। তবে প্রস্তুতি মন্দ যায়নি। বাবর ১ সেঞ্চুরি ও ২ হাফ সেঞ্চুরিতে ৬ ম্যাচে ২৮৬ রান করেন। মোহাম্মদ রিজওয়ানের ছিল দুটি হাফ সেঞ্চুরি। তারা দু’জনই তো ভারতকে হারিয়ে দিলেন ব্যাট হাতে। আর বল হাতে শাহীন আফ্রিদি ছিলেন দুর্দান্ত, যেমনটা ছিলেন ন্যাশনাল টি-টোয়েন্টি কাপে। ৬ ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়ে তৃতীয় সেরা বোলার। তার উপরে থাকা ইমরান খান ও আর্শাদ ইকবাল তো খেলেছেন তার দ্বিগুণ ম্যাচ। এমনই আকাশ-পাতাল তফাত নিয়ে ভারত আর পাকিস্তান পা রাখে সুপার টুয়েলভে। কিন্তু ফল কী হলো? যেভাবে ব্যাটে-বলে আর ম্যাচ পরিকল্পনায় নিখুঁত চেহারা দেখাল পাকিস্তান, তাতে বলা যায় ভারতকে টি২০ শেখাল তারা। প্রবল আত্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে জয় হলো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে প্রতিরোধ করার দৃঢ় মানসিকতার, যা পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের মনে তৈরি হতে শুরু করেছিল ঠিক আইপিএল শুরুর দুই দিন আগে থেকে। ১৭ সেপ্টেম্বর নিউজিল্যান্ড সিরিজ বাতিল করে। নতুন নির্বাচিত পিসিবি চেয়ারম্যান রমিজ রাজা তখনই তাদের আহ্বান জানান, এই উপেক্ষার কড়া জবাব বাবরদের দিতে হবে টি২০ বিশ্বকাপ জিতে!
×