ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

উন্নয়নের অভিগামিতায় জীবনের অভিঘাত

প্রকাশিত: ২১:৩২, ১২ অক্টোবর ২০২১

উন্নয়নের অভিগামিতায় জীবনের অভিঘাত

বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় নিয়তই এগিয়ে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির অগ্রগামিতায় মেগা কর্মপরিকল্পনা দুরন্ত বেগে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরিও করছে না। স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ সীমানায় লক্ষ্যমাত্রাকে জোর কদমে সামনের দিকে চালিত করছে। বহু কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু প্রত্যাশিত জগতকে আলোকিত অবস্থায় নিয়ে যেতে একেবারেই সময় নষ্ট করছে না। আর মেট্রোরেলের ধারাবাহিক উন্নয়ন দৃশ্যমান হওয়ার, উদ্দীপ্ত গতিময়তায় নতুন মাত্রা যোগ করছে। অর্থাৎ অবকাঠামো উন্নয়নযজ্ঞে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১২ বছর ধরে মহাকর্মপ্রকল্পগুলো তাঁর নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে নতুন অঙ্গীকার জনগণের সামনে তুলে ধরেন। সেগুলো আজ বাস্তবায়নের অনন্য ধাপে। সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পনায় সড়ক, মহাসড়ক, কালভার্ট এবং নিত্য নতুন সেতুর সংযোগ স্থাপনে যে আলাদা চিত্র তা শুধু উন্নয়নের শোভাবর্ধন নয়, বরং সাধারণ মানুষের জীবনমান সুরক্ষারও নিয়ামক শক্তি। আধুনিক ও ডিজিটাল বাংলা গড়ার নতুন স্বপ্নে বিভোর শেখ হাসিনা একটি উন্নত ও মানসম্মত দেশ গড়তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। আর সেখান থেকেই নতুন উদ্দীপনায় আধুনিকতার নির্মাল্যে যে সোনার বাংলা প্রধানমন্ত্রীকে কাক্সিক্ষত স্বপ্নে নিয়ে যায় সেটাই এখন আলোর মুখ দর্শনের সন্ধিক্ষণে। দেশটা সাধারণ মানুষের। তাদের মৌলিক অধিকার সংশ্লিষ্টদের কাছে নিয়ে যাওয়ার কঠোর প্রত্যয়ে তিনি যেন অনমনীয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষায় যেন ১৭ কোটি মানুষকে নিরাপদে রাখতে, একটি উন্নত জাতি গঠন করতে যা যা প্রয়োজন সবই প্রধানমন্ত্রী দুরন্ত গতিতে করে চলেছেন। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নের দীপ্ত শিখায় স্বীয় অবস্থানকে মজবুত করে যাচ্ছে। সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে বাংলাদেশ বিশ্বের নজরকাড়া। নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব ব্যতিরেকে দেশের সার্বিক উন্নয়ন দৃশ্যমান হয় না। ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং পিছিয়ে পড়া নারীরাও তাদের জীবনমান উন্নয়নে সব ধরনের পেশাকে হাতের নাগালে নিয়ে আসতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা অবারিত করে সর্বজনীন পরিবেশে প্রত্যেককেই বিভিন্ন কর্মসূচীর আওতায় নিয়ে এসেছেন। সেখানে নারী-পুরুষের ফারাক কোনভাবেই বিবেচিত হয়নি। নারীরা তাদের জীবনযাত্রাকে যে মাত্রায় অন্দরে এবং বাইরে অবাধ ও মুক্ত করেছেন সেখানে তাদের পিছিয়ে পড়ার দুর্বলতা তো মোটেই চোখে পড়ে না। বরং মানুষের মর্যাদায় নিজের জোরালো ভূমিকা রাখতে সব ধরনের কর্মে সম্পৃক্ত হতে এগিয়ে আসছেন। করোনার নৃশংস থাবায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়াটাও জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত। দুঃসহ সময় পার করতে হয়েছে গোটা বিশ্বকেও। বাংলাদেশে উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর ওপর অনভিপ্রেত বেড়াজাল আবর্তিত হলে বিভিন্ন সময় সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাও জাতিকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। অর্থনীতির খাত বিভিন্নভাবে স্থবিরতার জালে আটকা পড়লেও সাময়িক বিরতিতে সব কিছুর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে প্রাসঙ্গিক সব পদক্ষেপই নেয়া হয়। তবে জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর যে দীর্ঘস্থায়ী ক্রান্তিকাল আঘাত হানে সেটাই মনে হয় করোনাকালের সবচেয়ে নির্মম পরিস্থিতি। স্বাস্থ্য খাতেরও হরেক রকম সঙ্কট মাথাচাড়া দিতে সময় লাগেনি। দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, অনমনীয় দেশাত্মবোধ আর জনগণের প্রতি অকৃত্রিম দায়বদ্ধতায় সরকারপ্রধান সব কিছু সামলে দেশ ও জাতিকে অনন্য পথনির্দেশনায় শক্তি ও সাহস জোগাচ্ছেন। উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির দেশ গঠন প্রক্রিয়ায় হরেক রকম অশুভ সঙ্কেত যাত্রাপথকে নিষ্কণ্টক হতে দেয় না। সেটা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও এমন অসহনীয় পর্যায়কে মোকাবেলা করেই তাদের আজকের অবস্থান মজবুত করেছে। নিত্য নতুন আবিষ্কার যেমন একটি পিছিয়ে পড়া দেশকে সামনের দিকে নিয়ে আলোকিত করে পাশাপাশি নানামাত্রিক সঙ্কটও বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় মাথাচাড়া দেয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের ফলে সারা ইউরোপে এমন বিপথগামী সম্মুখ সঙ্কট বিদ্যমান সমাজকে অসহনীয় করে তুলেছিল। কিশোর অপরাধ বেড়ে যায়, নারী নির্যাতন নিত্য ঘটনাপঞ্জিকে আলোড়িত করতে থাকে। আর শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বিত্ত-বৈভবের ফারাক ছাড়াও সংশ্লিষ্ট কিছু দুর্ভোগ জনজীবনকে অস্থির করে তোলে। বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানী এসব টানাপোড়েনে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করে কতিপয় সিদ্ধান্তও তুলে ধরলেন। এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানী অগবার্নের মতামত উল্লেখ করা যায়। তিনি সুচিন্তিত মতামত দেন- প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে যত তাড়াতাড়ি সমাজবদ্ধ মানুষ আয়ত্তে আনতে পারে মানসিক চেতনাকে সে মাত্রায় এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না। ফলে বিজ্ঞান এবং চেতনায় ফারাক দৃশ্যমান হয়। আর সামাজিক সমস্যাগুলো সেখান থেকেই উদ্ভূত বলে তিনি বদ্ধমূল ধারণা ব্যক্ত করেন। যেমন বস্তুগত সংস্কৃতি দালান, বহুতল ভবন, আসবাবপত্র থেকে বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন অর্জন মানুষ তার নিত্য প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পেছনের দিকে ফিরেও তাকায় না। কিন্তু তার মনোজগত, মানসিক বিকাশ খুব বেশি তাড়াতাড়ি এগিয়েও যায় না। এতদিনের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, জীবনাচরণ, সংস্কৃতি, অভ্যাস, রুচি পরিবর্তন করতে অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। ফলে প্রযুক্তির সঙ্গে চিরায়ত ধারণার অসম সংযোগ সামাজিক সমস্যাগুলো খুব দ্রæত দৃশ্যমান হতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেয়া এমন সামাজিক তত্ত¡ আজও আমরা অতিক্রম করতে পারলাম কই? তথ্যপ্রযুক্তির সমৃদ্ধ বিশ্বে এখনও চিরায়ত মৌলবাদ, পশ্চাৎপদ অপসংস্কৃতি ছাড়াও নতুন যুগকে ক্ষতবিক্ষত করার মতো গতানুগতিক মূল্যবোধকে যে মাত্রায় লালন ধারণ করা হয় সেটা আধুনিক সময়কে তার মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেয়। নারীদের আজও লড়াই-সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে তাদের মৌলিক অধিকারের লক্ষ্যমাত্রায়। বাল্যবিয়ে ঠেকাতে আধুনিক যুগেও প্রায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করার যে আন্দোলনে নেমেছিলেন একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও বহু পুরনো সামাজিক বিধি বাল্যবিয়ে রোধ করতে এখনও সম্মুখ সমরে যেতে হচ্ছে। সেই বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, একজন অবোধ বালিকাকে বিয়ে দিতে যতখানি অর্থ খরচ হয় তার অর্ধেক ব্যয় করলে কন্যা সন্তানটি লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। শুধু তাই নয়, উপার্জনের চেষ্টা চালানোও সাধ্যের মধ্যেই থাকে। বর্তমানে করোনা অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে এলেও যে চিরস্থায়ী আঁচড় বসিয়েছে সেখান থেকে বের হয়ে আসা সময়সাপেক্ষ। শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়া ছাড়াও কিশোর অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এটি দেশের জন্য এক বড় ধরনের বিপদ। আবার তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক বলয়ে অনভিপ্রেত আসক্তি বেড়েছে। অথচ তাদের মাঝে জীবন গড়ার আকাক্সিক্ষত স্বপ্নের কোন প্রভাব তেমন দেখা যাচ্ছে না। নতুন আধুনিক উদ্ভাবনকে প্রতিদিনের জীবনের অনুষঙ্গ করতে গেলে সে মাত্রায় মানসিক বিকাশকেও এগিয়ে নেয়া সময়ের অপরিহার্য দাবি। প্রযুক্তি আর মনোজগতের সুষ্ঠু সমন্বয় আধুনিক ও মানসম্মত জীবন গড়ার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। নিত্যনতুন বিজ্ঞানকে দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ ছাড়াও জ্ঞান ও শিক্ষার্জনের নিয়ামক হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশ এখন নতুন সময়ের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সঙ্গত কারণে বিভিন্ন সমস্যাও পরিস্থিতিকে বেসামাল করে তুলছে। সেখান থেকে বেরুনোর পথ কোনভাবেই অবরুদ্ধ নয়। জীবনকে এগিয়ে নেয়ার প্রাসঙ্গিক আয়োজন, শক্তি সামনেই থাকে। আবার বিভিন্ন অপশক্তির কালো হাতছানি ও মসৃণ রাস্তাকে কণ্টকাকীর্ণ করে রাখে। সন্তর্পণে সেসব অনাবশ্যক চক্রব্যুহকে অতিক্রম করতে পারাটাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা তৈরির কঠিন প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আধুনিক ও প্রযুক্তির নতুন বাংলাদেশ গড়ার অনমনীয় অঙ্গীকার একাত্ম হয়ে আজ দেশ বর্তমান অবস্থানে এসেছে। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় যা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে। দেশের ভাবী কারিগররা উদ্দীপ্ত চেতনায় জোর কদমে এগিয়ে যাক- এটাই প্রত্যাশা। লেখক : সাংবাদিক
×