ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গৌতম পাণ্ডে

নৃত্যযোগী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ০০:১৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

নৃত্যযোগী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়

নৃত্য যার ধ্যান-জ্ঞান। যার নৃত্যে ফুটে ওঠে বাংলাদেশ তথা বাঙালী সংস্কৃতি। আবার কখনও মূর্ত হয়ে ওঠে নৃত্যের আদি সৃজনশীল কল্পতরু। এক কথায় বলা যেতে পারে নৃত্যযোগী। তিনি হলেন- দেশের প্রতিথযশা নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। নৃত্যের সঙ্গে তার বসবাস দীর্ঘদিন। শরীরীয় এই ভাষাকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। নৃত্যের অমিয়ধারায় নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি নৃত্যলব্ধ জ্ঞানকে বিলিয়ে দিয়ে চলেছেন হাজারো শিক্ষার্থীর মাঝে। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃত্যবিষয়ে অর্জন করেছেন স্নাতক ডিগ্রী। তিনি কথাকলি ও মণিপুরী নৃত্যে বিশেষভাবে পারদর্শী। কলকাতার মণিপুরী নর্তনালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক গুরু বিপিন সিংহ ও শ্রীমতি কলাবতি দেবীর তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা অর্জনের পর তাকে ‘নর্তন বিশারদ’ উপাধি দেয়া হয়। শান্তি নিকেতন ও মনিপুরী নর্তনালয় দুটোতেই তিনি ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান। ভরতনাট্যম, ওড়িশি এবং বিভিন্ন লোকজ নৃত্যেরও তিনি বিশেষজ্ঞ। নৃত্যনন্দন নামে একটি নাচের শিক্ষালয় তিনি পরিচালনা করেন। তিনি বর্তমানে ছায়ানটের নৃত্য বিভাগের প্রধান। নৃত্যকলা প্রাচীনতম এবং গুরুমুখী বিদ্যা। ভারতে প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর শিক্ষা লাভ করে অনেকেই নৃত্যধারায় নতুন গতি বয়ে এনেছেন, তাদেরই একজন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারই সুযোগ্যাকন্যা দেশের উদীয়মান নৃত্যপ্রতিভা সুদেষ্ণা স্বয়ম্প্রভা তাথৈ। বাবা প্রতিথযশা ব্যাচিক শিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা গুণী নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ নিয়ে বেড়ে উঠছেন তাথৈ। তুখোড় এই নৃত্যশিল্পী ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে রবীন্দ্র ভারতীতে পড়তে যান। সেখানে ছাত্রী হিসেবে অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছেন তাথৈ। ফাইন আর্টস ফ্যাকাল্টির সাতটি নৃত্য বিভাগের সব শিক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এমএ (নৃত্য) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গোল্ড মেডেল অর্জন করেন তাথৈ। মণিপুরী ও ভরত নাট্যম দুই ঘরানার নাচেই তাথৈ সমসাময়িক নৃত্যশিল্পীদের বলা যায় ছাড়িয়ে গেছেন। শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে থাকেন, নাচ আমার জীবনের প্রথম সন্তান, আর তাথৈ আমার কাছে দ্বিতীয় সন্তান। আমি কাউকেই ছোট-বড় হিসেবে প্রাধান্য দেইনি। বরং দুটো সন্তান আমার কাছে একই রকম সমান। এই দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন; উচ্চাঙ্গ নৃত্যের পরিবেশনা দিয়ে কাঁপাচ্ছেন মঞ্চও। এই দুজন যখন মঞ্চে ওঠেন তখন আর সম্পর্ক মা-মেয়ের থাকে না। দুই শিল্পী উচ্চাঙ্গ নৃত্যের নিপুণ মুদ্রায় মন্ত্রমুগ্ধ করেন দর্শককে। প্রাণঘাতী করোনার ছোবলে স্থবির হয়ে পড়ে গোটা সংস্কৃতি অঙ্গন। চলমান বৈশ্বিক সঙ্কটের এই অবরুদ্ধ দিনে ভাল নেই আমাদের শিল্পীরাও। শিল্পেই যাদের জীবন চলে তারা আজ কর্ম হারিয়ে দিশেহারা। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে মানসিক অবসাদে ভুগছেন অনেকেই। এই অবসাদ থেকে মুক্ত হতেই অনেক সংগঠন অনলাইনে আয়োজন করছে নানা অনুষ্ঠান। এই আয়োজনে দেশের নৃত্যশিল্পও রেখেছে বিশেষ অবদান। এই আয়োজন ও সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আনন্দকণ্ঠ’র সঙ্গে কথা বললেন বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনের প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষক শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, করোনাকালীন এই সময়টাতে অনেকেই মানসিক অবসাদে ভুগছে। এই অবসাদ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ পছন্দের কাজে ডুবে থাকা। যে কাজটার প্রতি ভালবাসা আছে সেটাতে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে নিজের চর্চাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যেমন মঞ্চে বা অনুষ্ঠানে নাচ করেও নাচ নিয়ে থাকা যায়। বললেন, অনেকেই এখন নাচের অনলাইন ক্লাস করছে, কিন্তু আমি সেটা করোনাকালীন লকডাউনের সাথেই শুরু করে দিয়েছিলাম। তার প্রধান কারণ ছিল আমার শিক্ষার্থীরা। আমরা বড়রা মানসিকভাবে অনেক শক্ত। মনটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অনেকেই বয়সে নবীন বা শিশু। আবার অনেকেই তরুণ। তাদের মনের জোর কম। এই অবস্থায় তারা মনের দিক থেকে ভেঙ্গে পড়ছে, অবসাদে ভুগছে। তাই তাদের ব্যস্ত রাখতেই আমি একেবারে শুরু থেকেই অনলাইনে ক্লাস চালু করে দিয়েছিলাম। পাশাপাশি আমি নতুন একটা প্রযোজনার পরিকল্পনা করেছি-যেটার প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ অনেকটা শেষ করেছি। নৃত্য বিষয়ে চলতি বছরের কাজ নিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার প্যারেড স্কয়ারে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষপূর্তিতে যে অনুষ্ঠান হলো দশ দিনব্যাপী, সেখানে ২৫ মার্চ আমার অনুষ্ঠান ছিল। ‘গণহত্যার কালরাতে ও আলোকের অভিযাত্রা’ শিরোনামের শ্রদ্ধেয় মফিদুল হকের একটা পাণ্ডুলিপি হাতে পাই। সেটাতে আমি অসাধারণ কিছু গানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি এতে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আমার নৃত্য পরিকল্পনা, পরিচালনা ও কোরিওেগ্রাফিতে ৩৫ জন শিল্পীদের নিয়ে বড় একটা কাজ করেছি। তার আগে আমরা করোনাকালীন শরত উৎসব করেছি। তারপর একটু থেমে গিয়েছিলাম। পরে ২৫ বৈশাখ শিল্পকলা একাডেমিতে রবীন্দ্রজয়ন্তীর বিশেষ অনুষ্ঠান করি। নজরুলজয়ন্তীও করেছি। তারপর থেকে অনলাইনে প্রচুর কাজ আমি এরমধ্যে করেছি। বেশ কয়েকটি বর্ষার অনুষ্ঠান করেছি। তার মধ্যে ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তপন মাহমুদের বৈতালিক। তাছাড়া বিদেশে অনেকগুলো সংগঠনের অনুষ্ঠান করেছি অনলাইনে। আমার খুব ভাললাগছে যে ওদের কাছে আমরা এই কয়টা দিন পৌঁছতে পেরেছি। এমনিতে অন্য সময় হলে আমাদের নাচ বাইরের দেশের লোক দেখার সুযোগ পেত না। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালীরা। অনলাইন অনুষ্ঠান হওয়ার কারণে দেশে ও বিদেশের বহু বাঙালীরা দেখে। তাতে একটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। তারা বলছেন যে বাংলাদেশের নাচ এত ভাল এত উন্নত! সোমবার কানাডার একটি টেলিভিশনে দেখলাম তারা আমাদের নাচ ও কোরিওগ্রাফির প্রচুর সুনাম করছে। এভাবে আমরা কিন্তু অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছি। পরিস্থিতি পাল্টে গেলেও আমাদের কাজটা থেমে নেই। সোমবার যে কাজটি করলাম সেটা হচ্ছে, শিল্পকলা একাডেমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান করছে তারই একটা অংশ। সেটার শুরুতে আমাদের নাচ থাকবে। সেটার রেকর্ডিং করে পাঠালাম। ইতোমধ্যে ছায়ানটের শরত উৎসব সবগুলো অনুষ্ঠান করেছি। পরিস্থিতি এখন একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। এতদিন অনলাইনেই ক্লাস নিচ্ছি। আমরাও ভাবছি আগের মতো করে না হলেও আস্তে আস্তে সীমিত আকারে নাচের স্কুলগুলো খোলা যায় কিনা। মঞ্চে যদি ধীরে ধীরে কাজ করা যায় সেটাও নিয়ে ভীষণভাবে ভাবছি। ক্লাস কিন্তু পুরোদমে অনলাইনে চলছে। ভারতে তড়িৎ সরকার ব্যালে ট্রুপ আয়োজিত আন্তর্জাতিক বর্ষা উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তড়িৎ সরকার ব্যালে ট্রুপ আয়োজন করেছিল আন্তর্জাতিক বর্ষা উৎসব। ১৮ জুলাই থেকে শুরু হয়ে টানা এক মাস চলে এই উৎসব। এতে প্রাধান্য পেয়েছে মোট ৭৫ জন শিল্পীর নাচ, গান ও কবিতা পাঠ। উৎসবের বড় পর্বটি ছিল নৃত্যানুষ্ঠান। এতে আমি আর তাথৈ রবীন্দ্রনাথের ‘এসো শ্যামল সুন্দর’ ও ‘এসো এসো ওগো শ্যাম ছায়াঘন দিন’ গানের সঙ্গে নাচ করি। ভারতে যে সম্মাননা দেয়া হয় সে সম্পর্কে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, কলকাতার মহানায়ক উত্তম মঞ্চে আমাকে সম্মাননা দেয়া হয়েছিল। এ মঞ্চে বসেছিল দুই বাংলার মিলনমেলা। অনুষ্ঠানে ‘প্রয়াস সম্মাননা-২০১৯’ দেয়া হয় আমাকে। ভারতের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী অভিরূপ সেনগুপ্তের নৃত্যসংগঠন আদ্যকলা তীর্থম এবং প্রয়াস যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন খ্যাতিমান অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, পরিচালক রেশমী মিত্র ও ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্র পাল প্রমুখ। নতুনরা নাচকে কোন্্ভাবে নিচ্ছে এমন প্রশ্নে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ইয়াং জেনারেশন নাচটাকে দুভাবে নিচ্ছে। সুযোগ পাচ্ছে কাজ করছে। আরেকটা হচ্ছে পাশ্চাত্যের নাচটা করতে গিয়ে ওরা কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিটা ভুলে যাচ্ছে। আমি বলব, যে পাশ্চাত্যের নাচটা আমিও ব্যবহার করি কিন্তু আমি আঙ্গিকটাকে পাল্টে ফেলি। আমি স্বাধীনতার অনুষ্ঠানেও ব্যবহার করেছি পাশ্চত্যের নাচ। সেখানে আঙ্গিকটা পরিবর্তন করে আমার মতো করে করেছি। পোশাকেও আমি আমার ইচ্ছাটাকে বেছে নিয়েছি। আমি একেবারেই পাশ্চাত্যের নাচকে খারাপ বলি না। আমার খুব কষ্ট হয় যখন দেখি কেউ কেউ দেশীয় নৃত্যে প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি পরে অদ্ভুতভাবে পাশ্চত্যের অঙ্গভঙ্গি করে তখন একটু খটকা লাগে। তবে আগের তুলনায় শাস্ত্রীয় নৃত্যের চর্চা অনেক বেড়েছে। দেশের অনেকই ইন্ডিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সেই আঙ্গিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আমরা ছায়ানট থেকেও নতুনদের মধ্যে শাস্ত্রীয় নৃত্য সম্পর্কে আরও বেশি প্রশিক্ষণ দেয়ার চেষ্টা করছি। এই নৃত্য প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে আমাদের দেশেও অনেক শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী তৈরি হচ্ছে।
×