ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: ০০:১৬, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে শিক্ষার্থীরা

দীর্ঘ ১৭ মাস বন্ধ থাকার পর ১৩ সেপ্টেম্বর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলে গেল। স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণায় বেশির ভাগ অভিভাবকই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বাচ্চাদের শিক্ষাজীবনের বন্ধ্যত্ব কেটে যাওয়ায় অধিকাংশ মা-বাবাই খুশি। পাশাপাশি অভিভাবকদের মাঝে একটা উদ্বেগের ছাপও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ দেশ এখনও করোনামুক্ত হয়নি। দীর্ঘদিন বাসায় বসে থাকায় বাচ্চারা নানান ধরনের মানসিক, শারীরিক অস্থিরতায় ভোগছিল। লাগাতার স্কুল বন্ধ থাকার কারণে একজন শিক্ষার্থীর স্কুল, কোচিং, হোম ওয়ার্ক, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চার মতো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ে। এখন স্কুল খুলে দেয়ায় তাদের মাঝে স্বস্তির ভাব দেখা যাচ্ছে। কয়েকজনের ভাষ্যমতে বাচ্চাদের নিয়মিত কাজের কোন রুটিন না থাকায় তারা ডিপ্রেশনের মধ্যে পড়েছিল। উচ্ছৃঙ্খলতা কমিয়ে দিয়ে ছেলে-মেয়েরা কিরকম চুপচাপ হয়ে পড়েছিল। প্রথম দিকে গল্পের বই, ভিডিও গেম, বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং ইত্যাদিতে ভালভাবেই সময় কাটাচ্ছিল। একটা আনন্দময় ভাব ছিল প্রথম কিছুদিন। কিন্তু পরে যখন দেখে এ ছুটি আর শেষ হয় না, তখনই অনেক শিশু-কিশোর ঝিমিয়ে পড়ে। নানা ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ তাদের মধ্যে দেখা যায়। আমার নাতনি শ্রেষ্ঠা প্রায়ই বলত, ভাই, স্কুল কবে খুলবে? এরপর যখন দেখা গেল স্কুল আর খুলছে না তখন বলত, ভাই, আমাদের স্কুল কি আর কোনদিন খুলবে না? এরপর আর কিছুই জিজ্ঞাসা করত না। একদম চুপচাপ হয়ে গেল। এখন স্কুল খুলে যাওয়ায় আমার মতো অন্যান্য অভিভাকও নিশ্চিন্ত। আবার তারা তাদের নিজস্ব ভুবনে ফিরে যাবে, অভিভাকদেরও সন্তানদের নিয়ে বাড়তি চাপ নিতে হবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় উদ্দেশ্যবিহীন জীবনচর্চা থেকে স্বাভাবিক জীবনে নিজেদের মানানসই করতে শিক্ষার্থীদের একটু সময়ের প্রয়োজন হবে। প্রথম দিকে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাড়া অন্যদের জন্য সপ্তাহে একদিন ক্লাস একটি ভাল সিদ্ধান্ত। এতে করে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলজীবনে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে একটু সময় পাবে। একদিকে চাপ কম থাকবে, অন্যদিকে মুক্তির আস্বাদ পেতে উপযোগী করার সময় পাবে। একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ।’ অধ্যয়নের জন্য আদিকাল থেকেই গুরুগৃহ, মক্তব, বর্তমানকালের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আদর্শ স্থান। সম্মিলিতভাবে পারস্পরিক ভাব বিনিময়, আনন্দ, ফুর্তি ইত্যাদির সঙ্গে লেখাপড়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানসিক বিকাশ, মন ও দৈহিক গঠনে সম্মিলিত পঠন-পাঠন অপরিহার্য। অনলাইন ক্লাসে ডিজিটাল ডিভাইসে দেখা-সাক্ষাৎ হলেও সশরীরে আলাপ-আলোচনা, দেখশোনা, হাসিঠাট্টা, ঠেলাধাক্কা, শিক্ষকের বকা খাওয়া, কারিকুলামের বাইরের গান-বাজনা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এগুলোর মজাই আলাদা। আবহমানকাল থেকে একটানা পড়ার একঘেয়েমি দূর করে বৈচিত্র্যের মাধ্যমেই ছাত্রছাত্রীদের আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান চলছে। অন্যদিকে, স্কুল খুলে দেয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। সরকারী এবং এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের অনেকের মধ্যেই ভাবটা হলো, ভালই তো চলছিল, স্কুলে গিয়ে বকবক না করে ঘরে বসে আরামে-আয়েসে মাস মাস বেতন-ভাতার টাকাটা আপসে চলে আসত, দৌড়ঝাঁপ ছিল না। বেতন তোল, মন মতো বাজার কর, খাও, দাও, ঘুমাও, ধরাবাঁধা কাজের তাগিদ নেই; অফুরন্ত বিশ্রাম। আরেক ধাঁচের শিক্ষক আছেন যারা কাজ ছাড়া থাকতে পারেন না। এদের মাঝে কারও কারও সময়কে সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে। ছাত্র মহলে রসকষহীন স্যারকে দেখা গেছে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে ফেসবুকে ভাইরাল করছেন। কেউ কবিতা লিখছেন, সাহিত্য চর্চা করছেন। বৌ-ছেলেমেয়ে, নাতি-পুতিদের সঙ্গে কত নিরস স্যারকে বিজলি হাসিতে সামাজিক মাধ্যমে নানা ভঙ্গিমায় ফটো ছাড়তে দেখা গেছে। আবার ভাইরাসের ভয়ে গৃহকর্মীকে ছাঁটাই করে অনেক শিক্ষক-কর্মচারীকে বৌয়ের সঙ্গে হাঁড়ি-পাতিল মাজা, সবজি কুটা, ঝাড়মোছ করা ইত্যাদি ঘরকন্না কাজে শামিল হতে দেখা গেছে। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে ঘরের কাজ করায় আমাদের পারিবারিক বন্ধন মধুর হয়েছে; এটা মহামারীর ইতিবাচক দিক। উল্লেখ্য, অভিভাবকগণ সন্তানদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে এত উদ্বিগ্ন যে, তারা নিজেরাও এ উদ্বেগ সৃষ্টির দায় এড়াতে পারেন না। কারণ যে কোন স্কুলের সামনে গেলে অভিভাবকদের খোলা মুখে পানের বাটা খুলে খোশগল্পের আসর দেখলে মনে হয় কোথায় সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি? ফলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যে অভিযোগের বিষয়ে তারা এত তৎপর কখনও কখনও সে অভিযোগে তারা নিজেরাই অভিযুক্ত। মুদ্রার অন্য পিঠে ভিন্ন চিত্র। দেশের প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারী স্কুল-কলেজের ছয় লাখ শিক্ষক-কর্মচারী প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণায় অভিশপ্ত জীবন হতে মুক্ত হয়ে আবার নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। ছাত্রছাত্রীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে যায়। অনেক শিক্ষক ছাঁটাই হয়ে যান। বেঁচে থাকার তাগিদে এদের অনেকেই পরিবার বাড়িতে পাঠিয়ে কেউ ভ্যানে সবজি বিক্রি, কেউ বাইক চালানো, কেউবা সিকিউরিটির চাকরি ইত্যাদি ভিন্ন পেশা বেছে নেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে সম্মানবোধ গৌণ হয়ে যায়। বন্ধ প্রতিষ্ঠানে অনেকে থাকার ঠাঁই খুঁজে নেন। কিছুদিন আগে এক টিভি চ্যানেলে দেখা যায়, নন-এমপিওভুক্ত এক কলেজের ইংলিশের অধ্যাপক একনিষ্ঠচিত্তে ফুটপাথে কাস্টমারদের চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছেন। অবশ্য এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে কিছু সময় লাগবে। সব থেকে আশার কথা, শিশুরা যেভাবে মাতৃ ক্রোড়ে, বন্যরা বনে, ঠিক সেভাবে শিক্ষাঙ্গনই আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণের বরণীয় আদর্শ ঠিকানা। সব থেকে বড় কথা, শিক্ষাঙ্গন খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মনে যেন নতুন কোন ভীতির সঞ্চার না হয়। একটা আনন্দঘন পরিবেশে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে নিতে আমাদের শিশু-কিশোররা যেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক, অভিভাবক, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনামাফিক ব্যবস্থা নিতে হবে। আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে পারছি না। লাগাতার বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী কিন্তু জীবিকার তাগিদে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়েছে। স্কুল খুলে দেয়ায় তারাও কিন্তু নিজস্ব ভুবনে ফিরে আসার জন্য আশায় বুক বেঁধে আছে। তাদেরকে আবার স্বপ্নের আঙ্গিনায় ফিরিয়ে আনতে সরকার, এনজিও, সমাজসহ সকলকে উদ্যোগী হতে হবে। লেখক : সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট
×