ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে কোরবানির ঈদ

প্রকাশিত: ২০:০১, ২০ জুলাই ২০২১

করোনাকালে কোরবানির ঈদ

দেশ এখন করোনার মহাদুর্বিপাকে অস্থির, দিশেহারা। শনাক্ত এবং মৃত্যুহারের উর্ধমুখী সত্যিই এক চরম বিপর্যয়। এক সময়ের রাজধানীকেন্দ্রিক এই করোনা সারা বাংলাদেশের জেলা-উপজেলায় তার বহুল সংক্রমণের দাপট নিয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। সীমান্তবর্তী জেলা থেকে শুরু করে গ্রামে-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চল এই সর্বগ্রাসী ব্যাধিটি তার বহুবিধ বৈশিষ্ট্য রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জনগণকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। আর সাধারণ মানুষ যারা গত দেড় বছর যাবত করোনার নৃশংস ছোবলকে মোকাবেলা করেও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়মবিধিকে আজও অভ্যাসে পরিণত করতে পারেনি। ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়া রোগটি গণমানুষের মধ্যে শঙ্কিত অবস্থা তৈরি করতে পারেনি এমন চিত্রই দৃশ্যমান হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা, সতর্ক-সাবধানতা না আসলে কিভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধিগুলো নিশ্চিত করা যাবে তাও এক অসম্ভবের পর্যায়ে। সরকারী আদেশ-নির্দেশ, পরামর্শ কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করছে না জনগোষ্ঠী। কঠোর লকডাউনের মধ্যে যানজটের যে দৃশ্য অবলোকন করা গেছে তাও দেশের জন্য নিরাপত্তার হুমকি। কারণে-অকারণে মিথ্যা অজুহাত দিয়ে ঘরের বাইরে থাকাটা সামনে আসতে খুব বেশি সময়ও লাগছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার ঠুনকো অজুহাতে বাজার-ঘাটে যে মাত্রায় ভিড় সেটাও করোনার বহুল সংক্রমণকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব জায়গায়ও মুখে মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্বও সেভাবে মানা হচ্ছে না আর বিচ্ছিন্নভাবে ছোটখাটো জমায়েত হতেও সময় লাগছে না। আবার কোরবানির ঈদের জন্য নতুন করে অবরুদ্ধতার কঠিন জাল হাল্কা করার সুবাদে মানুষের মধ্যে যেন নতুনভাবে কর্মতৎপরতা শুরু হওয়ার দৃশ্য বেড়েই যাচ্ছে। তার ওপর গরু-ছাগলের হাট বসা মানেই মানুষের প্রাসঙ্গিক সমাবেশকে অনেকটা এগিয়ে দেয়াও। কোরবানির ঈদে পশুরহাট প্রয়োজনীয় বিষয় হলেও শপিং মলগুলো কিসের তাগিদে খোলা হয়েছে তা ধারণার অতীত। এই সময় নতুন কাপড় কেনার তো কথা নয়। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে করোনার মহাসঙ্কটকালে দোকানপাট খুলে দেয়া কতখানি বিবেচনা সঙ্গত তাও খতিয়ে দেখা জরুরী। এ ছাড়াও গণপরিবহনের ওপর বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে যে মাত্রায় দেশের সর্বত্র আসা-যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে তাও করোনা দুর্ভোগকে কতখানি উস্কে দেবে তেমন ভাবনাও আসা জরুরী ছিল। কারণ লকডাউন কমিয়ে দেয়ার পর মানুষ দেশের বাড়িতে যাওয়ার যে চাপকে পরম আগ্রহে স্বাগত জানায়, সেটাও লুকানো-ছাপানো কোন ব্যাপারই নয়। যদিও বর্তমানে গ্রামে-গঞ্জে অজপাড়াগাঁয়ে করোনা তার বিধ্বংসী থাবা নিয়ে মানুষের ওপর চড়াও হচ্ছে তাও দিবালোকের মতো স্পষ্ট। নতুন করে লকডাউন শিথিল করাতে নাড়ির টানে দেশের বাড়িতে যাওয়ার যে উৎসব-আয়োজন তা যত কষ্টেরই হোক না কেন থামানো একেবারে দুঃসাধ্য। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধির আওতায় যা যা করতে বলা হয়েছে তাও রক্ষা করা অসম্ভবের পর্যায়ে। এমন তথ্যই প্রায়শ গণমাধ্যমে উঠে আসছে। দেশের বাড়িতে যাওয়াই শুধু নয় ফেরার চরম দুর্ভোগও আমলে নেয়া সময়ের অনিবার্য দাবি। কারণ অন্যান্য জেলা-উপজেলা থেকে কর্ম ও আবাসস্থলে ফিরে আসতে গেলে করোনাকেও যে কি মাত্রায় বয়ে আনতে হবে সেটাও সময় বলে দেবে। সময় বলা ঠিক নয় বরং দুঃসময় বলাটাই সঙ্গত। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি এমনিতেই বেসামাল-পরবর্তীতে তা কোন আশঙ্কার স্তর পাড়ি দেবে তেমন ক্রান্তিকালও আমাদের মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এমনিতে ঢাকায় মৃত্যুর হার অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বেশি যা বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ঢাকাগামী হওয়ার কারণেই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে। জরুরী এবং সুচিকিৎসার তীব্র আকাক্সক্ষা থেকে মরণাপন্ন রোগীরা ঢাকার মানসম্মত হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছে। আইসিইউ এবং অক্সিজেনের সঙ্কট দেশব্যাপী এক চরম অসহায় অবস্থা। ঢাকায় করোনার চিকিৎসা উন্নত মানের হলেও অনেক সীমাবদ্ধতাও শঙ্কিত হওয়ার মতোই। কারণ ঢাকায় রোগীর সংখ্যা অত্যধিক বাড়লে জরুরী সেবা এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি হতেও সময় লাগবে না। ইতোমধ্যে তা করুণভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। রাজধানীকেন্দ্রিক হাসপাতালগুলো এখন করোনা রোগীরভারে বিপন্ন, দিশেহারা। শুধু তাই নয় আরও ভিন্নমাত্রার জটিল রোগের চিকিৎসা সেবাও থেমে যাওয়ার উপক্রম। একে তো বহুল সংক্রমণ এই রোগটির অত্যধিকভাবে বিস্তার হওয়ার দুর্যোগ আমরা এখনও পাড়ি দিচ্ছি। আর চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলোর অবস্থা তো বলাই বাহুল্য। আবার স্বাভাবিক, নিরাময়যোগ্য রোগ-বালাইও হরহামেশা দৃশ্যমান হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। সেখানে কোভিড ছাড়াও বিপন্ন রোগীর চিকিৎসা জরুরী হয়ে যায়। সে সময় অক্সিজেন থেকে আইসিইউর মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম অত্যাবশ্যক হয়ে যায়। সঙ্গত কারণে কোভিড-নন কোভিড সংশ্লিষ্ট সব রোগীই পড়ে চরম বিপাকে। অতি স্বাভাবিক এবং সাধারণ রোগ-বালাইও চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় দুঃসহকাল অতিক্রম করছে। এমন অবধারিত বিপর্যয়কে আরও হুমকির মুখে নিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবিধি না মানার চরম উপেক্ষা আর অবজ্ঞা। নিরাময় কিংবা প্রতিষেধক ওষুধই শুধু নয় তারচেয়ে বেশি দরকার প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়া। যথাসম্ভব সমস্ত বিধিনিষেধ অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব হিসেবে যাপিতজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। তেমন প্রাসঙ্গিক স্বাস্থ্যবিধির অপরিহার্য নিয়মকানুনের ব্যত্যয় ঘটলে পরিস্থিতি কি ভয়ঙ্কর হবে তা ভাবাও কঠিন। করোনার আকাল শুরু হওয়া থেকেই বার বার সাবধান করা হয়েছে ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতা থেকে সামাজিক দূরত্বই শুধু নয় মুখে মাস্ক পরাটা আবশ্যিক বিষয়। এমনকি শুধু গণসমাবেশেই নয় গৃহের নিরাপত্তার বলয়েও তেমন সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরী। করোনা যে নতুন জগত উন্মোচন করেছে তাতে সুস্থ-অসুস্থ উভয়কেই এক কাতারে দাঁড় করিয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপত্তার বেষ্টনী দেয়া হয়। আগে যেখানে শুধু অসুস্থ ব্যক্তিকেই আলাদা করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। কাজটা খুব কঠিন না হলেও সহজে কেউ মানতে পারছে না কেন সেটাও খতিয়ে দেখা সময়ের দাবি। আবার জমজমাট পশুরহাটে বেচা-বিক্রিও করোনাকে আর কত ঢেউয়ের মুখোমুখি দাঁড় করাবে তা বলাই মুশকিল। স্বাভাবিক হাট-বাজারে এমনিতেই মানুষ কোন বিধি ব্যবস্থাকে মানতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে কোরবানির ঈদ উদযাপনের রমরমা পশুরহাটে তা কোন্ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে সেটাকেও হাল্কাভাবে দেখলে ঠিক হবে না। তার ওপর সীমান্ত দিয়ে গরু আমদানি আদৌ রোধ করা গেছে কিনা তাও বিবেচনাসাপেক্ষ। দেশীয় গরু জনগণের চাহিদা মেটাবে বলে সরকার পক্ষ থেকে যে বার্তা এসেছিল বাস্তবক্ষেত্রে তার প্রয়োগ কতখানি সেটও নজরদারির দাবি রাখে। কারণ এই মুহূর্তে সীমান্ত দিয়ে আসা গরু কোরবানি দেয়া যে বিপজ্জনক সেটাও পর্যবেক্ষণের দাবি করে। শপিং মলগুলোতে ইতোমধ্যে কেনাকাটার ভিড় জমে উঠেছে। বিশেষ করে দেশীয় ব্র্যান্ডের ফ্যাশন ঘরে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়, আশপাশের রাস্তায় যানজটের দুর্দশা দেখে অনুমান করা কঠিন নয়। তবে উন্নতমানের দোকানগুলো কিছুটা হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের ওপর নজরদারি করে। কিন্তু রাস্তার ধারে পাশে, ফুটপাথে ক্ষুদে ও মাঝারি বিক্রেতাদের দোকান কিংবা বড় বড় শপিং মলের আশপাশে স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে আমলে না নেয়ার চিত্র প্রতি দিনই উঠে আসছে। ঈদের আগ মুহূর্তে তেমন জমজমাট বিপণন ব্যবস্থা চিরাচরিত স্বাভাবিক দৃশ্য। করোনার বহুল সংক্রমণ সেখানে কোন ছাপ রাখতে বার বার হোঁচট খাচ্ছে। ঈদের পরে শুরু হবে আরেক মহাদুর্ভোগ। কোরবানি দেয়া গরুর আবর্জনা সাফ করা এবং দূষণ মুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনাও এক অপরিহার্য বিষয়। সেখানেও যদি কোন ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে যায় সেটা করোনার মহাসঙ্কটকে আরও বিপন্ন করে তুলতে পারে। সব ধরনের ঝামেলা মোকাবেলা করে ঈদ-উল-আজহার মতো ধর্মীয় উৎসব উদযাপন স্বাস্থ্যবিধির আলোকে কতখানি মঙ্গল বয়ে আনবে সেটাও বিবেচনাসাপেক্ষ। গত বছরেও দুটো ঈদের দুঃসময় আমরা পার করেছি। সেটাও যে খুব নিরাপদ এবং নির্বিঘ্নে করা গেছে তা কিন্তু বলা যাবে না। রোজার ঈদ ও কোরবানির পর করোনা সংক্রমণ বাড়ার চিত্রও অনুধাবন করতে হয়েছে। এখনও করোনার উর্ধগতির হার দেশকে কোনভাবেই স্বস্তি এবং শান্তি দিতে পারছে না। আক্রান্ত আর মৃত্যুর হার ওঠানামা করলেও কমতির দিকে মোটেও আসতে পারেনি। মানুষ যেভাবে কোন কিছুকে তোয়াক্কা না করে নির্বিঘ্নে চলাফেরা আর বাজার-ঘাট করে যাচ্ছে সেটার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখতে আমাদের আরও কিছু সময় পার করতেই হবে। সেটা ভাল খাবার যাই হোক না কেন। এরই মধ্যে প্রতিষেধক টিকাদান কর্মসূচীও তার নির্দিষ্ট পরিধিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন অনেক বেশি মানুষ নিবন্ধন করছে। টিকা সঙ্কট মাঝখানে হতাশা তৈরি করলেও বর্তমানে তা অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে। চীন এবং আমেরিকার (ফাইজার ও মডার্না) টিকা নিতে আগ্রহীদের ভিড়ও লক্ষণীয়। ফাইজারের আনা টিকা শেষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সামনে এসেছে। সিটি কর্পোরেশন অন্তর্ভুক্ত বিভাগীয় শহরগুলোতে ফাইজার ও মডার্নার টিকা দেয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত এসেছে। আর জেলা-উপজেলায় সিনোফার্মের টিকা গণহারে দেয়া হচ্ছে। শেষ হতেও খুব বেশি সময় লাগবে না। ইতোমধ্যে চীনের আরও টিকা আসার খবর কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক। কারণ রোগটি ঠেকাতে এই মুহূর্তে প্রতিষেধক টিকাই সর্বোত্তম পন্থা। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মবিধি মানাও অত্যন্ত জরুরী। যেহেতু দেশে এখনও টিকা উৎপাদন শুরু হয়নি সে কারণে বহির্বিশ্ব থেকে টিকা পাওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ততদিনে রোগটা আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর সেটা ঠেকানোর একমাত্র পথ এবং উপায় অত্যন্ত কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজের সুরক্ষাকে সবার আগে নিরাপত্তার বেষ্টনীতে আটকে দেয়া। আর সেটা প্রত্যেক মানুষকেই করতে হবে। লেখক : সাংবাদিক
×