ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার কতিপয় দিক

প্রকাশিত: ২০:০১, ২০ জুলাই ২০২১

ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার কতিপয় দিক

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শুরু থেকেই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করে আসছে। রাশিয়া গত বছরের ১১ আগস্ট সরকারীভাবে ‘স্পুটনিক-৫’ ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়। গত ১১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন প্রথম ভ্যাকসিন হিসেবে ‘ফাইজার’ এবং ১৮ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ভ্যাকসিন ‘মডার্না’কে অনুমোদন দেয়। গত ২১ জানুয়ারি ভারতের পক্ষ থেকে ২০ লাখ ‘কোভিশিল্ড’ ভ্যাকসিনের একটি চালান উপহারস্বরূপ বাংলাদেশে এসে পৌঁছে। সম্প্রতি আরও একটি চালান এসে পৌঁছেছে ক্রয় সূত্রে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত তিন কোটি ভ্যাকসিন অগ্রিম ক্রয় করেছে। এ ব্যাপারে সরকারের আগে থেকেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ৫ জানুয়ারি, ২০২১, একনেক সভায় টিকা প্রাপ্তির বাজেট ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকার অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক দেবে ৫০ কোটি ডলার এবং এ আই আই বি দেবে ১০ কোটি ডলার। দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ কোটি ২০ লাখ ধরে টিকা বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে প্রথম পর্যায়ে দেশের ৪০ শতাংশ নাগরিকের মধ্যে ৪০ বয়সোর্ধের ওপর টিকার প্রয়োগ, যার মধ্যে ৩১ শতাংশের খরচ আসবে প্রকল্প থেকে, ৯ শতাংশের খরচ আসবে সরকারের রাজস্ব বাজেট থেকে। একই প্রক্রিয়ায় দেশের ১৩ কোটি ৭৬ লাখ (৮০%) নাগরিককে টিকার আওতায় আনা হবে এবং টিকা প্রাপ্তির অগ্রাধিকার তালিকায় আট শ্রেণীর নাগরিকের কখা বলা হয়েছে। জাতীয় কোভিড-১৯ টিকাদান ও কর্মপরিকল্পনা অনুসারে অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা অনুযায়ী সবাইকে টিকা দেয়া হবে। এর মধ্যে আছে-১. সরকারী স্বাস্থ্যকর্মী, ২. বেসরকারী স্বাস্থ্যকর্মী, ৩. বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা, ৪. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ৫. প্রতিরক্ষা কাজে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্য, ৬. রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য কর্মকর্তা, ৭. নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, ৮. গণমাধ্যমকর্মী, ৯. সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মী, ১০. ধর্মীয় প্রতিনিধি, ১১. মরদেহ সৎকার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, ১২. জরুরী সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি, ১৩. নৌ-রেল-বিমানবন্দরে কর্মরত ব্যক্তি, ১৪. মন্ত্রণালয় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সরকারী কার্যালয়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ১৫. ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী। নিবন্ধনকালে নির্দিষ্ট ছকে তথ্য পাঠাতে হবে। অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে নাম, পেশা ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিতে হবে। নিবন্ধন করেননি বা অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হননি এমন কোন ব্যক্তিকে কোভিড টিকা দেয়া হবে না। ১৮ বছরের নিচে, অন্তঃসত্ত্বা ও দুগ্ধ দানকারী মা, অসুস্থ ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ব্যক্তিকে আপাতত টিকা দেয়া যাবে না। সরকার দুই বছরে পাঁচ ধাপে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকাদানের পরিকল্পনা নিয়েছে। তিন পর্বে (ফেইজ) মোট পাঁচ ধাপে ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন টিকা পাবে। ৭০ লাখ মানুষকে টিকায় অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে, যারা করোনা প্রতিরোধে সামনের কাতারে ছিলেন। জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা খসড়া অনুযায়ী, জনপ্রতি দুটি করে মোট ২৭ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ১৬ ডোজ টিকা দেয়া হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন টিকা পাবে, যা মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ অর্থাৎ ১ কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন টিকার আওতায় আসবে। প্রথম পর্যায়ে দুই ধাপে বিতরণ শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে টিকা দেয়া শুরু হবে। এ পর্যায়ে ১০ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার ৯৩৮ জন (মোট জনসংখ্যার ১১ থেকে ২০ শতাংশ) টিকা পাবেন। তৃতীয় পর্যায়েও দুই ধাপে করোনা টিকা দেয়া হবে। এ পর্যায়ের প্রথম ধাপে জনসংখ্যার আরও ২০ শতাংশ অর্থাৎ তিন কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জনকে টিকা দেয়া হবে। শেষ ধাপে জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৪ জনকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এখন নিরপেক্ষ বিশ্নেষণে দেখা যায়, বিদায়ী বছরে করোনা ব্যবস্থাপনায় সরকার যতটা তৎপর ছিল নতুন বছরে করোনার ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনায় সরকারের তৎপরতা তথা সাফল্য প্রশংসা কুড়িয়েছে দেশে-বিদেশে, যা গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত মারাত্মক কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে টিকা নেয়ার পর যে কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোভিড-১৯ পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ আসার ২৮ দিন পর টিকা দেয়া যাবে। এই পর্যায়ে করোনা ভ্যাকসিন বাস্তবায়নের কতিপয় দিক যা এরই মধ্যে আলোচনায় এসেছে। প্রথমত, অনলাইন নিবন্ধনে ভোগান্তি বিশেষত, নিম্ন শ্রেণী যেমন- রিকশাচালক, কাজের লোক, দিনমজুর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনকে কিভাবে টিকা কর্মসূচীর আওতাভুক্ত করা সম্ভব, তা নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। এ ব্যাপারে প্রবাসী অনেকে বলছেন ভলান্টিয়ার) সংগ্রহ করে তাদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে এলাকার লোকজনকে টিকার জন্য তালিকাভুক্ত করা। প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক ‘রেজিস্ট্রেশন বুথ’ বসিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিবন্ধন করাতে হবে ভলান্টিয়ার দিয়ে, যারা হতে পারে ক্ষমতাসীন দলের স্বেচ্ছাসেবক। যারা গত বোরো ও আমন ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের জমিতে ধান কেটে দিয়ে সহায়তা করেছিল যা ছিল একটি প্রশংসনীয উদ্যোগ তা না হলে এলাকার কিছু আইটি ব্যবসায়ী এই সুযোগে নিবন্ধনের নামে বাণিজ্যে জড়াবে, যা কাম্য নয়। দ্বিতীয়ত, ভ্যাকসিন গ্রহণের ব্যপারে অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে। বিশেষত, টিকার প্রচারে ‘মাইকিং, লিফলেট বিতরণ’সহ অন্যান্য প্রচারমূলক কাযক্রমের মাধ্যমে। যদি এমনটা হয় যে কেবল জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা গ্রহণ করা যায় বিশেষতঃ প্রত্যন্ত গ্রাম, চর এলাকা, পাহাড়ী জনপদ ইত্যাদি, তা হলে ধনী-গরিবের মধ্যে ব্যবধান কমবে টিকা গ্রহণের হারও বাড়বে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮৪ শতাংশ মানুষ করোনা ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী হলেও নেতিবাচক প্রচারের কারণে কিছুটা ভয় সৃষ্টি হওয়ায় এখনই ভ্যাকসিন নিতে চাইছে না দেশের ৫২ শতাংশ মানুষ। তারা করোনা ভ্যাকসিনের আসলেই কোন ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া আছে কিনা, তা যাচাই করতে সময় নিতে চাচ্ছেন কেউ কেউ। গত ৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক জার্নাল লেনসেটে প্রকাশিত অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও সুরক্ষাবিষয়ক রিপোর্টে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটির ট্রায়ালের সময় যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা, কালো ও এশিয়ানসহ মিশ্র গ্রুপের ১৮-৫৫, ৫৬-৫৯ ও ৭০ বছর থেকে তদুর্ধ বয়সী ৩টি গ্রুপের মানুষ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, হার্ট ও ফুসফুসসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগীরাও এসব ট্রায়ালের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নিরাপদ বলে প্রমাণিত হওয়ায় তারাও অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটি নিতে পারেন। অন্য অনেক দুর্যোগের মতো করোনা দুর্যোগও সরকার কাটিয়ে উঠছে। তবে কোনভাবেই বেসরকারী হাসপাতাল/সংন্থাকে টিকা প্রদানের দায়িত্ব দেয়া যাবে না। তাহলেই টিকা নিয়ে কালোবাজারি হবে, নকল টিকা বাজারে প্রবেশ করবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অক্সফাম ইতোমধ্যে অভিযোগ তুলেছে, ধনী দেশগুলো তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভ্যাকসিন কিনে নিয়ে মজুদ করেছে, যার উদ্দেশ্য নিজ দেশের বাড়তি প্রয়োজন মেটানো, বাজারে টিকার কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা এবং উচ্চমূল্যে ভবিষ্যতে তা অন্য দেশে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন বাংলাদেশে তা হওয়ার কোন প্রকার সম্ভাবনা নেই; চতুর্থত, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ঠিক রাখার জন্য সরবরাহ চেইনসহ সংরক্ষণাগারের সর্বত্রই নিম্ন তাপমাত্রা বজায় রাখার ব্যাপারটি সরকারী মনিটরিং ব্যবস্থার অধীন রাখতে হবে। সবশেষে বলা যায়, সরকারের ভ্যাকসিন বিতরণ/ব্যবস্থাপনা সার্বজনীন হতে হবে। যেখানে থাকবে না জাতপাতের কোন ভেদাভেদ, নারী-পুরুষ, ধর্ম-অধর্ম, গরিব-ধনীর কোন ভেদাভেদ। সরকারী স্বাস্থ্য সংস্থা ও জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, কমিউনিটির গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং এনজিওগুলোর একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আর সরকার হবে এসবের প্রথম সারির কান্ডারি। লেখক : অধ্যাপক,গবেষক,ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
×