ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাবেক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ২০ জুন ২০২১

সাবেক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে সহযোগিতা করার অভিযোগে কক্সবাজারের সাবেক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার তিন কর্মকর্তা এবং ১৩ রোহিঙ্গাসহ ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক মোঃ শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। মামলায় অভিযুক্ত সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে কক্সবাজারের সাবেক জেলা নির্বাচন অফিসার ও বর্তমানে কুমিল্লা আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক ও বর্তমানে রংপুর ডিআইজি অফিসের পুলিশ পরিদর্শক প্রভাষ চন্দ্র ধর, জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক পরিদর্শক, বর্তমানে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) মোঃ রুহুল আমিন ও কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক, বর্তমানে পটুয়াখালী কন্ট্রোল রুমের পুলিশ পরিদর্শক এসএম মিজানুর রহমান। বৃহস্পতিবার রাতে এ মামলা হয় বলে জানা গেছে। মামলার এজাহারে এই সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একে অপরের সহযোগিতায় অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণার আশ্রয়ে নিজেরা লাভবান হয়ে এবং অন্যকে অন্যায়ভাবে লাভবান করে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে। শহরের পাহাড়তলী, রুমালিয়ারছড়া, তারাবুনিয়ারছড়া, কালুরদোকানসহ বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শত শত রোহিঙ্গা এখানে ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সম্প্রতি শহরের রুমালিয়ারছড়ায় ছৈয়দুল আমিন নামে এক রোহিঙ্গা কয়েক বছর আগে ভ্যানচালক ছিল, কিন্তু বর্তমানে সে এবং তার ছেলে শাকিল স্ত্রী নুরজাহান সবাই মিলে ইয়াবা ব্যবসার বদৌলতে এখন কোটিপতি বনে গেছে। চালু করেছে বিশাল ফার্নিচারের দোকান। ব্যবসা সহজ করতে একজন স্থানীয় ব্যক্তিকে ব্যবসায়িক পার্টনার করেছে। এভাবে এবিসিঘোনার মধ্যে একজন ডাক্তারের সন্ধান পাওয়া গেছে সে প্রকৃত রোহিঙ্গা। তবে বর্তমানে বিশাল বড় ফার্মেসি, ও কয়েকটি দোকানের মালিক তিনি। তার ছেলেরা এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে বলে জানান এলাকাবাসী। দুদক উপসহকারী পরিচালক মোঃ শরীফ উদ্দিন জানিয়েছেন, অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে দুই শতাধিক ব্যক্তি মিয়ানমারের নাগরিক হয়েও সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও সরকারী বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অবৈধ সহযোগিতায় জাতীয়তা সনদপত্র, জন্ম নিবন্ধন সনদ, ভূমিহীন প্রত্যয়নপত্র, স্কুলের প্রত্যয়নপত্র, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, স্মার্টকার্ড এবং বাংলাদেশী পাসপোর্ট পেয়েছেন। এমনকি তারা কেউ কেউ সপরিবারে প্রবাসে আছেন। তাদের অনেকেই ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতারণার আশ্রয়ে অবৈধ উপায়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনহীন ল্যাপটপের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের তাদের পরিবারের সদস্য দেখিয়ে একে অপরের সহযোগিতায় বাংলাদেশী নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেছেন। পরবর্তীতে দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ের বিশেষ শাখা কর্তৃক অভিযুক্ত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বাতিলেরও সুপারিশ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পায় যেভাবে \ কক্সবাজার সদর ইসলামাবাদ ইউনিয়নে রোহিঙ্গারা সরকারী খাস জমি ও বন বিভাগের জমি দখল করে বানিয়েছে আলিশান বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট ও অন্য স্থাপনা। আউলিয়াবাদের বাসিন্দা হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট আছে মোঃ তৈয়বের। তারা দশ ভাই ও দুই বোন। পাঁচ ভাই বর্তমানে সৌদি প্রবাসী। ওমরাহ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশী ঠিকানায় তারা প্রবাসে গেছেন। দুদক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে বাংলাদেশী পরিচয়ে বসবাস করলেও তিনি আসলে মিয়ানমারের নাগরিক। দুদক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে রোহিঙ্গা হয়েও জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট পেয়েছেন একই পরিবারের সদস্য মোহাম্মদ ওয়ায়েস, মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, মোহাম্মদ রহিম, আব্দুর রহমান, আব্দুস শাকুর এবং একই গ্রামের নুর হাবিবা, আমাতুর রহিম, আসমাউল হুসনা, আমাতুর রহমান, নুর হামিদা, মোহাম্মদ ওসামা, হাফেজ নুরুল আলম। তাদের মধ্যে আব্দুস শাকুর বর্তমানে চট্টগ্রামের চাঁদগাঁওতে থাকেন, নুর হামিদা থাকেন কক্সবাজার পৌরসভার পূর্ব নতুন বাহারছড়ায়। দুদক সূত্র জানায়, ইসলামাদের ৮ রোহিঙ্গা যথাক্রমে আমাতুর রহমান, মোহাম্মদ ওসামা, হাফেজ নুরুল আলম, আব্দুস শাকুর, আবদুর রহমান, নুর হাবিবা ও নুর হামিদার পাসপোর্ট দেয়ার জন্য জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার তৎকালীন পরিদর্শক এসএম মিজানুর রহমান অনুকূল পুলিশ প্রতিবেদন দেন। তার অনুকূল পুলিশ প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই না করেই সাবেক বিশেষ শাখার সাবেক ডিআইও-১ প্রভাষ চন্দ্র ধর পুলিশ সুপারের কাছে প্রেরণ করেন। এর প্রেক্ষিতে তারা পাসপোর্ট পেয়ে যান। পাসপোর্ট বাতিলের আবেদন ॥ দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে এই ৮ জনকে মিয়ানমারের নাগরিক এবং ৩৫/৪০ বছর পূর্বে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে মর্মে ইস্যুকৃত পাসপোর্টগুলো বাতিল করার জন্য প্রতিকূল প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয় বিশেষ শাখা থেকে। মোঃ তৈয়ব জালাল ও আমাতুর রহিমের পাসপোর্ট ইস্যু করার জন্য তাদের পক্ষে জেলা বিশেষ শাখার তৎকালীন পরিদর্শক মোঃ রুহুল আমিন মতামত দিলে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে তাদের পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে মোঃ রুহুল আমিন প্রত্যয়ন দেন যে এই দু’জন মিয়ানমারের নাগরিক এবং ৩৫/৪০ বছর পূর্বে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে বিধায় তাদের পাসপোর্ট বাতিল করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয়তা সনদের বালাম বই গায়েব \ দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ইসলাবাদ ইউনিয়নের রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন বালাম বই, জাতীয়তা সনদপত্রের বালাম বই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে গায়েব করা হয়েছে। ইসলামাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুর ছিদ্দিক জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের জন্ম নিবন্ধন বইয়ের ৪টি পাতা পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি পুলিশ কর্মকর্তারা সরেজমিনে ভেরিফাই করলেই সহজে ধরা যেত। কিন্তু তারা তা না করে অসৎ উদ্দেশ্যে এবং নিজেরা লাভবান হয়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট প্রদানের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। ডিজিটাল ব্যানারের নেপথ্য কারিগর ॥ অবশেষে রোহিঙ্গাদের ডিজিটাল ব্যানার ও পোস্টার তৈরি ব্যক্তির সন্ধান মিলেছে। প্রত্যাবাসনবিরোধী এই ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা। সূত্র জানায়, এনায়েত নামের এক পুরনো রোহিঙ্গা শহরের প্রাণকেন্দ্র বদরমোকাম মসজিদের পাশে দীর্ঘদিন ধরে কম্পিউটার ও ছাপাখানা বসিয়ে ছদ্মবেশে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রæপের পক্ষে কাজ চালিয়ে আসছে। সে নিজেকে বারবার বাংলাদেশী নাগরিক বলে দাবি করে আসছে। তার কাছে রয়েছে এনআইডি। তার পিতা, মাতা ও পুরো পরিবারের জাতীয় সনদ ও ভিটার দলিলাদি দেখে ফিরে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অবশেষে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা শিবিরে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে মিয়ানমারে ফিরে না যাবার লক্ষ্যে আন্দোলনকারীদের মধ্যে পুরনো রোহিঙ্গা এনায়েত অন্যতম। তার সঙ্গে রয়েছে ইদ্রিছ জিহাদী, ডাক্তার আয়ুব, আবু সিদ্দিক, হাফেজ মোঃ হাসিম, আবু ছালেহ, মোঃ আয়াছ, শায়েখ ছালামত উল্লাহ, রুহুল আমিন, নুর হোসেন, আবদুর রহমান কাসেমী, আবু বকর, ইউসুফ ও হাফেজ নুর হোসাইনসহ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এনআইডি হাতিয়ে নিয়ে কক্সবাজারে বসবাস করছে। এদের সন্ত্রাসী ছেলেরা চুরি ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ ও মাদক কারবার করে চলেছে। এবিসি ঘোনায় বসবাসরত রোহিঙ্গা ডাঃ আয়ুব বিশাল দালান গড়ে তোলে কয়েকটি ভাড়া দিয়েছে। নিজেও ফার্মেসি খুলে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র আরও জানায়, ইতোপূর্বে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে ব্যানার, পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, লিফলেট ও ফেস্টুনসহকারে প্রতিবাদ সভা এমনকি মহা সমাবেশও করেছিল আশ্রয় শিবিরে। ওইসব পোস্টার, ব্যানার ও একই রকমের টিশার্ট ইত্যাদি রোহিঙ্গা নেতা এনায়েতের কারিশমা বলে জানা গেছে। গ্রামবাসী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনে সন্দেহ ছিল, রোহিঙ্গারা মিছিল-মিটিং করার জন্য ডিজিটাল ব্যানার পোস্টার ও লিফলেটগুলো পায় কোথায়? আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের উস্কানিমূলক ডিজিটাল ব্যানার ও পোস্টার ছাপিয়ে দিয়েছে, এনআইডিধারী এনায়েত নামে পুরনো রোহিঙ্গা। জাতীয় সনদধারী রোহিঙ্গাদের অনেকে কক্সবাজার শহরে সামাজিক এবং ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথমে স্থানীয়দের সহযোগিতায় বিভিন্ন কাজে যোগদান করলেও পরে নিজেরা পুঁজি দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করে বনে যাচ্ছে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক। শিবিরে তালিকাভুক্ত অনেকে শহরে বসবাস করছে। ক্যাম্পে ত্রাণ সামগ্রীও ভোগ করছে। ফলে কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এসব রোহিঙ্গাদের। জানা গেছে, শহরের বিভিন্ন মার্কেট, মাছবাজার, তরকারির দোকান, ছাপাখানা, হোটেল ব্যবসাসহ বেশিরভাগ ব্যবসা বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে রোহিঙ্গারা। এর মধ্যে একজন সদর মডেল থানার অদূরে বদরমোকামের পাশে এনায়েত প্রিন্টার্সের মালিক এনায়েত। প্রথমে দেখে কেউ বোঝার উপায় নেই- সে যে একজন প্রকৃত রোহিঙ্গা। প্রায় ১২ বছর আগে আসা রোহিঙ্গা এনায়েত প্রথমে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে ছাপাখানার কাজ শিখলেও পরে এখন নিজেই দিয়েছে ছাপাখানার দোকান। শুধু এনায়েত নয় তার ভাই আবু ছিদ্দিকসহ তার ৫ ভাইবোন এখন শহরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বদরমোকাম এলাকার কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনায়েত একজন রোহিঙ্গা এটা অনেকে জানে না। তার কথাবার্তা অনেক স্মার্ট এবং পোশাকও অনেক নামী দামী। চলাফেরাসহ সব কিছু ভিআইপি স্টাইলে। তাই কেউ জানে না সেই একজন রোহিঙ্গা। তবে যারা পুরাতন ব্যবসায়ী আছেন তাদের কয়েকজন বলেন, এনায়েতসহ তার পরিবারের সবাই রোহিঙ্গা। এ বিষয়ে এনায়েত প্রথমে স্থানীয় দাবি করলেও পরে স্বীকার করে মিয়ানমার থেকে অনেক আগে আসার কথা। তবে বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে পাহাড়তলী হালিমাপাড়ায় থাকে বলে জানান। তার ভাই আবু ছিদ্দিক থাকে সাহিত্যিকা পল্লীতে। সেখানে ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ে বাংলা পাঠ্যবই শিখছে বলে জানায়।
×