ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সম্ভাবনাময় ও পরিবেশবান্ধব রাবার চাষ

প্রকাশিত: ২২:১০, ৬ জুন ২০২১

সম্ভাবনাময় ও পরিবেশবান্ধব রাবার চাষ

আমাদের দেশের রাবার শিল্প ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে রাবার শিল্প ইতোমধ্যে বিশেষ অবদান রাখতে শুরু করেছে। দেশের রাবার শিল্প মালিকেরা এখন সমন্বিত রাবার চাষের (বনজ, ফলজ, পশু পালন, পর্যটন) দিকে ঝুঁকছেন। দেশে উৎপাদিত উন্নত মানের রাবার দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। রাবার এমন একটি মূল্যবান অর্থকরী সম্পদ যার বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার রয়েছে। রাবার গাছের কষ (ল্যাটেক্স) থেকে রাবার উৎপন্ন হয়। রাবার চাষ মূলত বিদেশ থেকে এদেশে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশদের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম রাবার চাষ শুরু হয়। ১৯১০ সালের কলিকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে রাবার গাছের চারা এনে চট্টগ্রামে বারমাসিয়া ও সিলেটের আমুচা চা বাগানে লাগানো হয়। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৫৪ সালের দিকে বন বিভাগ টাঙ্গাইলের মধুপুর, চট্টগ্রামের হাজারীখীল ও তেঁতুলিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু রাবার চারা রোপণ করে। এভাবে আমাদের দেশে রাবার চাষের গোড়াপত্তন ঘটে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাবার চাষ হচ্ছে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের রামু, রাউজান, ডাবুয়া, হলুদিয়া, কাঞ্চননগর, তারাখো, দাঁতমারা, সিলেটের ভাটেরা, সাতগাঁও, রূপাইছড়া, শাহাজী বাজার, টাঙ্গাইলের মধুপুর, শেরপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। বিএফআইডিসির নিজস্ব মালিকানাধীন রাবার বাগান রয়েছে ১৮টি। বিএফআইডিসি ছাড়া বাংলাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ১১টি রাবার বাগান রয়েছে। সারাদেশে ১৩০৪টি বেসরকারী রাবার বাগান রয়েছে। সারাদেশে বেসরকারীভাবে ৩২,৬২৫ একর জমিতে রাবার চাষ করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে সরকারী ও বেসরকারী বাগানে ২৪,০০০ মেট্টিক টন রাবার উৎপন্ন হচ্ছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ছয়শত কোটি টাকা। বর্তমানে রাবার দিয়ে সারা বিশ্বে ১ লক্ষ ২০ হাজার ধরনের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে। রাবার দিয়ে প্রধানত গাড়ির চাকার টায়ার, টিউব, জুতার সোল, সেন্ডেল, ফোম রেক্সিন, হোসপাইপ, গাম, খেলনা, শিল্প কারখানার দ্রব্য সামগ্রী, চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন সামগ্রীসহ গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি হচ্ছে। শতকরা ৬০ শতাংশ কাঁচা রাবার দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয়, অবশিষ্ট শতকরা ৪০ শতাংশ রাবারভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের নিমিত্তে বিদেশে মূলত ভারত ও ভিয়েতনামে রফতানি করা হয়। রাবার গাছের গড় আয়ু ৩২-৩৪ বছর। এরপর পুরনো গাছ ফার্নিচারের কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি গাছ হতে ৫-৮ ঘনফুট কাঠ পাওয়া যায়। আগে রাবার গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে বিএফআইডিসি রাবার গাছগুলো বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত মানের আসবাবপত্র যেমন, দরজা-জানালা তৈরি করে যা উন্নত গুণগতমানের ও টেকসই। বাংলাদেশ রাবার চাষে নবীন হলেও এর ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ সহায়ক ও আর্থসামাজিক প্রয়োজনে রাবার চাষের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে রাবার চাষের মাধ্যমে দ্রুত বনায়ন, বনায়নের মাধ্যমে বিস্তীর্ণ এলাকার ভূমিক্ষয় রোধ, বিপুল কর্মসংস্থান, বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক আয়ের ব্যবস্থাসহ প্রভূত কল্যাণ সাধন হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে রাবার চাষীদের বিশেষ রফতানি সুযোগ এবং ভর্তূকি সুবিধাসহ সহজশর্তে ঋণ প্রদান এবং রাবার চাষীদের রাবার চাষে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে অনুদান প্রদান রাবার বোর্ডের মাধ্যমে হাতে কলমে শিক্ষাসহ নানা ধরনের সাহার্য্য সহযোগিতা করে সেখানে রাবার চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। যা আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। বর্তমানে রাবার উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়া সবার শীর্ষে রয়েছে। সে দেশে রাবার চাষের ব্যাপারে সরকারী পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। যে কারনে সেখানে রাবার শিল্প দিন দিন উন্নতি লাভ করছে। এদিকে আমাদের দেশের রাবার শিল্পে বিরাজ করছে অজস্র সমস্যা। আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে রাবার উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর বিদেশ থেকে রাবার আমদানি করছে। যে কারণে আমাদের দেশের রাবার শিল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পদে পদে। বিদেশী রাবারে বাজার সয়লাব হয়ে থাকায় দেশী রাবারের বাজার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে না। দেশী রাবার অবিক্রীত থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাবার চাষ করে রাবার চাষীরা ন্যায্য মূল পায় না। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ রাবার উৎপন্ন হচ্ছে তা অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বিদেশে রাবার রফতানি করে একশত কোটি থেকে দেড়শত কোটি টাকা আয় করেছে। বর্তমানে দেশের রাবার শিল্পের স্বার্থে বিদেশ থেকে রাবার আমদানি বন্ধ করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের রাবার চাষকে লাভজনক করা, জনসাধারণের অংশীদারিত্বের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, রাবার চাষীদের সহযোগিতা প্রদানের জন্য ভবিষ্যত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সরকার ২০১৩ সালে বাংলাদেশ রাবার বোর্ড প্রতিষ্ঠিত করে। ২০১৯ সাল হতে আলাদা দফতর হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। রাবার উৎপাদন মূলত কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। ট্যাপিং এলাকা, গাছের ফলন, ট্যাপিং-এর জন্য কৃষকদের উদ্যোগ ইত্যাদি। প্রাকৃতিক রাবারের ট্যাপিং এলাকা, চারা রোপণ এলাকা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সাধারণ একটি গাছ ল্যাটেক্স উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করার জন্য ৫-৬ বছর সময় প্রয়োজন হয়। প্রথম দিকে ল্যাটেক্স উৎপাদনের হার কম থাকে। বছর বছর এটি বাড়ে। সম্পূর্ণ ফলন প্রাপ্তির জন্য ১০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় এবং এরপর ২০-৩০ বছর পর্যন্ত ল্যাটেক্স পাওয়া হয়। রাবার গাছ হতে ল্যাটেক্স সংগ্রহ করা এবং ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়াটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ল্যাটেক্স সংগ্রহ করার জন্য গাছ ট্যাপিং করা হয় সূর্য উঠার আগে। এর ৩-৪ ঘণ্টা পর ল্যাটেক্স সংরহ করা হয়। ট্যাপাররা ব্লক অনুসারে সব গাছ কেটেছে কিনা তা তদারকি করা কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। আর এই সুযোগে ল্যাটেক্স চুরি হয়ে যায়। বাগানে ল্যাটেক্স এবং শীট চুরি রোধ করার জন্য মনিটরিং জোরদার করতে হবে। অনেক সময় কাঁচা রাবার ও চুরি হয়ে যায়। সরকারী বাগানগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় কয়েকটি বাগান খুবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমাদের দেশের রাবার শিল্পের ভবিষ্যত প্রসঙ্গে আলাপ হয় বাংলাদেশ রাবার বাগান মালিক সমিতির সভাপতি এবং প্রায় ৩০ বছর রাবার চাষের সঙ্গে সম্পর্কিত লায়ন মোহাম্মদ কামাল উদ্দীনের সঙ্গে। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ভয়াবহ প্রকোপে যখন অর্থনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন বিপর্যস্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত তেমন প্রেক্ষাপটে শ্রমঘন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব রাবার চাষকে বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ রবার গার্ডেন ওনার্স এ্যাসোয়িশেন যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে। এ লক্ষ্যে রাবারের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার, বাগান হস্তান্তর ও নবায়ন সহজীকরণ এবং ব্যাংক ঋণ চালুসহ বিভিন্ন দাবি রয়েছে সংগঠনটির। রাবার বাগান মালিকরা রাবার উৎপাদনে আগ্রহী হওয়ার জন্য বাংলাদেশ রাবার বোর্ড রাবার চাষীদের স্বার্থ সংরক্ষণ, কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ উৎপাদিত রাবারের মান উন্নয়ন, বিপণন, ভবিষ্যতে রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করা এবং রাবারের আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশীয় রাবারের বাজার মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার স্বার্থে জাতীয় রাবার নীতি সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন। রাবার শিল্পের উন্নয়নে রাবার গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা প্রয়োজন। রাবার শিল্পে বিরাজমান সমস্যা সমাধানে এবং এর উন্নয়নের ব্যাপারে অভিজ্ঞ লোকের অভাব থাকায় বিদেশ থেকে রাবার বিশেষজ্ঞ আনার প্রয়োজন রয়েছে। রাবার চাষের ব্যাপারে রাবার চাষীরা সব সময় আর্থিক সঙ্কটে ভুগেন। তারা মূলধন সমস্যার কারণে রাবার বাগানের উন্নয়ন এবং মানসম্মত রাবার উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে। রাবার বাগান মালিকদের জন্য সরকার যে ঋণের ব্যবস্থা রেখেছিল তাও এখন বন্ধ রয়েছে। রাবার বাগান মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
×