ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজরিত টাঙ্গাইলের মধুপুরের দোখলায় ৫০ বছরেও উন্নয়নের ছোঁয়া নেই

প্রকাশিত: ১৬:২৪, ৩ মে ২০২১

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজরিত টাঙ্গাইলের মধুপুরের দোখলায় ৫০ বছরেও উন্নয়নের ছোঁয়া নেই

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজরিত টাঙ্গাইল বন বিভাগের মধুপুর বনাঞ্চলের দোখলা এলাকায় মহান স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছরেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। উপরন্তু অযতœ-অবহেলায় বন বিভাগের দোখলা রেস্ট হাউজটি ভিভিআইপিদের অবকাশ যাপনের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর হাতে লাগানো আম গাছটি ডাল-পালা কেটে ফেলার পর এখন মৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানা গেছে, টাঙ্গাইল শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তর দিকে মধুপুর গড়াঞ্চলের অরণখোলা মৌজায় দুটি খালের মিলনস্থলই ‘দোখলা’ হিসেবে পরিচিত। মধুপুর বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের চারণভূমি দোখলা এলাকা। মধুপুরের পীরগাছা ও থানার বাইদ এলাকা থেকে পৃথক দুটি খাল এসে অরণখোলা মৌজায় এসে একীভুত হয়েছে। যা কালক্রমে দোখলা এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বন পরিদর্শনকারী ভিআইপিদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ ও বিশ্রামের জন্য দোখলায় বন বিভাগ একটি রেঞ্জ ও বিট অফিসারের দুটি কার্যালয় এবং ১৯৬২ সালে দোখলা রেস্ট হাউজ স্থাপন করে। তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্ণরসহ বহু ভিআইপিরা মধুপুরের গহীন বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে এসে দোখলা রেস্ট হাউজে অবস্থান করেছেন। বিগত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগড়িষ্ঠতা পাওয়ার পর ১৯৭১ সালের (১৮ জানুয়ারি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব তাদের ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়ে বিশ্রামের জন্য বনের মাঝে নিরিবিলি ও নিরাপদ দোখলা রেস্ট হাউজে যান। বিগত ১৯৭১ সালের (১৮ থেকে ২১ জানুয়ারি) পর্যন্ত দোখলা রেস্ট হাউজে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে তাদের জীবনমান ও পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি স্থানীয় চুনিয়া গ্রামের আদিবাসী গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ- এর বাড়িতে গিয়ে মধুপুর বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মতবিনিময় করেন। তিনি চুনিয়া গ্রামের গারো রাজার সঙ্গী জগদীস নকরেক ওরফে জনিক নকরেক ও দোখলার মোশারফ হোসেন সহ অনেকের সাথেই তৎকালীন আন্দোলন-সংগ্রামের বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মধুপুর বন ও বনে বসবাসরত আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আন্দোলন-সংগ্রামে তাকে সব সময় পাওয়া যাবে বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দোখলায় থাকাকালে প্রতিদিন স্থানীয়দের সঙ্গে দেখা করলেও দোখলা ডাকবাংলোতে রাতযাপন করেছেন। বাংলোতে তিনি যে চেয়ারটিতে বসতেন ও টেবিল ব্যবহার করেছেন- তা যতœ করে রাখা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা এবং ছোট্টশিশু শেখ রাসেলের স্মৃতিধন্য দোখলা-রসুলপুর ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটি মহান স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সংস্কার বা পুন:নির্মাণ করা হয়নি। দোখলা রেস্ট হাউজটির সামান্য সংস্কার করা হলেও তা আধুনিক নয়। বন বিভাগের রেঞ্জ ও বিট কার্যালয় দুটিরও কোন উন্নয়ন হয়নি। জাতির পিতার নিজ হাতে লাগানো আম গাছটির ডালপালা প্রায় দুই বছর আগে কেটে ফেলায় পরিচর্যার অভাবে অযতœ-অবহেলায় এখন শুকিয়ে মরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বন বিভাগের দোখলা রেস্ট হাউজের পরিদর্শন বইয়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের কোন প্রমাণই রাখা হয়নি। এছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনাকালে ড. কামাল হোসেন, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, তোফায়েল আহমেদসহ বিভিন্ন গুণীজন দোখলা রেস্ট হাউজে অবস্থান করেন। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল ১৯৭৪ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনে এসে দোখলা রেস্ট হাউজে অবস্থান করেন। স্থানীয়দের ধারণা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশে কলঙ্কিত অধ্যায় শুরু হয়। দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকায় জাতির পিতার সে সময়ের সব স্মৃতি সুকৌশলে মুছে ফেলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছার স্মৃতিধন্য টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসী গ্রাম চুনিয়ার শতবর্ষী জগদীস নকরেক ওরফে জনিক নকরেক এখন বয়সের ভারে ন্যূব্জ- স্মৃতি লোপ পেয়েছে, কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলেন। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘তাকে আমরা আর না পেলেও তার স্মৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। দোখলা রেস্ট হাউজের পাশে তিনি একটি আম গাছ লাগিয়েছিলেন’। জনিক নকরেক জানান, বঙ্গবন্ধু ক্লান্তি কাটাতে দোখলায় বিশ্রাম নিতে এসেছিলেন। ঢাকার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন। হয়তো খুব বেশি লোককে জানাননি কোথায় আছেন। গারো রাজা চুনিয়া গ্রামের পরেশ চন্দ্র মৃকে বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে চিনতেন। বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতা ছেড়ে আসেন, তার বছর দুয়েক আগে পরেশ মৃ কলকাতায় গিয়েছিলেন। পরেশ চন্দ্র মৃ দেশভাগের কিছুদিন পর কলকাতা থেকে মধুপুরের চুনিয়ায় ফিরে আসেন। ফিরে এসেই গারোদের জুমচাষ নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। জনিক নকরেক আরও জানান, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরেশ বাবুর বাড়িতে নানা কিছু নিয়েই কথা হয়েছিল। তিনি কথা দিয়েছিলেন- বন রক্ষা করবেন। বনের মানুষের লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে থাকবেন। জনিকের দাবি, বঙ্গবন্ধু সেদিনই বলেছিলেন- দেশটা স্বাধীন হয়ে যাবে। স্বাধীন দেশে হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-গারোতে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই ভাই ভাই হয়ে বসবাস করবে। পরেশ চন্দ্র মৃ’র একটি আত্মজৈবনিক রচনায় জানা যায়, তার আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আদিবাসী গ্রাম চুনিয়ায় এসেছিলেন। তার ছেলে বাবুল দারু জানান, বাবার কাছে এটা ছিল একটা গৌরবের স্মৃতি। ষাটোর্ধ্ব বাবুল দারু জানান, তখন তার বয়স ছিল ১২-১৩ বছর। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফজিলাতুননেছা এবং শেখ রাসেলও ছিলেন। তিনি জানান, তিনি খুব কাছ থেকে তাদেরকে দেখেছিলেন। তারা খুব সাদাসিধে ছিলেন। তার মায়ের হাতে তাদের গাছের পান খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছিলেন। তার মা দীলিপ জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে চেয়ে নিয়েছিলেন তাদের গাছের পান। তাদের মধুপুরের আনারসও খেতে দেওয়া হয়েছিল। মধুপুর উপজেলার অরণখোলা ও শোলাকুড়ি ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের ধারণা, বঙ্গবন্ধু হয়তো কয়েকটা দিন একান্তে বিশ্রাম নিতে দোখলা রেস্ট হাউজে উঠেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সত্তরের নির্বাচন শেষে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল- তা নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত ছিলেন। ৩ জানুয়ারি জনগণের সামনে নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের তিনি শপথ করিয়েছিলেন। ১৩ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মধুপুর অঞ্চলের সভাপতি উইলিয়াম দাজেল জানান, মহান স্বাধীনতার পর একটা দীর্ঘ সময় স্বাধীনতা বিরোধীরা রাস্ট্রক্ষমতায় থাকায় বন বিভাগের তৎকালীন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জাতির পিতার স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। মধুপুরে সেই সময় বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শোলাকুড়ি ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান এবং মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী স্মৃতিচারণ করে জানান, স্কুলের ছাত্রদের নেতৃত্বে ওই বাংলোতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলে মহান নেতা পাইপ হাতে হাসিমুখে বাংলোর সামনের লনে এসে দাঁড়ান। উপস্থিত ছাত্ররা তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করলে তিনি ধমক দিয়ে বলেন- স্যার নয়, ভাই বলে ডাকো। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার ভ্রমণের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য টাঙ্গাইল বন বিভাগ দোখলা ভিভিআইপি ডাকবাংলো চত্তরে শ্বেতপাথরে খোদাই করা একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছে। মধুপুর বনাঞ্চল পরিদর্শনে আসা পর্যটক ও বনভোজনকারীদের জন্য তা এখন বাড়তি আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জহিরুল হক জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য দোখলা রেস্ট হাউজটি আংশিক সংস্কার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে রেস্ট হাউজের কাছে একটি অত্যাধুনিক ডাকবাংলোর নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
×