ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ চৈত্রসংক্রান্তি

যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ১৩ এপ্রিল ২০২১

যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি

মোরসালিন মিজান ॥ বিদায় নিচ্ছে পুরাতন। আরও একটি বছর গত হচ্ছে। কালেরগর্ভে হারাচ্ছে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। আজ ৩০ চৈত্র বাঙালীর বর্ষবিদায়ের বিশেষ দিবস উৎসব অনুষ্ঠানের চৈত্রসংক্রান্তি। এক বছরে কত সুখ-স্মৃতি। বিষাদ। ঘটনা-দুর্ঘটনা। হাসি কান্না। সবই বছরের শেষ সূর্যের সঙ্গে অস্ত যাবে আজ। না, চৈত্রসংক্রান্তি পুরনোকে ছুড়ে ফেলে না। বিদায় জানায়। বুকে লালন করে। আবহমান কাল থেকে নানা লোকাচার ও উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপন করে আসছে বাঙালী। মূল আনুষ্ঠানিকতা গ্রামে হলেও, নগর সংস্কৃতিতে এর প্রভাব একেবারেই কম নয়। আসছে নতুন বছর। এ কারণেই জীর্ণ পুরাতনকে বিদায় জানানো। কবিগুরুর ভাষায়, ‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি।’ হ্যাঁ, সবই একদিন পুরনো হয়। গত হয়। সুখ, পাওয়া, না পাওয়া, পেয়ে হারানোর ব্যথা একদিন ঠিক পুরনো হয়। ফিকে হয়। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে পুরনো হয় মাস। বছর। সকল পুরনো থেকে শিক্ষা নিয়েই নতুনেরে সাজাতে হয়। অভিজ্ঞতার আলোকে গড়তে হয় ভবিষ্যত। চৈত্রসংক্রান্তির তাৎপর্য এখানেই। যতদূর জানা যায়, সংক্রান্তি মানে এক ক্রান্তি থেকে আরেক ক্রান্তিতে যাওয়া। কিংবা বলা যায়, এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় পৌঁছানো। ক্রান্তির সঞ্চার। ক্রান্তির ব্যাপ্তি। সূর্যসহ বিভিন্ন গ্রহের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন। মহাকালের অনাদি ও অশেষের মাঝে ঋতু বদল করতে করতে এগিয়ে চলা। বর্ষ বিদায়ের এ দিনটি লোকজ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, চৈত্রমাসের শেষ দিন জমিদারি সেরেস্তারা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করতেন। প্রত্যেক চৈত্রমাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাসুল বা কর পরিশোধ করতে হতো। এর পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো বলেও জানা যায়। এখনও সেই সব আচারের কিছু কিছু দেখা যায়। সনাতন প্রথা অনুসারীরা চৈত্রসংক্রান্তিকে গ্রহণ করেন পুণ্যের দিন হিসেবে। পঞ্জিকা মতে, দিনটি মহাবিষুবসংক্রান্তি। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এই দিনে মহা আনন্দে মাতে। পাহাড়ে পাহাড়ে চলে বর্ণাঢ্য উৎসব আয়োজন। জানা যায়, এক সময় চৈত্রসংক্রান্তিই ছিল বড় উৎসব। গ্রামের নারীরা মাটির ঘরদোর লেপা-পোছা করতেন। এমনকি গোয়ালঘরটি পরিষ্কার করা হতো। সকালে গরুর গা ধুয়ে দিত রাখাল। ঘরে ঘরে বিশেষ রান্না হতো। দারুণ সব দেশীয় খাবার ছাড়াও তৈরি করা হতো নক্সি পিঠা, পায়েস, নারকেলের নাড়ু। দিনভর চলত খাওয়া-দাওয়া। প্রিয়জন-পরিজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হতো। গ্রামের গৃহস্থরা নতুন জামা-কাপড় পরতেন। নাতি-নাতনিসহ মেয়েজামাইকে সমাদর করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। তাদের জন্যও থাকত নানা উপহার সামগ্রী। চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে কাটাতেন। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন। এখন অনেক কিছু বদলে গেলেও কোন কোন আচার পালন করতে দেখা যায়। ফোকলোরবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৈত্রমাসে স্বামী-সংসার কৃষি ব্যবসার মঙ্গল কামনায় লোকাচারে বিশ্বাসী নারীরা ব্রত পালন করতেন। এ সময় আমিষ নিষিদ্ধ থাকত। থাকত নিরামিষ, শাক-সবজি আর সাত রকমের তিতা খাবারের ব্যবস্থা। বাড়ির আশপাশ বিল-খাল থেকে শাক তুলে রান্না করতেন গৃহিণীরা। এই চাষ না করা, কুড়িয়ে পাওয়া শাক ক্ষেতে বাগানে বেশি বেশি পাওয়া গেলে বিশ্বাস করা হতো- সারাবছরের কৃষিকর্ম ঠিক ছিল। মানুষ, তার চারপাশের প্রকৃতি ও প্রাণগুলোর আপন হয়েছিল কৃষি। একই কারণে নতুন বছর নিয়ে দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠতেন তারা। চৈত্রসংক্রান্তির মেলাও খুব আকর্ষণীয় ছিল। এখনও দেশের বিভিন্ন এলাকায় চড়ক উৎসবের আয়োজন করা হয়। চৈত্রজুড়ে সন্ন্যাসীরা উপবাস, ভিক্ষান্ন ভোজনসহ নানা নিয়ম পালন করেন। সংক্রান্তির দিন তারা শূলফোঁড়া, বাণফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঝোলেন। পাখির মতো শূন্যে উড়ে বেড়ান। গাছের চারপাশে ঘোরেন। হাজার হাজার মানুষ তা উপভোগ করেন। যে গ্রামটিতে আয়োজন, সে গ্রামের আশপাশের, এমনকি দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন চড়ক উৎসবে দেখতে আসেন। এখানেই শেষ নয়, সন্ন্যাসীরা আগুনের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটেন! ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য শারীরিক কসরত বটে। তবে এর সঙ্গে ততোধিক আনন্দ যোগ হয়েছে। গাজনের মেলা, মেলার সঙ্গে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নাম যুক্ত হয়ে আছে। গাজন উৎসবের পেছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতন বিশ্বাস কাজ করে। ধারণা করা হয়, চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচ- উত্তপ্ত থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় অতীতে কোন এক সময় কৃষিজীবী সমাজ এ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিল। গাজনের মেলা ছাড়াও যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। মেলায় মাটি, বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা ইত্যাদি বিক্রি হয়। বিভিন্ন প্রকার খাবার, মিষ্টি, দই পাওয়া যায়। এক সময় মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল বায়োস্কোপ, সার্কাস ও পুতুল নাচ। এসব আকর্ষণে দূর গ্রামের দুরন্ত ছেলেমেয়েরাও মেলায় যাওয়ার বায়না ধরত। এ সময় হালখাতার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো, লাঠিখেলা, গান, আবৃত্তি, সঙযাত্রা, রায়বেশে নৃত্য, শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। অবশ্য কালের বিবর্তনে অনেক উৎসব অনুষ্ঠানই হারিয়ে গেছে। গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির দিনে কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করতে দেখা যায়। কোন কোন এলাকায় মেলা ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। আর শহর ঢাকায় ঐতিহ্যকে মূলত স্মরণ করার চেষ্টা করেন নাগরিকরা। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান আয়োজন করছে সঙ্গীত সংগঠন সুরের ধারা। সূর্যাস্তের সময় শুরু হয়ে অনুষ্ঠান চলত রাত ১২টা পর্যন্ত। পুরো উৎসবের পরিকল্পনা করতেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। তিনি ছাড়াও সুরের ধারার শিল্পীরা অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব আয়োজন করা হত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদেও থাকত দারুণ সব আয়োজন। তবে গত বছর এসবের কিছুই সম্ভব হয়নি। এবারও উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে বাঙালী। কারণ করোনা সংক্রমণের উর্ধগতি। প্রতিকূল এই সময়ে ঘরের বাইরে বের হওয়ার তেমন সুযোগ নেই। তাই যেটুকু আচার অনুষ্ঠান আজ ঘরেই পালন করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
×