ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল

অবশেষে সেই ইকবাল গ্রেফতার

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

অবশেষে সেই ইকবাল গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একুশে আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে দলকে নেতৃত্বশূন্য করতে সরাসরি গ্রেনেড হামলাকারীদের অন্যতম যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক সময়ের ছাত্রদল নেতা পরবর্তীতে ভয়ঙ্কর জঙ্গী সেই ইকবালকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে গোয়েন্দারা। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ও র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাবের যৌথ অভিযানে তাকে গ্রেফতার করা হয়। টানা সতেরোটি বছর তার সন্ধান করেছে গোয়েন্দারা। অবশেষে নানা নামে, নানা ছদ্মবেশে দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে থাকা সেই ইকবালকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। শনাক্ত করার পর শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ইকবাল ট্রাকের মধ্যে করা সেই মঞ্চে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন শেখ হাসিনা। গত সোমবার রাত তিনটার দিকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার মিরপুরের দারুস সালাম থানাধীন দিয়াবাড়ি এলাকায় অভিযান যৌথ অভিযান চালায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাবের একাধিক বিশেষ গোয়েন্দা দল। অভিযানে দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে ভয়াল একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ভয়ঙ্কর জঙ্গী মোঃ ইকবাল হোসেন ওরফে ইকবাল ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে সেলিমকে গ্রেফতার করা হয়। মঙ্গলবার ঢাকার কাওরানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানান বাহিনীটির মহাপরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত ইকবালের পিতার নাম আব্দুল মজিদ মোল্লা। বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। সে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। হামলার পর থেকেই নানা প্রেক্ষাপটে তার নাম আসে। এরপর থেকেই তার সন্ধান চলছিল। র‌্যাব মহাপরিচালক আরও জানান, জঙ্গী ইকবালকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য মোতাবেক, ইকবাল এইচএসসি পাস। স্কুল ও কলেজে অধ্যয়নকাল থেকেই সে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। ১৯৯৪ সালে ঝিনাইদহের কেসি কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রদলের নির্বাচিত শ্রেণী প্রতিনিধি ছিল। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত মালয়শিয়ায় প্রবাসী কর্মজীবী হিসেবে অবস্থান করেছে। দেশে ফিরে আইএসডি ফোন ও অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। এ সময় সে, সর্বহারা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে বিরোধ ও কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। ২০০১ সালে তার চিন্তা-চেতনা ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে। সে ঝিনাইদহের স্থানীয় এক জঙ্গী সদস্যের মাধ্যমে হরকত-উল-জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) নামের জঙ্গী সংগঠনে যোগ দেয়। ২০০৩ সালে মুফতি হান্নান ও অন্য শীর্ষ নেতাদের সান্নিধ্যে চলে আসে। ধীরে ধীরে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে হুজির প্রধান ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া মুফতি মাওলানা হান্নানের নির্দেশে ঢাকায় চলে আসে। অবস্থান করতে থাকে গোপন আস্তানায়। আস্তানায় হুজি প্রধান মুফতি হান্নানসহ অন্য সমমানদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। মুফতি হান্নানের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে দলীয় গোপন বৈঠকে অংশ নিত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে ইকবাল জানায়, মুফতি হান্নানের নির্দেশে সে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে। মুফতি হান্নান হামলা পরিচালনার জন্য তাকে গ্রেনেড সরবরাহ করেছিল। হামলা চলাকালে সে মঞ্চকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়েছিল। ঘটনার পর সে ঝিনাইদহে চলে যায়। সেখানে আত্মগোপনে অবস্থান করতে থাকে। জঙ্গী ইকবাল হোসেনকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে একাধিক স্থানে অভিযান চালানো হয়। ২০০৮ সালে ঝিনাইদহের বাড়িতে, পরবর্তীতে গাজীপুর ও সাভারসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়। আত্মগোপনে থাকাকালীন ইকবাল নানা ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল। সে কখনও নিরাপত্তাকর্মী, শ্রমিক, রিক্সা মেকানিক সেজে আত্মগোপনে ছিল। ২০০৮ সালে দেশ ত্যাগ করে। প্রবাসে আত্মগোপন থাকাবস্থায় প্রথমে সেলিম এবং পরবর্তীতে জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে। এক পর্যায়ে সে প্রবাসে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়। তাকে ২০২০ সালের শেষের দিকে দেশে ফেরত পাঠায়। দেশে ফিরে ইকবাল আত্মগোপনে থেকে সমমানদের সঙ্গে পূনরায় যোগাযোগ স্থাপন করে। তারই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ও র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা জঙ্গী ইকবাল সম্পর্কে জেনে যায়। তার অবস্থান নিশ্চিত করার পরই শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। র‌্যাব মহাপরিচালক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যের শুরুতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের শাহাদাতবরণকারী, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সকল শহীদ, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আইভি রহমানসহ শাহাদাতবরণকারী ও আহত হয়ে যারা আজও সেই গ্রেনেডের ক্ষত বয়ে চলেছেন তাদের এবং জঙ্গীবিরোধী অপারেশনে আত্মোৎসর্গকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ হতাহত সকলকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রসঙ্গত, ২০০০ সালের ২০ ও ২৩ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার নির্বাচনী সমাবেশস্থলে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখেছিল হুজি। সেই মিশন ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তিনি মারাত্মক আহত হন। হামলায় আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মী শাহাদাতবরণ করেন। আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। এ ব্যাপারে মামলা দুইটি মামলা দায়ের হয়। মামলা তদন্তের নামে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জজ মিয়া নাটক সাজায়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলাটির পুনঃতদন্ত শুরু হয়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডির সিনিয়র এএসপি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল কবীরকে। জজ মিয়া নাটক সাজানোর দায়ে সিআইডির সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও এএসপি আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। পরবর্তীতে আদালত ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ গত ৩ জুলাই রবিবার ৩০ জন নতুন আসামিসহ মোট ৫২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করেন। আদালত পলাতক ১৮ আসামির বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে। পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর এটিএম আমিন, সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দার ডিউক, অতিরিক্ত ডিআইজি খান সাইদ হাসান, এসপি ওবায়দুর রহমান, সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহল আমিন, সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, সিআইডির সাবেক এএসপি আব্দুর রশিদ, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল বাবু, হানিফ পরিবহনের মালিক মোঃ হানিফ, আবদুল মালেক, শওকত হোসেন, মাওলানা তাজউদ্দিন, ইকবাল হোসেন (সদ্য গ্রেফতারকৃত), মাওলানা আবু বকর, খলিলুর রহমান (মাগুরা), জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর (ঢাকা জেলার দোহার থানার বাসিন্দা), মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার (গোপালগঞ্জ), ভারতে তিহার জেলে বন্দী আনিসুল মুরসালিন ও তার ভাই মহিবুল মুক্তাকিন। ইতোমধ্যেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। বিজ্ঞ আদালতে দীর্ঘ সাত বছরে সর্বমোট ২২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এই মামলার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা হয়। যুগান্তকারী এই রায়ে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়।
×