ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বোরহান বিশ্বাস

বিদায় এটিএম শামসুজ্জামান

প্রকাশিত: ২০:৩১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বিদায় এটিএম শামসুজ্জামান

স্কুলে পড়াকালীন সময়ে সাদাকালো টেলিভিশনে একজন খলচরিত্রের মানুষের অভিনয় দেখে যারপরনাই খুশি হতাম। তিনি মূলত গ্রামের মোড়ল কিংবা মাতব্বর হয়ে পর্দায় আসতেন। তার অভিনীত এবং বিটিভিতে প্রচারিত সেই ছবিগুলো নিয়ে পরবর্তী সময় বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় মেতে উঠতাম। এর আগে পর্দায় খারাপ চরিত্রের মানুষের উপস্থিতি মনে ভয়ের উদ্রেক ঘটাত মনে। মাঝে মাঝে ভিলেনদের অট্টহাসি দেখে চোখ বুজে কান চেপে বসে থাকতাম। তার অভিনয়ে প্রথমবারের মতো কোন বাংলা ছায়াছবির খলনায়ককে ভাল লাগতে শুরু করল। খলনায়কও যে দর্শকদের মনে জায়গা করে নিতে পারেন সেটি ক্রমেই বুঝতে পারছিলাম। তিনি এটিএম শামসুজ্জামান। এটিএম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল এফডিসিতে। কাজী হায়াতের একটি ছবিতে কাজ করছিলেন তিনি। শূটিংয়ের ফাঁকে বসে খানিক বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা দূরে দাঁড়িয়ে শূটিং দেখছিলেন। এটিএম ভাই তাকে কাছে ডাকলেন। সহাস্যে তিনি এগিয়ে এলে এটিএম ভাই তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা পুলিশ ভাই, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি- ‘সারাদিন মানুষের যখন কথা বলার প্রয়োজন হয় তখন কলরেট কেন বেশি? আর যখন মানুষের ঘুমানোর সময় মানে রাতে কলরেট কম কেন? পোলাপাইন তো রাইতে ঘুমাইতে পারে না। সারা রাইত খালি কথা কয়।’ পুলিশ কর্মকর্তা কোন উত্তর না দিয়ে এটিএম ভাইয়ের কথার উপস্থাপনায় হেসেই খুন। এটিএম ভাই তখন বলেছিলেন, হাসেন। কিন্তু আমারে কিছু কইয়েন না। আমি কানে শুনি না। এটিএম ভাইয়ের মুখে সেই কথা শুনেও ওই পুলিশ কর্মকর্তা হেসেছিলেন। হয়ত ভেবেছিলেন তিনি মজা করছেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল এটিএম ভাই সত্যিই কানে কম শুনতেন। কানে কম শুনেও কিভাবে সহশিল্পীদের সঙ্গে সাবলীল অভিনয় করতেন- তা ছিল বিস্ময়কর। দ্বিতীয়বার তার সঙ্গে দেখা বেসরকারী টিভি আরটিভিতে। এটি প্রায় এক যুগ আগের কথা। তখন আমি চ্যানেলটির জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছি। প্রতি মঙ্গলবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিট দেবাশীষ বিশ্বাসের উপস্থাপনায় সরাসরি সম্প্রচার হতো চলচ্চিত্রবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘ভেরি ফিল্মি’। অনুষ্ঠানটির প্রযোজক ছিলেন তানিফ মাহমুদ। কোন এক মঙ্গলবার কাজ সেরে অফিস থেকে বের হওয়ার সময় মনে পড়ল আজকে অতিথি হয়ে আসছেন এটিএম ভাই। যাত্রায় বিরতি দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম তার জন্য। এক সময় তিনি এলেন। পরনে সফেদ রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা। প্রযোজক তানিফ মাহমুদের রুমে বসলেন। পর্দায় যে মানুষটিকে আমরা সং করতে দেখি বাস্তবে তাকে ঠিক উল্টোটাই মনে হলো। ব্যক্তিত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আমি বসলাম তার পাশের চেয়ারে। হাস্যরসের পর গভীর মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিপ্ট পড়তে লাগলেন। তার গাম্ভীর্যতা দেখে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর বিষকন্যা চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু তার। প্রথম কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেন ‘জলছবি’। এরপর শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনী লিখেছেন তিনি। ১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়নমণি’ সিনেমায় খলচরিত্রের মধ্য দিয়ে তার আবির্ভাব। এরপর একে একে গোলাপী এখন ট্রেনে, সূর্যদীঘল বাড়ী, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা, রামের সুমতিতে তিনি অভিনয় করলেন। খলচরিত্র পেল নতুন মাত্রা। শতভাগ সফল হলেন দর্শকদের মন জয় করে নিতে। হাসির ছলেও যে কূটচালে অপরিহার্য অভিনেতা হয়ে ওঠেন তিনি। তার চরিত্রগুলো চিত্রনাট্যে সেভাবেই লেখা হতো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দীর্ঘ সময় তিনি খলচরিত্রে নির্মাতাদের কাছে ভরসাস্থল ছিলেন। আবার সিরিয়াস চরিত্র যেমন নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’-এ অভিনয় করেছিলেন শাবানার বিপরীতে। সেখানেও সফল তিনি। ১৯৮৭ সালে কাজী হায়াত পরিচালিত দায়ী কে? চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। খলচরিত্রে অশিক্ষিত, গোলাপী এখন ট্রেনে, পদ্মা মেঘনা যমুনা, স্বপ্নের নায়ক, কৌতুক অভিনেতা হিসেবে জলছবি, যাদুর বাঁশি, জ্বিনের বাদশা, ঢাকা-৮৬, রামের সুমতি, ম্যাডাম ফুলি, চুড়িওয়ালা, মন বসে না পড়ার টেবিলে, ‘টক জাল মিষ্টি’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘জামাই শ্বশুর’ এবং পার্শ্বচরিত্রে অনন্ত প্রেম, দোলনা, অচেনা, মোল্লা বাড়ীর বউ, হাজার বছর ধরে, চোরাবালি উল্লেখযোগ্য। ষাটের দশকে অভিনয় জীবনের শুরুতে টিভি নাটকে অংশ নেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য টিভি নাটক ছিল- রঙের মানুষ, ভবের হাট, ঘর কুটুম, বউ চুরি, নোয়াশাল, শতবর্ষে দাদাজান প্রভৃতি। তিনি ভালবাসতেন বঙ্গবন্ধুকে। তাইতো দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতি জোটের সঙ্গে। অভিনয়ের বর্ণাঢ্য জীবনে তার প্রাপ্তি কম ছিল না। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক। এর বাইরে আরও নানা উপহারে সমৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। সংসার জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলেও কাউকে কিছু বলতেন না। এটাই প্রকৃত অভিনেতার বড় গুণ। লেখক : সাংবাদিক
×