ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মহিলা ফুটবল লীগে পাতানো খেলা ও পারিশ্রমিক নিয়ে দ্বন্দ্ব

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ১৩ জানুয়ারি ২০২১

মহিলা ফুটবল লীগে পাতানো খেলা ও পারিশ্রমিক নিয়ে দ্বন্দ্ব

ছয় বছর বিরতির পর মহিলা ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৯ সালে। শুরু হয়েছিল ২২ ফেব্রুয়ারি। তবে করোনার কারণে মাঝে কয়েক মাস লীগ বন্ধ ছিল। পরে আবারও শুরু হয়ে শেষ হয় ১৩ ডিসেম্বর। এই লীগে অংশ নেয় সাত দল। ১২ খেলায় ৪ জয়, ৮ হারে ১২ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম হয় বেগম আনোয়ারা স্পোর্টিং ক্লাব। লীগের প্রায় শেষদিকে এসে ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদক এ আর মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কাছে তার দলের ৫ ফুটবলার ও ১ কোচের বিরুদ্ধে দুটি ম্যাচ পাতানোর (নাসরিন স্পোর্টস একাডেমি ও স্পার্টান এমকে গ্যালাকটিকো সিলেট এফসির বিরুদ্ধে ম্যাচে) লিখিত অভিযোগ জমা দেন। ২০১৭ সালের শুরু থেকেই এ ক্লাবে আছেন মনিরুজ্জামান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাফুফের কাছে ওই ম্যাচ দুটির ভিডিও আছে। ভিডিওতে আমার দলের খেলোয়াড়দের খেলা দেখলেই বুঝতে পারবেন আমার অভিযোগের সত্যতা কত।’ মনির আরও বলেন, ‘৫ ফুটবলার ও কোচ জহির ইকবাল ভোলার বিরুদ্ধে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ এনে বাফুফেতে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তারা বলেছে ব্যাপারটা তারা খতিয়ে দেখবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন আপডেট নেই। বরং বাফুফের রিজভী সাহেব আমাকে বলেছেন, আমি যদি এই অভিযোগের স্বপক্ষে কোন তথ্য-প্রমাণ দিতে না পারি, তাহলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি, তারাই আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে।’ আনোয়ারার মেয়েদের ক্যাম্প ছিল ঢাকার উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের রাউজক ভবনে। ওখানে মোট ১৭ মহিলা ফুটবলার ছিল। খেলোয়াড়রা এসেছিল কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, খাগড়াছড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, রাজবাড়ী ও টাঙ্গাইল থেকে। তাদের পাল্টা অভিযোগ জনকণ্ঠে কাছে, প্রায়ই নাকি তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন মনির। বকাঝকা, খিস্তি-খেউড় করতেন। বলতেন, ‘এই দল বানাতে আমার ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আমার তো পুরাটাই লস!’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযুক্ত এক ফুটবলার বলেন, ‘আমরা কোন দোষ করিনি। ম্যাচ ফিক্সিং করিনি। লীগ শেষ হওয়ার আগেই আমাদের পাঁচজনকে লিখিত শোকজ লেটার দেন সাধারণ সম্পাদক। বলেন, দুই দিনের মধ্যে এটার জবাব দিতে হবে। আমরা তখন পারিশ্রমিকের টাকা চাইলে তিনি বলেন, এ নিয়ে তোমাদের সঙ্গে কোন চুক্তি হয়নি। আমরা খোঁজ নিয়েছি দেখেছি অন্য কিছু ক্লাব তাদের খেলোয়াড়দের সঙ্গে লিখিত চুক্তি না করলেও তাদের ঠিকই টাকা দিয়েছে। শুধু আমরাই পাইনি! শুধু করোনার সময়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য আমাদের জনপ্রতি ১ হাজার টাকা করে দিয়েছিলেন।’ আরেকজন বলেন, ‘সিলেটের বিরুদ্ধে ম্যাচের দুইদিন আগেই তিনি আমাদের সবার ফোন সিজ করেন। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়ার পর আমরা শেষ ম্যাচটি খেলতে চাইনি, সেটা জানিয়েও দেই। ম্যাচ খেলার আগের দিন মনির ভাই আমাদের কাছে এসে বলেন খেলতে। আমরা আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ চাইলে তিনি তখন আমাদের কাছে মাফ চান। বরং তিনি নিজেই তখন আমদের বলেন, শেষ ম্যাচে আমাদের হেরে যেতে! আমরা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ি। যাহোক আমরা ম্যাচটি খেলি এবং এফসি উত্তরবঙ্গকে ৪-২ গোলে হারাই।’ এদিকে মেয়েদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মনির বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মেয়েদের সব অভিযোগই মিথ্যে। তবে তাদের যে পুলিশের কথা বলেছি, সেটা স্বীকার করছি। আসলে আমি তাদের পুলিশের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ বা আসল ব্যাপারটা জানার চেষ্টা করেছিলাম। তবে তাদের গালমন্দ করিনি, কোন হুমকিও দেইনি।’ মনির স্বীকার করেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে পারিশ্রমিক বিষয়ে কোন লিখিত চুক্তি ছিল না। চুক্তি ছিল মৌখিক ভিত্তিতে। ভাল খেলা, নিয়মিত খেলা, প্রথম একাদশে খেলা ও সাইডবেঞ্চে বসে থাকার প্রেক্ষিতে তাদের পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়েছিল জনপ্রতি ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ২৩ ফুটবলারকেই পারিশ্রমিক দেয়ার দাবি করেন। তবে কোন রশিদ দেননি। মনির বাফুফের ক্যাম্প থেকে চার ফুটবলার (কাকলি, সুমি, মাহফুজা ও মুরধনি কিসুক) ধার নেন লিখিত আবেদন করে। লিখিত চুক্তি অনুযায়ী তাদের পারিশ্রমিক ছিল ম্যাচ প্রতি দুই হাজার টাকা করে। তারা দুটি ম্যাচ খেলেছিল। ফলে তাদের মোট ১৬ হাজার টাকা দেন মনির। মনির বলেন, ‘কোচ ভোলা ম্যাচ পাতানোর জন্য জুয়াড়িদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। তিনি দলের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ককে সব সময় নিয়ন্ত্রণ করতেন। ম্যাচের আগে কখনই ম্যানেজমেন্টের কাছে মোবাইল ফোন জমা দিতেন না। পারিশ্রমিকের ব্যাপারে মৌখিক চুক্তি হয়েছিল।’ কোচ ভোলা বলেন, ‘দুই ম্যাচ পরেই আমাকে মানা করে দেন মনির। এক টাকাও পারিশ্রমিক পাইনি। অথচ আশ্বাস দিয়েছিলেন আমাকে ৩০ হাজার টাকা দেবেন।’ ২০১৩, ১৪, ১৫ সালে রাজশাহীর বাগমাড়া খদ্দকৈড় স্কুল বঙ্গমাতা ফুটবলে তৃতীয় হয়েছিল। ওই দলের কোচ ছিলেন ভোলা। ২০১৭ আসরে তার কোচিংয়ে চারঘাট স্কুল রানার্সআপ হয়। দাবি করেন ওই চারবারই তিনি পুরস্কার নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে। এছাড়া ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু অ-১৭ ফুটবলে রানার্সআপ রাজশাহী বিভাগেরও কোচ ছিলেন ভোলা। সেবার তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে। জনকণ্ঠকে এসব তথ্য জানিয়ে ৪৭ বছর বয়সী রাজশাহীর কাদিরগঞ্জ নিবাসী ভোলা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।’ দলের ম্যানেজার আবুল কাশেম সোহাগের বিরুদ্ধে অবশ্য ম্যাচ পাতানোর কোন অভিযোগ দেননি মনিরুজ্জামান। কিন্তু তার বিরুদ্ধেই উল্টো একগাদা অভিযোগ করলেন সোহাগ, ‘মনিরের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। ক্যাম্পে তিনি মেয়েদের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রেখেছেন। ভাল খাবার দেননি। রান্না মেয়েদের দিয়েই করাতেন। মেন্যু ছিল আলু ভর্তা, ডাল। কালেভদ্রে মাংস। মেয়েদের টাকা-পয়সাও দেননি। তারা কোন পাতানো ম্যাচ খেলেনি, আমার কাছে তা মনে হয়নি।’
×