ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ২০২১

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১ জানুয়ারি ২০২১

অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ২০২১

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ করোনার বছর ২০২০ কাটিয়ে আসছে ২০২১। হাজারো মানুষের স্বজন হারানো, চাকরি হারানো, পুঁজি হারানো, অর্থনীতিকে স্থবির করা বছর ২০২০ সালকে পেছনে ফেলে সামনের বছরটি বাংলাদেশের জন্য হবে সম্ভাবনায় ভরপুর। মহামারীর ধাক্কা সামলে নিয়ে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এখনও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রয়েছে। প্রবাসী আয় দ্রুতগতিতে বাড়ছে। রফতানি আয় বাড়ছে। মেগা প্রকল্পে গতি এসেছে। সঙ্কটে থাকা শেয়ারবাজার এখন প্রাণ খুঁজে পেয়েছে। ব্যাপক বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত রয়েছে টাকা ব্যাংকের কাছে। ফলে ২০২১ সাল হবে বাংলাদেশের জন্য সমৃদ্ধির বছর। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ২০২০ সালের করোনার আঘাতের পরও দেশের অর্থনীতির যেসব সূচক ভাল অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো ২০২১ সালে আরও শক্তিশালী হবে। আর যেগুলো দুর্বল অবস্থায় আছে, সেসব সূচকও ঘুরে দাঁড়াবে। আগামী জুলাই-আগস্টের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় উল্লম্ফন শুরু হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, ‘আপাতত মনে হচ্ছে করোনা একেবারে চলে যাবে না, টিকা এলেও দেরি হতে পারে। তার মতে, দ্বিতীয় ধাপের করোনায় যদি লকডাউনে যেতে না হয়, তাহলে অর্থনীতির সব সূচকই গতিশীল হবে।’ তিনি বলেন, ‘এখন দেশে বিনিয়োগ শূন্য। তবে নতুন বছরে দেখা যাবে, সবাই বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। করোনার কারণে যেসব কাজ ঝিমিয়ে পড়েছিল, সেগুলোও সচল হবে। অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াবে।’ ড. জায়েদ বখতের সঙ্গে একমত পোষণ করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘আগামী মার্চ পর্যন্ত এভাবে যাবে। তবে আগামী জুলাই-আগস্টে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘দেখা যাবে, হঠাৎ করে ওই সময় বিনিয়োগ শুরু হয়ে গেছে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। কারণ, অনেক দেশই টিকা পেয়ে যাবে।’ তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের সব মানুষ টিকা পেতে আরও কয়েক বছর লাগলেও উন্নত দেশগুলো আগেই টিকা পেয়ে যাবে। ফলে তাদের কেনাকাটা, ভ্রমণ, ভোগ ব্যয় বাড়বে। তখন আমাদের রফতানি ও শ্রম বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সরকারের কাক্সিক্ষত অর্জনের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যাওয়ার বছর ২০২১। জনগণকে দেয়া সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ভিত তৈরি হবে ২০২১ সালেই। অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা জানালেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের শক্তিশালী রিজার্ভ গড়ার লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি ২০২১ সালেই পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে ২০২১ সালেই। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে দুই-তিনটি প্রকল্পের কাজ সমাপ্তির বছর হবে ২০২১। মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকারের বড় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে দেশের ৮ লাখ ৮২ হাজার ৩৩টি ঘরহীন পরিবারকে আধপাকা টিনশেড ঘর নির্মাণ করে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১৭ মার্চের মধ্যেই এসব ঘরহীন মানুষের মাথার ওপর ছাদ তুলে দেয়া সম্ভব হবে। সূত্র জানিয়েছে, করোনার মধ্যে প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও নিয়মিত রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। কঠিন সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স শক্তিশালী করেছে রিজার্ভকে। অর্থনীতির চাকা বেগবান রাখতে বড় অবদান এই রেমিটেন্সের। ২০২০ সালের শেষে এসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৪৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এমন রিজার্ভ বিরল ঘটনা। ২০৩০ সালের আগেই রিজার্ভ দাঁড়াবে ৫০ বিলিয়ন ডলারে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ দশমিক ১৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে, যা আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার অন্যতম মাইলফলক। নতুন একটি বছরের শুরুতে অবশ্যই জাতির জন্য এটি সুখকর ঘটনা। অপ্রত্যাশিত অভিঘাত কোভিড-১৯ এর মধ্যেও রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে রেমিটেন্সের অন্তঃপ্রবাহ।’ সূত্র জানিয়েছে, সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উন্নত পরিবেশে তাঁতি এবং তাঁতি পরিবারের জন্য বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি, তাঁতিদের জীবনযাত্রার মান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং তাঁতশিল্পের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী স্থাপন প্রকল্পটি ২০২২ সালে খুলে দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত রয়েছে। এ প্রকল্পের কাজও শেষ হবে ২০২১ সালে। ঢাকা বিভাগের মাদারীপুর জেলার শিবচর ও শরীয়তপুর জেলার জাজিরায় প্রকল্পটির জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বরাদ্দের পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটির শতভাগ বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জানা গেছে, স্বপ্নের পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবে ২০২২ সালে। ইতোমধ্যেই সেতুর ৪২টি পিয়ারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ করার মধ্য দিয়ে সেতুর মোট ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ সেতুর অবকাঠামোগত কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সেতু বিভাগ। এ সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের ২১ জেলার সংযোগ ঘটবে। দুই স্তর বিশিষ্ট ইস্পাত ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরে একটি রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর আববাহিকায় প্রতিটি ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এই সেতু। উড়ালের পথে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। এটি চলবেও উড়ালপথে। সব ঠিক থাকলে ২০২২ সালে চলতে শুরু করবে মেট্রোরেল। জানা গেছে, ২০২১ সালের শুরুতেই শুরু হবে এর পরীক্ষামূলক চালনা। রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল-কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করতে পারবে মেট্রোরেল। বর্তমানে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের কাজ চলছে পুরোদমে। দিয়াবাড়ী ডিপো থেকে তিনটি স্টেশন প্রস্তুত হয়ে গেছে। এখন চলছে স্টেশন তিনটির বৈদ্যুতিক সংযোগ ও অন্যান্য কারিগরি কাজ। ইতোমধ্যেই জাহাজ ভিড়েছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়িতে। বন্দরে নোঙর করা মাদার ভেসেলটির নাম ভেনাস ট্রায়াম্প। পানামার পতাকাবাহী জাহাজটির ড্রাফট সাড়ে পাঁচ মিটার। গত ২৯ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা জাহাজটি প্রথমবারের মতো গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায় মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য নির্মিতব্য জেটিতে প্রবেশ করেছে। যদিও ২০২৫ সালের শেষ দিকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালুর সময়সীমা নির্ধারিত আছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে দুই দেশের মধ্যে বিগ-বি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাতারবাড়িতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে জাইকার অর্থায়নে নিপ্পন কোয়েই ও আমাদের স্থানীয় একটি ফার্মকে এই প্রকল্পের কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৬ নবেম্বর থেকে বন্দরের চূড়ান্ত নক্সা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ২০২৬ সালের মধ্যে এ বন্দর কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্য নির্ধারিত থাকলেও আগামী ২০২১ সালে পুরোদমেই জাহাজ ভিড়তে শুরু করবে এ বন্দরে। কারণ, এর আগেই ২০২২ সালের আগস্টের মধ্যে একটি কয়লা টার্মিনালও নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরে যুক্ত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর বাইরেও রাজধানী ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি রেলসংযোগ স্থাপন করতে সরকারের নেয়া দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী আগামী ২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। তবে এ প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজের উল্লেখযোগ্য অংশ ২০২১ সালেই শেষ হবে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, ‘করোনা সঙ্কট আমাদের অর্থনীতিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। বাংলাদেশের অর্থনীতি ঠিক জায়গায় আছে। ভাল অবস্থানে আছে। যেটা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। আমরা বিশ্বাস করি ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। ২০২১ সাল হবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার বছর। এ বছরই প্রণীত হবে ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেট। এটিও হবে একটি রেকর্ড। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, ‘সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ভিত তৈরির বছর হবে ২০২১। সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তবের দুয়ারে দাঁড় করিয়ে দেবে ২০২১ সাল। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি।’ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, ‘বৈশ্বিকসহ যে কোন সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সব সময় প্রস্তুত। বাংলাদেশ তা প্রমাণ করেছে করোনা মোকাবেলা করে। সমস্যা কাটিয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্য এগিয়ে চলেছে। ২০২১ সাল হবে বাণিজ্যের বছর। করোনা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও তা কাটিয়ে নতুন বাণিজ্যের দুয়ারও খুলে দিয়েছে।
×