ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডা. মোঃ শহীদুল্লাহ সিকদার

মীমাংসিত বিষয়ে বিতর্ক কাম্য নয়

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১০ ডিসেম্বর ২০২০

মীমাংসিত বিষয়ে বিতর্ক কাম্য নয়

৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনীময়ে, দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রব হারানোর বেদনা ও অজুত লাখো মানুষের অবর্ণনীয় ত্যাগের বিনীময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, তার মাধ্যমে আমরা অনেক প্রশ্নের প্রাকৃতিক মীমাংসা পেয়ে গেছি। ভারতীয় উপমহাদেশে শত শত বছর যাবত সাম্প্রদায়িক সঙ্কট বিরাজ করছে। উপমহাদেশের বাইরে অনেক শাসকই এই ভূখণ্ডকে শাসন করেছেন। অনেকে পরিকল্পিতভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। রাজ্য শাসনে ধর্মের ব্যবহার হয়ত সাময়িকভাবে কোন কোন শাসকের জন্য সুফল বয়ে নিয়ে এসেছে, অথবা জনগণের জন্যও বিচ্ছিন্ন কল্যাণকর কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু সুদূরপ্রসারী কোন কল্যাণ করতে পারেনি। বরং এর ক্ষতির প্রভাব জনগণকে এবং দেশকে বহুদিন যাবত বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। পারস্য বা মধ্য এশিয়া থেকে আগত শাসকরা নানাভাবে ধর্মের ব্যবহারের মাধ্যমে দেশ শাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতিরও চেষ্টা করেছেন। এতে দীর্ঘ মেয়াদে কোন সুফল দেখা যায়নি। উপমহাদেশের কোন কোন শাসক ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে দেশ শাসন করার নানা রকম কৌশল অবলম্বন করেছেন, সফল হননি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বপন করেছে ব্রিটিশ শাসকরা এটি অনেকেই বলে থাকেন। কথাটিকে এতো সরলীকরণ করা বোধহয় ঠিক নয়। ব্রিটিশরা আসলে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে কৌশলে কাজে লাগিয়েছে। ইউরোপে কি বিভিন্ন ধর্মের লোক সম্প্রীতির সঙ্গে একই দেশে অবস্থান করছে না? তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রশাসন, এমনকি ব্যক্তি, পরিবার বা সমাজে কোথাও ধর্মীয় উন্মাদনা কোন অন্তরায় তৈরি করতে পারে না। উপমহাদেশ হলো ধর্মীয় সঙ্কট তৈরির উর্বর ভূমি। দুর্বৃত্ত স্বার্থপর যখনই দেশ শাসনের দুর্বার আকাক্সক্ষায় মেতেছে, তখনই ধর্মের অপব্যবহার মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইংরেজরা ধর্মের অপব্যবহারের জন্য কাদের কাজে লাগিয়েছে, নিশ্চয় ইউরোপের কোন ক্যাথলিক বা অর্থডক্স যাজককে নয়। উপমহাদেশের প্রধান দুই ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদেরই এই কাজে ব্যবহার করেছে। এখানে তারা কখনও নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারেনি। শুধু মধ্যস্বত্বভোগী দালালের ভূমিকায় কাজ করেছে এবং নগদ লাভের আশায় বিদেশীদের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন আমরা ইউরোপে ধর্মীয় যে সকল অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা দেখতে পাই তার জন্য মূলত কারা দায়ী সেটি বোঝার জন্য বেশি কষ্ট করতে হয় না। সত্য স্বীকার করলে বলতেই হবে বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে যে ধর্মীয় অসহিঞ্চুতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তার জন্য ইংরেজ বা ওলন্দাজদের দায়ী করে খুশি থাকলে ক্ষতি হবে আমাদেরই। অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি পৃথিবীর বহু দেশের জন্য জরুরী বিষয় না হলেও উপমহাদেশের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা, শান্তি, স্থিতিশীলতার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য। ধর্মের নামে শাসন নয়, বরং স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, শোষণের জন্য এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা লালন করা হয়। সৎ, দেশপ্রেমিক শাসকদের জন্য ধর্মীয় সুড়সুড়ির আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যারা জনগণের মতামতের ওপর আস্থা রাখতে পারে না, জনগণকে আপন করে নিতে পারে না এবং প্রকৃত জনকল্যাণকর দেশ শাসনের ব্যবস্থা করতে পারে না তারাই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর নির্ভর করে। ধর্ম হাজার হাজার বছর যাবত মানুষের সততা, ন্যায়, অধিকার প্রতিষ্ঠা, কল্যাণ ও শান্তির জন্য চর্চিত হচ্ছে। অন্ধকার যুগে মানুষ ধর্মকে ধারণ করে আলোর পথ খুঁজেছে। দুর্বৃত্ত আর দুঃশাসনকে হঠিয়ে কল্যাণ আর মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই ভূখণ্ডের মানুষের বঞ্চনার অনুষঙ্গগুলোকে। সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন এর কারণসমূহকে। তিনি অন্যান্য কারণের ভেতর সাম্প্রদায়িকতা কিভাবে এই অঞ্চলে মানুষের মানবিকতাকে গ্রাস করছে, উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে সেটি তিনি খুব সঠিকভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাই তিনি সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম বিষয় হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে সন্নিবেশ করেছেন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এটি যেখানে জনকল্যাণে একটি স্বাভাবিক সামাজিক এবং জাতীয় কল্যাণকর বৈশিষ্ট্য হিসেবে রাষ্ট্রে পরিলক্ষিত হওয়ার কথা, সেখান আমরা এর বিপরীতে নতুন নতুন উপসর্গ দেখতে পাচ্ছি। দুনিয়ার বহু দেশে বিশেষ করে উন্নত সমৃদ্ধ দেশসমূহে জাতির পিতা এমনকি দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক, সাহিত্যিক, শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, বৈজ্ঞানিক ও সমাজ সংস্কারক দার্শনিক ব্যক্তিদের ভাস্কর্য আমরা দেখতে পাই। এটি জাতির ঐতিহ্যের বিষয়। ইতিহাসের সাক্ষী, গৌরবের নিদর্শন, প্রেরণার উৎস, সঙ্কটে পথপ্রদর্শক। যে কোন ভাস্কর্যই শৈল্পিক, কবিতা বা সঙ্গীত যেমন সুন্দর আর কল্যাণে নিবেদিত এটিও তাই। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই ভাস্কর্যের মূল্য অপরিসীম। মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় ঘোড়ার পিঠে বীরের ভাস্কর্যটি এখনও আমার চোখে ভাসছে। মরক্কোর রাবাতেও ভাস্কর্যটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অসংখ্য দেশের ভাস্কর্য স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ওই দেশ এবং দেশের মানুষের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির কথা না ভেবে থাকার কোন সাধ্য কারও কি থাকে? তা হলে স্বাধীন বাংলাদেশে জনযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই ভূখণ্ডে আবার সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে কেন পরিকল্পিতভাবে সঙ্কট তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে? মীমাংসিত বিষয়কে কেন আবার সামনে আনা হচ্ছে? এতে বাংলাদেশের বা দেশের মানুষের কি কল্যাণ হবে? জাতির পিতার ভাস্কর্য বানাতে না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রকারান্তরে মুক্তিযদ্ধকে বা স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্বীকার করা হচ্ছে। বিশ্বাস করি, অতীতেও এ ধরনের হীন চক্রান্ত দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। আজকেও প্রতিরোধ করবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে যাবে এবং অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘উন্নত সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াবে।’ লেখক : সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়
×