মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অরাজনৈতিক পরিচয়ের ইসলামী ভাবধারার সংগঠন হেফাজতে ইসলাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চায়। গত ১৫ নবেম্বর নিজেদের অভ্যন্তরে নানাভাবে সমালোচিত কাউন্সিলের পর এমন কথা এখন চাউর হয়েছে। অতি সম্প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে হেফাজতের শীর্ষ নেতারা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন এবং গোপনে যেসব তৎপরতা চালাচ্ছেন তাতে এ সংগঠনটির রাজনৈতিক পরিচয় ধারণ করার সম্ভাবনার বিষয়টি প্রতিভাত হচ্ছে। গোপন তৎপরতার সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির লবিং জোরালোভাবে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়, সর্বশেষ কাউন্সিলে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির মাওলানা শাহ আহমদ শফীর পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের কাউকে কোন পদে রাখা হয়নি। বিএনপি ও জামায়াত জোট সমর্থিত হিসেবে পরিচিত মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী ও মাওলানা নূর হোসেইন কাশেমী যথাক্রমে সংগঠনটির আমির ও মহাসচিব হয়েছেন। ১৫ নবেম্বর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে ১২ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ এবং ১৫৫ জন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যের মধ্যে যে ১২২ জনের নাম ঘোষণা করা হয় তন্মধ্যে বিএনপি জোট সমর্থিত ২০ জনেরও অধিক নেতা রয়েছেন।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্নভাবে পাল্টা কাউন্সিল ডাকার যে অনানুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে তারা এখনও সফল হননি। ক্ষুব্ধ অংশটির এখনও মাঝা ভাঙ্গা অবস্থা। এ সুযোগে বাবুনগরী ও কাশেমী নেতৃত্বাধীন হেফাজত ভেতরে ভেতরে যে সব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন তাতে তারা অরাজনৈতিক পরিচয় থেকে সরে যাওয়ার প্রয়াস নিয়েছেন বলে চাউর হয়ে গেছে। জুনায়েদ বাবুনগরী বিরোধীরা ঢাকা ও চট্টগ্রামে যুগপৎভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মাওলানা আহমদ শফীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ আনলেও তা নিয়ে সংগঠন নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝে তা তেমন কার্যকর প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি।
সূত্র জানায়, বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের সাংগঠনিক তৎপরতা দুর্বল অবস্থানে চলে গেছে। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে জামায়াতের অবস্থা একেবারেই কাহিল। এ সুযোগে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাপক সংখ্যক নেতাকর্মী এটিকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে বিভিন্ন ইস্যুতে মাঠে ময়দানে অবস্থান নেয়ার পক্ষে রয়েছে। মূলত সরকার পক্ষে হেফাজতে ইসলামকে বিভিন্নভাবে সভা সমাবেশ করার সুযোগ দিয়ে তাদের মূল লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাহসী করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হেফাজত হাটহাজারীতে সর্বশেষ যে তাফসির মাহফিল করেছে সেটা যত না ধর্মীয় মনোভাবের ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক বক্তব্যে ভরপুর। অভিযোগ রয়েছে, জামায়াত-বিএনপির কৌশলী নেতাদের ইন্ধনে এমন ঘটনার অবতারণা হচ্ছে।
সূত্রমতে, হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফী, তার পুত্র আনাস মাদানীর অনুসারী মাওলানা মহিউদ্দিন রুহীসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ৭০ নেতাকে কমিটির সকল পদ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তবে আহমদ শফীর জ্যেষ্ঠপুত্র মাওলানা ইউসুফ বাবুনগরীর সমর্থনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। মূলত মাওলানা শফীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের জের হিসেবে বাবুনগরী ও কাশেমী গংরা ফায়দা হাসিলে সক্ষম হয়েছেন বলে আলোচিত হচ্ছে। মাওলানা শফীর জীবদ্দশায় সংগঠনটির পক্ষে দফায় দফায় জানান দেয়া হয়েছে এটি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তার মৃত্যুর পর বর্তমান সরকারের সমালোচক হিসেবে চিহ্নিত এবং বিএনপি জাামায়াত জোটের সমর্থকদের যারা এ সংগঠনটির কমিটিতে স্থান পেয়েছেন তারাই এটিকে রাজনীতিতে টেনে আনার প্রয়াসে লিপ্ত রয়েছেন। গত নবেম্বরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলকে একতরফা যারা বলেছেন তাদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও সমর্থিতদের সংখ্যা অনেক। কিন্তু বিক্ষুব্ধদের নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তাদের শক্ত অবস্থান না থাকার কারণে পাল্টা কাউন্সিলের প্রস্তুতি কথার কথায় রয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, কওমিপন্থীদের এ সংগঠনটির সমর্থন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক। সারাদেশে কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম নয়। সাধারণ জনগণের মধ্যে হেফাজতের সমর্থনের সুদৃঢ় কোন অবস্থান নেই। এখন সরকারের পক্ষে তাদের প্রতি ইতিবাচক ভূমিকার কারণে সুযোগ নিতে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগাতে চায় হেফাজতের বর্তমান নেতৃবৃন্দ। অতীতে যেমন বিএনপি জোট ধর্মীয় অনুভূতির সুড়সুড়ি দিয়ে ধর্মপ্রিয় অনেকের সমর্থন পেতে সক্ষম হয়েছে। এ বিষয়টিকে সামনে রেখে হেফাজতের বর্তমান শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অনেকের ধারণা সে পথে অগ্রসর হলে তারা সফল হবেন। যদিও এ বিষয়ে এসব নেতাদের কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। তবে ভেতরে ভেতরে তারা মূল লক্ষ্যে এগোনোর পথে রয়েছে বলে জানা গেছে। দেশে যে সমস্ত ইসলামী দল রয়েছে এবং এদের মধ্য থেকে যাদের কোন গণভিত্তি নেই এরাই মূলত হেফাজতকে রাজনীতিতে টেনে নেয়ার ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সফল হওয়ার নানা গল্প শোনানো হচ্ছে। কিন্তু হেফাজতের ঘোষণা অনুযায়ী তারা অরাজনৈতিক। এ ঘোষণা থেকে সরে গেলে পরিস্থিতি কি হতে পারে তা নিয়েও তারা চিন্তিত। এখন ঘোষণা না দিয়ে তারা রাজনৈতিক দলের মত তৎপরতা শুরু করেছে। এতে ধর্মপ্রিয় মানুষের সমর্থন ব্যাপকতর হলে তখন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে বলে হেফাজতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।