ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মজিবর রহমান

বঙ্গবন্ধুর প্রিয় হাবু মিয়ার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ২১ নভেম্বর ২০২০

বঙ্গবন্ধুর প্রিয় হাবু মিয়ার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন

বঙ্গবন্ধু সরকারের পাট প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়ার আজ ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী। এক কঠিন সময়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া পরিণত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শের এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে। তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। দেশের মানুষকে ভালবাসতেন বলেই তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তার কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল ও গভীর। তার মতো এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের সুযোগ হয়েছে আমার। এ জন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। জীবন আমার ধন্য। আমি একজন বড় মাপের মানুষের সেবা করা এবং তার সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই বর্ষীয়ান নেতার রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য জীবন আলেখ্য লেখা বা বিশ্লেষণ করার মতো যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু তার সঙ্গে থেকে তাকে নিবিড়ভাবে দেখেছি, তার সঙ্গে মিশেছি, তার দুঃখের সঙ্গী হতে পেরেছি। তার সাহচর্যে যা কিছু শিখেছি, দেখেছি তা আমাকে সবসময় অভিভূত করেছে। বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এই জননেতা সকল শ্রেণীপেশার মানুষের বিপদে-আপদে আন্তরিকতার সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। তার ব্রত ছিল মানব কল্যাণ। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে সর্বদা তার উপস্থিতি প্রত্যেক নেতাকর্মীর মধ্যে প্রাণসঞ্চার করত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তেরশ্রীতে ৪৩ জন শহীদ স্মরণে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়ার দিক নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণায় একটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ভূমিকার কথা আমরা চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব। দুর্দিনে, দুঃসময়ে, প্রয়োজনে তিনি কখনও নির্লিপ্ত থাকেন নি। একদিন হঠাৎ করে আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় নেতার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে মানিকগঞ্জ ১ আসনের সাবেক সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার এ বি এম আনোয়ার হক, দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ্যাডভোকেট আজিজুল হক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদ ও আমার প্রিয় বন্ধু এ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ ও আমিসহ দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ঢাকার পরিবাগে মডিউল হাসপাতালে শ্রদ্ধেয় নেতাকে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন শ্রদ্ধেয় নেতা। দেখা হলো, কথা হলো না। নিথর নিস্তব্ধ, কথা বলতে পারছেন না। শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন আমাদের দিকে। আমি কয়েকবার নেতার মাথায় হাত বুলিয়ে কাকা বলেই ডাকলাম। কিন্তু তিনি কথা বলতে পারছেন না। ২০১৩ সালের ১৬ নবেম্বর সেই দিনটাই ছিল নেতার সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা। ২০১৩ সালের ২১ নবেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১টায় তিনি পরিবারে স্ত্রী, একমাত্র ছেলে ও তিন কন্যাসহ বহু আত্মীয়স্বজন ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী রেখে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে যান। মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সকল নেতাকর্মীদের সর্বসম্মতিক্রমে মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ের পাশেই শ্রদ্ধেয় নেতাকে সমাহিত করা হয়েছে। দীর্ঘ ৮৫ বছরের জীবন পরিক্রমায় ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অবধি তার চিরদীপ্ত পদচারণা। মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন বার বার তাকে তাড়িত করছে। তাই তিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ৮৫ বছরে দাঁড়িয়েও নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার দীর্ঘ জীবন কেটেছে মানুষের মুক্তির সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে। জীবনের ভোগ বিলাসিতা ত্যাগ করে ক্ষমতা চর্চায় লিপ্ত না থেকেও তথাকথিত নেতাদো সামনে তার জীবন এবং উপস্থিতি এক বাস্তব ও নীরব প্রতিবাদ। মনিকগঞ্জ সদরের গড়পাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত ধন্যাঢ্য মুসলিম পরিবারে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই ক্ষণজন্মা মানব প্রেমিক মানুষটি। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়ার মতো ত্যাগী নেতার আজ খুবই প্রয়োজন। তিনি সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে গেছেন। তার মৃত্যুতে মানিকগঞ্জ আওয়ামী লীগ পরিবারে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা আর কখনও পূরণ হবার নয়। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। ১৯৫৫ সালে এলএলবি পাস করার পর ১৯৫৭ সালে মানিকগঞ্জ বারে আইন পেশায় যোগ দেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া আইন পেশায় জীবনের ৫০ বছরের বেশি সময় পার করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ভালবাসার এ মানুষটি তিন তিন বার ভোটযুদ্ধে জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি জেলা বারের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন দীর্ঘদিন এবং তিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হন এবং পরে তিনি আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়ে গোটা মানিকগঞ্জে জনমত গড়ে তোলেন। ১৯৫৯ সালে ১১ দফার দাবিতে ছাত্র আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমএলএ নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন এবং মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে ভারতের বিহার রাজ্যে অন্যান্য এমএলএ ও পরে এমপিদের সঙ্গে এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের পাট প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও। তিনি মানিকগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, মানিকগঞ্জ ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও মানিকগঞ্জ স্টেডিয়াম, অফিসার্স ক্লাব প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আমৃত্যু মানব মুক্তির স্বপ্ন দেখা এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জানাই আমার গভীর ভালবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। লেখক : সাংবাদিক
×