ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

উজাড় করে দিচ্ছে ফসলের ঋতু হেমন্ত

গোলা ভরে উঠছে নতুন ধানে, চলছে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২৯ অক্টোবর ২০২০

গোলা ভরে উঠছে নতুন ধানে, চলছে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি

মোরসালিন মিজান ॥ ছয়টি ঋতু শুধু নয়, সবক’টিই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। দু’মাস পর পর তাই বদলে যায় প্রকৃতি। এই যেমন কয়েকদিন আগেও একটা গরমাগরম অবস্থা চলছিল। এখন ঠা-ার অনুভূতি। কারণ হেমন্ত চলে এসেছে। হেমন্ত, হ্যাঁ, শীতের বাহন। তবে ফসলের ঋতু হিসেবেই বেশি পরিচিত। এরই মাঝে নতুন ধানে দোল খেতে শুরু করেছে বাংলার কৃষকের স্বপ্ন। পাকা ধান কাটা শুরু করে দিয়েছেন অনেকে। চলছে মাড়াইয়ের কাজ। হাতছানি দিচ্ছে প্রিয় প্রাচীন নবান্ন উৎসব। কার্তিক অগ্রহায়ণ এ দুই মাস হেমন্ত কাল। বর্তমানে চলছে কার্তিক। এ মাসের একসময় খুব বদনাম ছিল। বলা হতো অনটনের মাস। কার্তিকে এসে দেশের অনেক অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। শূন্য হয়ে যেত কৃষকের ধানের গোলা। দুর্বিসহ দিন কাটতে চাইত না সহজে। কার্তিককে তাই ‘মরা কার্তিক’ বলে ভর্ৎসনা করা হতো। অভিন্ন অনুভূতি থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে...। তবে যত দিন গেছে ততই বদলে গেছে হিসেব-নিকেশ। চৈত্র আর আগের মতো নেই। এ মাসেও পাওয়া যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধান। বস্তুত শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে এখন মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও ভাল। কার্তিক মাসে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে বলে জানা গেছে। বগুরা, রংপুর, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলার কৃষক ব্যস্ত সময় পার করছেন এখন। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কিষানি। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে তাদের। তবে মূল অপেক্ষা নবান্ন উৎসবের। পরের মাস অগ্রহায়ণের প্রথম দিন নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হবে। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবটি নবান্ন নামে পরিচিতি পায়। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। ইতিহাস বলে, হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। লোককবির ভাষায়: আইলো অঘ্রাণ খুশিতে নাচে প্রাণ/ চাষী কাঁচিতে দিল শাণ/ কাঁচি হাতে কচ কচা কচ কাটে চাষী পাকা ধান...। নতুন এই ধান ঘরে তোলার পর আয়োজন করা হবে নবান্ন উৎসবের। বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে পায়েস রান্না করা হয়। নবান্ন উৎসবের দিনে বাংলার কৃষকের ঘরে হরেক পদের রান্না হবে। আর পিঠাপুলি পায়েসের কথা তো বলাই বাহুল্য। ঘরে ঘরে পিঠাপুলি পায়েস হবে। ধুম পড়বে নেমন্তন্ন খাওয়া ও খাওয়ানোর। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসবের অনন্য সাধারণ ছবি এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। ৭০ ফুট জায়গাজুড়ে বাংলার কৃষি কৃষক ও কৃষি ভিত্তিক উৎসবকে মূর্ত করেছিলেন তিনি। অগ্রহায়ণ মাসে বাংলার ঘরে ঘরে ফসল কেন্দ্রিক যে ব্যস্ততা, যেসব অনুষ্ঠান আনন্দ হাসিরাশি- সবই এখানে অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়। জলরংয়ে আঁকা স্ক্রল চিত্রকর্মটিও অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। রাজধানী শহরে বসেই এ ছবি এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য। অবশ্য আজকের নাগরিক জীবনে নতুন ধান বা চালের কোন অস্তিত্ব নেই। নেই বললেই চলে। রাজধানী শহর ঢাকায় বসে শুধু অনুভব করা যায়। সে অনুভবের জায়গা থেকে শেকড় সন্ধানী মানুষ চিরায়ত ঐতিহ্য মেনে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। প্রতিবছর ১ অগ্রহায়ণ রাজধানী ঢাকায় প্রতীকী নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। এভাবে শেকড়ের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার অনুপ্রেরণা হয়ে আসে হেমন্ত।
×