ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পারিবারিক কলহের কারণ ও প্রতিকার

প্রকাশিত: ২০:২৯, ২৭ অক্টোবর ২০২০

পারিবারিক কলহের কারণ ও প্রতিকার

গত ছয় মাসে সিটি কর্পোরেশনের পারিবারিক আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের পরিমাণ বেড়েছে ৫০ শতাংশ। যখন চারদিকে মানুষের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনগুলো শিথিল হতে দেখি, তখন কারণগুলো অনুসন্ধান করি এবং প্রতিকার কিভাবে হবে সেটা নিয়েও চিন্তা করি। এটি সামাজিক জীব হিসেবে দায়িত্ব বলে মনে করি। আমরা যদি মনে করি পারিবারিক অশান্তি নিছক একটি শব্দ তবে ভুল ভাবছি। সেটি একক শব্দ নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে খুন, ছিনতাই, মাদক আসক্তি, ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর কিছু শব্দ। পারিবারিক অশান্তির কারণ হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি অনেক কারণ। যেমন-অর্থনৈতিক, সামাজিক জটিলতা ফেসবুকের মাত্রাহীন ব্যবহার, পরস্পরের দিকে ভালবাসার পরিবর্তে মিথ্যা সন্দেহের তীর ছুঁড়ে মারা, সঠিক সাংস্কৃতিক আবহাওয়া থেকে নিজেদের দূরে রাখা, মাদকাসক্তসহ অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্যের সঙ্গে নিজেদের চড়ানো, ধৈর্যহীনতা, জীবন দর্শন নিয়ে চিন্তা না করে, ব্যস্ততার কারণে মা বাবা ও সন্তানের সম্পর্কের মধ্যে হৃদয়ের গভীরতা কমে যাওয়া, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ ইত্যাদি। বর্তমান সমাজে নিজেদের আধুনিক হিসেবে আখ্যা দিতে পছন্দ করি, কিন্তু যৌতুক কিংবা বাল্যবিবাহের দিক থেকে সেই পুরনো ধ্যান-ধারণা নিয়ে আছি। সমাধানে কিছু পথ হয়তো এমন ভাবে চিন্তা করা যেতে পারে- (ক). কোন ব্যক্তি ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হচ্ছে না, অফিস থেকে তার আয়ের উৎসটি অতটা ভাল নয় কিংবা কোন কাজে বার বার হেরে যাচ্ছে- এমন হতেই পারে এবং এটি স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত ধারায় দেখি ঘরের বাইরে যে কোন অর্থনৈতিক অবনতির কারণ হলেই ঘরে এসে বউ পেটানোর একটি রেওয়াজ চালু আছে। অর্থনীতির সমস্যা থাকবেই। কোন মানুষের জীবনের সব সময় একই রকম যাবে না। এর মানে এই নয় যে স্বামী-স্ত্রী কলহে মেতে উঠবে। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে একটি চিত্র চোখের সামনে বার বার দেখতে পাচ্ছিÑস্বামী কিংবা স্ত্রী সন্তানকে মেরে ফেলেছে। মাকে সন্তান হত্যা করছে। নিজেরা আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। বর্তমানে অতিরিক্ত মাত্রায় এই ঘটনাগুলো ঘটছে। এ থেকে অবশ্যই উত্তরণের পথ আছে। বিশ্বাস করি অর্থনৈতিক সমস্যা সবচেয়ে জটিল সমস্যা। কিন্তু ঘরে বাইরে দু’জন যদি এ থেকে বের হবার পথ খুঁজে বেড়াই, তবে কোন না কোন পথ অবশ্যই বের করা যাবে। সত্যিকার অর্থে যখন যেমন তখন যদি সেরকম ভাবে আমরা পারিবারিক অর্থনৈতিক চাকা ঘুরানোর চেষ্টা করি, তবে অনেকাংশে মনের অশান্তি কমে যাবে বলে মনে করি। এর মানে আয় বুঝে ব্যয় করা। (খ). দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধুকে ফিরিয়ে আনাসহ হাজারো সুন্দর ঘটনা আমরা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলেও অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের পারিবারিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে তৈরি করে দুর্বিসহ যন্ত্রণা। এখানে এটাও দেখা যায় ফেসবুকে আসক্তির কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানদের প্রতি অবহেলা করছেন। অনেকে আবার জড়িয়ে পড়ছেন পরকীয়ার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনায়। অতিরিক্ত ফেসবুকের ব্যবহার অনেক সময় সন্দেহ নামক বিষবৃক্ষ আমাদের মাঝে বপন করে। ফেসবুক ব্যবহার করব, তবে সেটি মাত্রা বুঝে। (গ). সন্দেহ একটি জটিল রোগ। এর জন্য অনেক ক্ষেত্রে কোন কারণের প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি মানুষকে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত। কে বন্ধু, কে ভাই, কে বোন, কে অফিসের বস- সবক্ষেত্রেই সম্পর্কের ধরণ আলাদা। যখন আলাদা সম্পর্কগুলো আমরা আলাদা না রেখে এক করে ফেলি, তখনই সন্দেহের মতো ভয়ঙ্কর যুদ্ধ এবং পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়। (ঘ) আমরা আজকাল অপসংস্কৃতির পরিবেশের মধ্যে বসবাস করি। দেশীয় সাংস্কৃতিক আবহাওয়া আমরা ভুলতে বসেছি। পারিবারিক পরিম-লে গান বাজনা, হাসি ঠাট্টা করা, বই পড়া সমস্তটাই যেন ভুলতে বসেছি। মৃতদেহের সঙ্গে সেলফি তোলার মতো নিষ্ঠুরতা আমাদের রেওয়াজ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বই পড়ার পরিবর্তে শিশুদের হাতে চলে এসেছে দামি মোবাইল ফোন, যা শিশুদের করছে একরোখা, এক ঘরে। তাই নিজেদের ও সংস্কৃতির মধ্যে থাকতে হবে দেশীয় ঐতিহ্যকে অনুসরণ করতে হবে এবং শিশুদের দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে। তবেই পরিবার হবে সুখী পরিবার। (ঙ). অনেক ক্ষেত্রেই সবাইকে বলতে শোনা যায় পরিবারের সঙ্গে মূল্যবান সময় কাটানোর সময় কোথায়? সারাদিন তো ব্যস্ত ব্যস্ত ব্যস্ত, এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই অফিস কিংবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানেই আমরা থাকি না কেন, প্রত্যেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন কমিটি থাকতে হবে, যাদের কাজ হবে প্রতিটি মানুষকে একটি সময়ের পরে, আরামের জন্য, পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য, বিনোদনের জন্য কিছু সময় প্রদান করা। যার ফলে ওই মানুষটি আরও উৎফুল্ল হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে নিজ নিজ কাজ করতে পারবেন। মনের প্রফুল্লতা পারিবারিক জীবনে সুখী হতে সাহায্য করবে। (চ) আমরা যখন ঝগড়া করি করে তখন কি পরিবারের শিশুটির কথা ভাবি। একবারও কি আমাদের মনের কোণে উঁকি দেয় না এই কলহ শিশুটির অবুঝ মনে কতটা দুঃস্বপ্নের কারণ হতে পারে। শিশুটি হতে পারে হিং¯্র, মায়াহীন, অমানবিক। এ কারণেই মা বাবা হিসেবে সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে হলেও জিহ্বা সংযত রাখতে হবে। নিজেদের করতে হবে ধৈর্যশীল। (ছ) অনেকক্ষেত্রে পরিবারের তৃতীয় ব্যক্তির আগমনে যেমন শ্বশুর-শাশুড়ি ভাই, বোন, মা বাবা, খালা যে কোন ব্যক্তি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আবির্ভাব ঘটতে পারে। তৃতীয় ব্যক্তির মাথাচাড়া ভাব নির্মূল ঘটাতে পরস্পরের বোঝাপড়া ও ভালবাসার খুব প্রয়োজন। এই তৃতীয় পক্ষ একসময় ভয়াবহ পারিবারিক অশান্তির কারণ হতে পারে। যৌথ পরিবার আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের মধ্যে কে ভাল, কে মন্দ, কে আমাদের খারাপ চায় এসব বিষয় আমাদের বুঝতে হবে এবং সেই সঙ্গে পরস্পরকে জানতে ও বুঝতে হবে। নিজেকে সুস্থ রাখতে হলে, পারিবারিক বন্ধনকে অক্ষত রাখতে হলে কলহ থেকে নিজেকে এবং অন্যকে দূরে রাখি, সমাজকে বাঁচাই, পরিবারকে বাঁচাই। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
×