ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পটচিত্রেই ফুটে উঠত প্রতিমা, মহাভারত রাবণবধ উপাখ্যান

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ২২ অক্টোবর ২০২০

পটচিত্রেই ফুটে উঠত প্রতিমা, মহাভারত রাবণবধ উপাখ্যান

মোরসালিন মিজান ॥ শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়ে গেল। এ উৎসবের আজ যে সর্বজনীন রূপ আমরা দেখি, এক সময় তা এমন ছিল না। ধনিকশ্রেণীই মূলত উৎসবের আয়োজন করত। দরিদ্রদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল যৎসামান্য। তখন বিকল্প হিসেবে পটে আঁকা হতো প্রতিমা। দেব-দেবীর পটে আঁকা প্রতিমা সামনে রেখে পূজা করত সাধারণ মানুষ। বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ পটচিত্রের ইতিহাস অনেক অনেক পুরনো। পটচিত্র মানে, পটে আঁকা চিত্র। পট শব্দের অর্থ কাপড়। কাপড়ের ওপর দেশী রং দিয়ে বিশেষ এ ছবি আঁকা হয়। বাংলায় সাধারণত দু-ধরনের পট প্রচলিত রয়েছে। একটি চৌকাপট। অন্যটি বহুপট বা দীর্ঘপট নামে পরিচিত। যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিল না তখন এ পটচিত্র প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যকে সযতেœ ধারণ করেছিল। বারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত চর্চাটি বিশেষ জোরালো হয় বলে জানা যায়। যারা পট আঁকেন তারা পটুয়া নামে পরিচিত। স্বশিক্ষিত শিল্পীরা বংশানুক্রমিকভাবে পটচিত্র আঁকার কাজ করতেন। চিত্র দেখিয়ে গান করতেন। গানে গানে কেচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা করতেন তারা। এখন গান করতে তেমন দেখা না গেলেও, কমবেশি পট আঁকা হয়। পটের বিষয়বস্তু বিচিত্র। বিষয় বেধে পটকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এই যেমন, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, পরিবেশগত ও বিষয়নিরপেক্ষ পট। যতদূর তথ্য- চর্চার শুরুটা ধর্মীয় পট দিয়ে। ধর্মীয় বিশ্বাসকে টেকসই করে এমন গল্প ও পৌরাণিক কল্প-কাহিনী আলাদা গুরুত্ব পেত তখন। গাজীর পটের কথা তো সবার জানা। খুবই বিখ্যাত। মুসলমানদের গাজীর পটে গাজীকালু-চম্পাবতীর কাহিনী, গাজীপীরের বীরত্বগাঁথা অলৌকিক কর্মকা- তুলে ধরা হতো। আর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য ছিল রামকাহিনী, কৃষ্ণকাহিনী। মহাভারত ও রামায়ণ উপখ্যান থেকে চরিত্র খুঁজে নিয়ে উজ্জ্বল রঙে আঁকা হতো। পটে আঁকা হতো দুর্গাপট ও লক্ষ্মীপট। মাটির প্রতিমা গড়ে পূজা করার সাধ্য ছিল অল্প লোকের। তারা পটের আশ্রয়ে দেব-দেবীর পূজা করত। রঙিন দুর্গোৎসব সম্ভব না হলেও, শতভাগ ভক্তি নিয়েই পূজা হতো দুর্গাপটের। একইভাবে আঁকা ছবি সামনে রেখে দেবী লক্ষ্মীর অর্চনা করা হতো। তবে বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী শিল্পের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েক পটুয়া সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চর্চাটি ধরে রেখেছেন। তাদেরই একজন মুন্সীগঞ্জের পটুয়া শম্ভু আচার্য। বিখ্যাত শিল্পী। এক সময় তার পটে মহাভারত ও রামায়ণের চরিত্র এঁকেছেন। বুধবার সেগুলো সঙ্গে নিয়েই ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। হাতে নিয়ে দেখা গেল, একটি পটচিত্রে রামায়ণের কাহিনী। পটের কেন্দ্রে রয়েছে রাবণবধের মুহূর্তটি। এর চারপাশে আলাদা আলাদা ফ্রেমে আরও বেশ কিছু ছবি। খ-চিত্রে ঘটনাবলী ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার শিল্পীত প্রয়াস। অপর পটচিত্রে মহাভারতের উপাখ্যান। এখানে কুরুক্ষেত্রের অর্জুনকে তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চপা-বের অন্যতম অর্জুন তার রথে চড়ে ছুটে চলেছেন। সঙ্গী হয়েছেন কৃষ্ণ। শম্ভুর পটের মূল রঙটি লাল। এর পর চোখে পড়ে সবুজ আর নীল রঙের ব্যবহার। প্রাকৃতিক রং আর ফর্মের ভিন্নতার কারণে ছবি দুটি আলাদা আবেদন সৃষ্টি করে। শম্ভু আচার্য বলছিলেন, এক সময় রামায়ণপট, মহাভারতপট খুব জনপ্রিয় ছিল। দুর্গাপূজার সময় রামায়ণ গান করা হতো। ম-পের মঞ্চের দৃশ্যমান কোন স্থানে পট ঝুলিয়ে রেখে রামায়ণ গান গাওয়া হতো। এ পট দেখিয়ে বর্ণনা করা হতো রাবণবধের কাহিনী। পটে আঁকা দেব-দেবীর মধ্যে থাকতেন মনসাও। প্রধানত বাংলা অঞ্চল এবং উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তার পূজা প্রচলিত আছে। সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে, সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশে তার পূজা করা হয়। দেবী মনসার পট দেখিয়ে বেহুলা লক্ষিন্দরের সেই চিরচেনা কাহিনী তুলে ধরা হয়। শম্ভু এঁকেছেন সে ছবিও। শীতলা দেবীর কথাও অনেকের জানা। পটে শীতলা দেবীর চিত্র প্রচুর পরিমাণে অঙ্কন করা হতো। কারণও আছে। এক সময় মহামারী থেকে বাঁচার স্বীকৃত কোন পথ জানা ছিল না এ অঞ্চলের মানুষের। রোগব্যাধির কাছে সবাই ছিল অসহায়। সুস্থতার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতেন তারা। একই প্রার্থনা হতো পটের ভাষায়। পটুয়ারা বিশেষ করে শীতলা দেবীর ছবি এঁকে তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখাতেন। এ সম্পর্কে জানতে ফোনে কথা হয় নড়াইলের প্রবীন পটুয়া নিখিল দাশের সঙ্গে। শিল্পী বলেন, বসন্ত দেখা দিলে শীতলা দেবীর ছবি এঁকে একটি বাক্সের ওপর বসিয়ে সে বাক্স গলায় ঝোলানো হতো। পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেবীর পট দেখানো হতো। এভাবে চাল ইত্যাদি সংগ্রহ করা হতো। পরে ছবির সামনে পূজার আয়োজন করে রোগমুক্তির প্রার্থনা করা হতো বলেও জানান তিনি। এভাবে যুগে যুগে কালে কালে বহু দেব-দেবীর ছবি আঁকা হয়েছে পটে। আজ তার কিছুই নেই। তবে ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে পটচিত্র।
×