ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

লালন স্মরণোৎসব বৈভবময় আয়োজনে

প্রকাশিত: ২২:২৩, ১৭ অক্টোবর ২০২০

লালন স্মরণোৎসব বৈভবময় আয়োজনে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিকেল গড়িয়ে নেমে আসে সন্ধ্যা। খোলা আঙিনায় ভেসে বেড়ায় মানবতাদী গানের সুর। সহজিয়া সেই সঙ্গীতের মর্মবাণীতে মিলিয়ে যায় ধর্ম-বর্ণের বিভেদ। সবকিছু ছাপিয়ে উচ্চকিত হয় মানুষের প্রতি ভালবাসার বারতা। গানের সমান্তরালের চলে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাউলদের পারস্পরিক ভাববিনিময়। এর আগে সকাল থেকে বিকেল অবধি নানা আয়োজন। অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোচনা, আন্তর্জাতিক সেমিনার থেকে বাউল গানের কর্মশালা। সঙ্গে ছিল সাধুমেলা। আর এমন বৈভবময় আয়োজনে স্মরণ করা হলো মহাত্মা ফকির লালন সাঁইকে। মানবতার এই মহান সাধক ও দার্শনিকের ১৩০তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে নিবেদিত হলো শ্রদ্ধাঞ্জলি। শুক্রবার থেকে দুদিনব্যাপী এ লালন স্মরণোৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। ঢাকার পাশাপাশি একযোগে দেশের ৬৪ জেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এই স্মরণানুষ্ঠান। একাডেমির বিশাল মাঠের এক প্রান্তে কুঁড়েঘরের আদলে স্থাপিত হয়েছে বাউলকুঞ্জ। এখানে শুরু হয় দিবসের প্রভাতী কার্যক্রম। মুজিবববর্ষ উপলক্ষে বাউল দল গিয়ে হাজির হয় ধানম-ির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদঘুরে। সেখানে শত বাউলের কণ্ঠে গীত হয় জাতির জনকের প্রতি বন্দনা। গান শেষে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে নিবেদন করা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। এরপর একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাউল গান ও বাউল দর্শনবিষয়ক কর্মশালা। বিকেলে ‘বিশ্ব মানবতার মুক্তিতে লালন দর্শন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়েছে নাট্যশালা মিলনায়তনে। সম্মেলক সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে এ আয়োজনের সূচনা হয়। অনেক কণ্ঠ এক সুরে গেয়ে শোনায়- এলাহি আলমিন গো আল্লাহ বাদশাহ আলমপনা তুমি/ডুবায়ে ভাসাইতে পারো ভাসায়ে কিনার দাও কারো...। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী জনাব কে এম খালিদ। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব হোসেন। ভারতের নয়াদিল্লি থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাউন্সিল ফর সোস্যাল ডেভেলপমেন্টের সভাপতি অধ্যাপক মুচকুন্দ দুবে। একইভাবে লালনের সমাজ ভাবনা ও বিশ্ব মানবতাবিষয়ক ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশ নেন লালন গবেষক অধ্যাপক ড. আবুল আহসান চৌধুরী। অনলাইন আলোচনায় আরও অংশ নেন ফ্রান্সের ইনালকো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক জেরিমি করডম। বাউল সঙ্গীত সংরক্ষণ ও বিকাশ বিষয়ক বক্তব্য রাখেন ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল মোঃ সোহেল ইমাম খান। সাঁইজির ভাববাণী পরিবেশন করেন ফকির নহির শাহ্, ফরিদা পারভীন, সমির বাউল, যুক্তরাষ্ট্রের কিথ ই কান্ত ও ফ্রান্সের দেবরা জান্নাত। কে এম খালিদ বলেন, লালনের মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ১৩০ বছর। তবু আজও লালন সমান প্রাসঙ্গিক, জনপ্রিয় ও আধুনিক। তার গান বাউল সমাজের সাধনার উপকরণ হিসেবে যেমন বিবেচিত, তেমনি সঙ্গীতরসিকের মরমি চিত্তকেও আলোড়িত করতে সক্ষম। পাশাপাশি সমাজ ভাবনার অনুষঙ্গেও তা মূল্যবান। নতুন করে সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদের উত্থানকালে, মনুষ্যত্ব-মানবতার লাঞ্ছনার সময়ে, সন্ত্রাস-নৈরাজ্যেও বৈরি যুগে লালনের গান হতে পারে প্রতিবাদের পাথেয় এবং শান্তি ও শুভবুদ্ধির প্রতীক। সমাজের প্রচলিত ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতপাতের বিরুদ্ধে লালন মানবধর্মের মতবাদ প্রচার করেছেন গানের মাধ্যমে। লিয়াকত আলী লাকী বলেন, বাংলা সংস্কৃতির পথরেখা বিনির্মাণের তিন পথিকৃতের একজন হলেন লালন ফকির। বাকি দুজন হলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। আর তাদের সৃষ্টি থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এজন্যই বঙ্গবন্ধু বাউল সঙ্গীত সংরক্ষণের বিষয়ে জোর দিয়েছেন। কোনো বাউল অন্য পেশায় যুক্ত হলে তাকে সহজিয়া ধারায় ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। সন্ধ্যায় বাউলকুঞ্জে বসেছিল বাউল গানের আসর। বাউল নূরতাজ দেওয়ান গেয়ে শোনান- বাশির পাশে আরশীনগর/সেথা এক পড়শি বসত করে/আমি একদিন ও না দেখিলাম তারে...। পাগলা বাবুল গেয়ে শোনান- এমন মানবসমাজ কবে গো সৃজন হবে/যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে’। সন্ধ্যা রাণী দত্তের কণ্ঠে গীত হয় ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’ শীর্ষক সঙ্গীত। রতন দেওয়ানের গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল ‘দয়াল নাম যার হৃদে ভরা’। হানিফ বাউল পরিবেশন করেন ‘ফকির ফিকির মাখামাখি’। এলিজা পুতুল শুনিয়েছেন ‘যার ভারে মুড়েছি মাথা’ শীর্ষক সঙ্গীত। এছাড়াও গান শোনান ফেরদৌসী লাবণী, মিতু ম-ল, জেবি ঝর্ণা প্রমুখ। আহজ শনিবার স্মরণোৎসবের দ্বিতীয় দিনের সকালে নাট্যশালা মিলনায়তনে বাউল গান ও বাউল দর্শনবিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে। বিকেলে আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। সেমিনারে বিশ্ব মানবতার মুক্তিতে লালন দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অধ্যাপক ড. শক্তিনাথ ঝা। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেবেন একাডেমির প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সুশান্ত কুমার সরকার। অনলাইনে আলোচনা করবেন পোল্যান্ডের ওয়ারশো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মি হাউ এবং লালন বিশ্বসংঘের সভাপতি আবদেল মাননান। লালন চর্চার ইতিহাস সংরক্ষণে করণীয় বিষয়ে বক্তব্য দেবেন অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল করিম। বাংলাদেশ সরকার ও ইউনেস্কোর যৌথ উদ্যোগে ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ সংরক্ষণ ও প্রসার বিষয়ে আলোচনা করবেন ইউনেস্কো ঢাকা অফিসের কর্মকর্তা কিষী তাহ্নীন। সাঁইজির ভাববাণী পরিবেশন করবেন টুনটুন ফকির, শফি ম-ল, জাপানের কয়োকো তাকাদা, শ্রীলঙ্কার সুগাত মৈত্র, পোল্যান্ডের কামিল সিজনসিড এবং জাপানের নওমি ওটানাবে (জাপান)। সন্ধ্যায় একাডেমির বাউলকুঞ্জে সাঁইজির ভাববাণী ও বাউল গান অনুষ্ঠিত হবে।
×