ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশী নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু

বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল সিলেট নগরী, এখনও লাপাত্তা আকবর

প্রকাশিত: ২২:২১, ১৭ অক্টোবর ২০২০

বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল সিলেট নগরী, এখনও লাপাত্তা আকবর

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ পুলিশী নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার মিছিলে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে নগরী। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে দোষী পুিলশকে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। নির্যাতনের আলামত নষ্ট করে পালিয়ে যাওয়া বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আকবর এখনও লাপাত্তা। রায়হান হত্যার ঘটনায় সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হওয়া অনেকেই পুলিশ লাইনে থাকলেও ঘটনার মূল হোতা এসআই আকবর হোসেন লাপাত্তা রয়েছে। তার হদিস মিলছে না। পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে পালিয়ে যায় আকবর। সিলেট মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবক রায়হানের মৃত্যুর ঘটনার পরপরই গা-ঢাকা দেয় আকবর। তার আগে সে খুনের সব আলামত নষ্ট করে দেয়। এমনকি সিসিটিভির ফুটেজও মুছে দেয়া হয়। পার্শ্ববর্তী এসপি অফিসের সিসিটিভির ফুটেজে ঘটনাটি ধরা পড়ে। আকবরের সহযোগী এক পুলিশ সদস্য ঘটনা স্বীকার করে। ওই সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ৩টার পর সিএনজি অটোরিক্সাযোগে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয় যুবক রায়হান উদ্দিনকে। রায়হান সিএনজি থেকে নেমে নিজেই হেঁটে হেঁটে পুলিশের সঙ্গে ফাঁড়িতে ঢোকেন। এ সময় তার হাতে হাতকড়া লাগানো ছিল। ভোর সাড়ে ৬টার দিকে যখন রায়হানকে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয় তখন তার দুই হাত ছিল দুই কনস্টেবলের কাঁধে। পা ছেঁচড়ে সিএনজি অটোরিক্সাতে তোলা হয় রায়হানকে। এ সময় বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর ভূঁইয়াও সেখানে ছিলেন। লাপাত্তা হওয়ার আগে সে উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়েছিল, গণপিটুুনিতে গুরুতর আহত হলে রায়হানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। তখন সে ফাঁড়িতে নিয়ে আসার কথা অস্বীকার করে। কিন্তু ঘটনা ছিল তার উল্টো। এ কারণে সিসিটিভির ফুটেজে সত্যতা পাওয়ার পর ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আকবর লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ তার সন্ধানে নামে। গত সোমবার রাতে আকবরের আশুগঞ্জের বেড়তলা গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি। এখন আকবর কোথায় আছে সেটি জানেন না পুলিশের কর্মকর্তারা। আকবর যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে দেশের সব ইমিগ্রেশন পুলিশকে বার্তা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সিলেটের সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে আকবর সম্পর্কিত অনেক তথ্য পুলিশের কাছে এসেছে। আকবর ঘটনার দিন দুপুর পর্যন্ত সাদা পোশাকে ফাঁড়িতেই ছিল বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। ওই সময়ের মধ্যে সে ঘটনার সব আলামত নষ্ট করে ফেলে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। আকবরের এক বন্ধু ফাঁড়ির সিসিটিভির ওই ফুটেজ নষ্ট করে ফেলে। এমনকি হার্ডডিস্কও সরিয়ে নতুন হার্ডডিস্ক বসানো হয়। এ কারণে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা সিসিটিভির ফুটেজে কিছুই পাননি। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটির কাছে ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, আকবরের নেতৃত্বেই ধরে আনা যুবক রায়হানকে নির্যাতন করা হয়। সে সময় সাদা পোশাকে আকবর সেখানে ছিল। যখন রায়হানকে নির্যাতন করছিল পুলিশ সদস্যরা তখন আকবর নির্যাতনকারী পুলিশ সদস্যকে ‘বাহবা’ দেয়। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বাড়তি নিরাপত্তা ॥ পুুলিশী নির্যাতনে রায়হান নিহত হওয়ার পর ঘটনাস্থল বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িটির প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা বাড়তে থাকে। প্রতিদিন প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভে ফাঁড়ির দিকে ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা যায়। হত্যার ঘটনায় ফুঁসে ওঠা জনতার হাত থেকে ফাঁড়ি রক্ষা ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এসএমপি’র বিশেষায়িত ইউনিট ‘ক্রাইসিস রেসপন্স টিম (সিআরটি)’র একদল সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল রায়হানের পরিবারের ॥ আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল রায়হানের। আমেরিকা বসবাসকারী এক চাচা রায়হানের জন্য স্পন্সরশিপ পাঠিয়েছিলেন। এরপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে দূতাবাসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল রায়হান। এরই মাঝে জন্ম হলো কন্যা সন্তান। স্ত্রীকে সময় দিয়ে আগামী নবেম্বর মাসে ভিসার জন্য ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল। এর আগেই হঠাৎ যেন যমদূত হয়ে সামনে দাঁড়ালেন এসআই আকবর। মারধর খেয়ে তার অকারণে দাবি করা ১০ হাজার টাকা দিয়ে হলেও মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন রায়হান। সৎবাবাকে ফোন করলেন, বাবা টাকা নিয়ে আসতে চাইলেন। কিন্তু, সময় দিলেন না আকবর। বাবা-মা এসে হাসপাতালে পেলেন রায়হানের নিথর দেহ। সিলেটে পুলিশের নির্যাতনে এভাবে মৃত্যু হওয়া রায়হান উদ্দিনের পরিবারের সব স্বপ্ন এখন ভেঙ্গে চুরমার। মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করে আবারও সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন। দুই মাসের সন্তান কোলে স্ত্রী তিন্নির স্বপ্ন ছিল একটা সুখের সংসার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন রায়হান। তাকে হারিয়ে দু’মাস বয়সী মেয়ে আলফাকে নিয়ে বাকরুদ্ধ রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তিন্নি (২২)। রায়হানের মা সালমা বেগম জানান, ২০১৭ সালে বিয়ে করে রায়হান। ছোট চাকরিতে যা আয় হতো তাতেই কষ্ট করে সংসার চললেও সংসার ছিল সুখের। ভিসা হওয়ার জন্য যেসব কাগজপত্র প্রয়োজন ছিল সবকিছু প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু, সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। রায়হানের মা বলেন, সারা জীবন কষ্ট করে মানুষ করা ছেলেটাকে হারাতে হলো আমার। নির্দোষ ছেলে পুলিশের কাছে নিরপরাধ বলে কান্নাকাটি করে পায়ে ধরলেও তাকে বাঁচতে দেয়া হয়নি। এভাবে যেন আর কোন মায়ের বুক খালি না হয় সেজন্য হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই আমি। প্রতিবাদ বিক্ষোভ ॥ পুলিশী নির্যাতনে নিহত রায়হানের মৃত্যুর প্রতিবাদে দলমত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে আসেন নগরবাসী। মিছিলে-স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠে রাজপথ। শুক্রবার নগরীর কোর্ট পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থানে সর্বস্তরের জনতা প্রতিবাদ বিক্ষোভে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এছাড়াও উলামা পরিষদ সিলেট, উলামা মাশায়েখ পরিষদ সিলেট ও ইসলামী ঐক্যজোট এবং সমমনা দলগুলো রায়হান হত্যাসহ দেশব্যাপী খুন, ধর্ষণ ও অন্যায়ের প্রতিবাদে মিছিল এবং মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সংগঠনের এসব প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনকালে মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে বন্দরবাজার ও আশপাশ এলাকা। দলমত নির্বিশেষে হাজার হাজার জনতা রায়হানের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে ফাঁসি নিশ্চিত করার দাবি জানান। এদিকে, উলামা পরিষদ সিলেটের প্রতিবাদ কর্মসূচীতে একাত্মতা পোষণ করে এতে যোগ দেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ।
×