ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সেই রাশিয়া

প্রকাশিত: ০০:২৬, ১৬ অক্টোবর ২০২০

সেই রাশিয়া

পূর্ব প্রকাশের পর ঘোড়ার পিঠে একটা মেয়ে। মেয়েটার পরনে ঝলমলে গোলাপি পোশাক। মাথায় রঙিন পালক। মুখে জোর করে ধরে রাখা হাসি। চোখে ভয়ের ছায়া। দড়ির উপর দিয়ে নেচে নেচে দুলকি চালে চলেছে টাট্টু ঘোড়া। অত উঁচু থেকে পড়লে ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ার দুজনেরই দফারফা শেষ! রুদ্ধশ্বাসে খেলা দেখছে দর্শক। এক সময় দড়ির শেষ মাথায় পৌঁছালো বেচারা মেয়েটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সবাই। শুরু হলো ট্রাপিজের খেলা। সুঠামদেহী ছেলেমেয়েরা শূন্যে ডিগবাজি খাচ্ছে, লাফিয়ে চলে যাচ্ছে এক ট্রাপিজ থেকে আরেক ট্রাপিজে। এরপর এলো জাগলার। তিনটে জ্বলন্ত মশালের জাগলিং দেখালো সে। সবশেষে এলো জোকার। জোকারের জোকারি শেষ হওয়ার আগেই সার্কাস থেকে বেরিয়ে এলো সাপোজনিকোভ। ত্রইকা প্রস্তুত, বরফের উপর পা ঠুকছে অস্থির তিনটে ঘোড়া। ত্রইকায় উঠলো না সাপোজনিকোভ। এগিয়ে গেল খেলোয়াড়দের তাঁবুর দিকে। ওদের সঙ্গে আলাপ করতে চায়। প্রথম তাঁবুটায় ঢুকলো সে। ধোঁয়া ওঠা বাটি থেকে গরম স্যূপ খাচ্ছে জাগলার আর গোলাপি পোশাকের মেয়েটা। তাঁবুর একপাশে বিছানা, পরিপাটি করে গুছানো। দেয়ালে একটা বেহালা ঝুলছে। এক কোনায় বড় কাঠের বাক্স। এছাড়াও তাঁবুর ভিতরে যাযাবর জীবনের টুকিটাকি। বাক্সের উপরে একটা ছবি- ছবিটায় চোখ আটকে গেল সাপোজনিকোভের। ‘প্রিভেত!’ বললো সাপোজনিকোভ। ‘প্রিভেত!’ জবাব দিল জাগলার। চোখে তার জিজ্ঞাসা- কী চায় এই রুশ বনিক? সরাসরি আসল কথায় চলে এলো সাপোজনিকোভ, ‘কত দাম নেবে ঐ ছবিটার?’ ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়লো জাগলার। ভাঙা ভাঙা রুশ ভাষায় জানিয়ে দিল বেচবে না। এটা তার দাদার দাদার কাছ থেকে পাওয়া বংশের উপহার, বেচার জন্য নয়। নিঃশব্দে চলে এলো সাপোজনিকোভ। পরদিন আবার গেল সে সার্কাস দেখতে। আবার চেষ্টা করলো ছবিটা কিনতে। এবারো ব্যর্থ হলো। জাগলারের এক কথা- বেচবো না, রাস্তা মাপো। এভাবে চললো দিনের পর দিন। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নয় কোটিপতি সাপোজনিকোভ। ছবিটা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, ছবিটা তার চাইই চাই। সার্কাস শেষ। তাঁবু গুটিয়ে চলে যাচ্ছে সার্কাস পার্টি। সেদিন শেষ চেষ্টা করতে এসেছে সাপোজনিকোভ। তাঁবুতে বসে ভোদকা খাচ্ছে জাগলার। ফুর্তিতে মেতে আছে সে। পাশে গোলাপি পোশাকের মেয়ে। খানাপিনার এলাহি আয়োজন- আস্ত চিকেন রোস্ট, আস্ত্রাখানের বিখ্যাত স্যামন, লাল-কালো ক্যাভিয়ার... - ‘প্রিভেত কোটিপতি!’ সাপোজনিকোভকে সাদর সম্ভাষণ জানালো জাগলার। আজ সে দিলদরিয়া। - ‘প্রিভেত জাগলার!’ সাবধানে উত্তর দিল সাপোজনিকোভ। বাক্সের উপরে ছবিটা এখনো আছে, লক্ষ্য করলো সে। জিজ্ঞেস করলো, ‘চলে যাচ্ছো তাহলে! ট্রেন কখন?’ - ‘আমরা যাচ্ছি না।’ মেয়েটা বললো। - ‘যাচ্ছো না! কেন?’ - ‘ট্রেন ভাড়া নেই।’ - ‘তাই নাকি!’ হাসলো সাপোজনিকোভ। ছবির দিকে ইঙ্গিত করলো সে। ‘ভাড়া জোগাড় হতে কতক্ষণ?’ আপত্তির সুর তুলেছিল জাগলার। মেয়েটা তাকে পাত্তাই দিল না। হাতবদল হলো একতাড়া নোট। দ্রুত তাঁবু থেকে বেরিয়ে ত্রইকা ছুটালো সাপোজনিকোভ। তার ওভারকোটের পকেটে তখন ছবিটা। মৃত্যুর সময় প্রিয় নাতনি মারিয়াকে ছবিটা উপহার দিয়ে গেল আস্ত্রাখানের কোটিপতি সাপোজনিকোভ।’ থামলো ইলিয়েনা। একটু গর্বের সঙ্গে বললোÑ এভাবে ছবিটা চলে এলো মারিয়া নামে এক রাশিয়ান মেয়ের হাতে। ‘১৯০৯- রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবুর্গ।’ গল্পের শেষটায় চলে এসেছে ইলিয়েনা। ‘দেশ-বিদেশের ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে সেন্ট পিটার্সবুর্গে। সেইসব ছবির মধ্যে মা আর সন্তানের একটা ছবিও আছে। ছবির মালিক মারিয়া বেনোয়া। তিনি শিল্পকলা একাডেমির অধ্যাপক লিওন্তি বেনোয়ার স্ত্রী। সেদিন প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন হেরমিতাজ মিউজিয়ামের কিউরেটর মিস্টার আর্নেস্ট লিপগার্ড। তিনি একজন নাম করা ছবি-বিশারদ। দা’ভিন্সির ছবির ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ বলা চলে তাকে। ঘুরতে ঘুরতে ছবিটার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন লিপগার্ড। কয়েক মুহুর্ত তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখলেন। তারপর সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘আরে! এই তো দা’ভিন্সির হারিয়ে যাওয়া ম্যাডোনা!’ শিল্পমহলে খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। ১৯১২- লন্ডনের ছবি ব্যাবসায়ী মিস্টার ডুভিন মারিয়াকে প্রস্তাব দিল অর্ধ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক। রাজি হলো না মারিয়া। দেশপ্রেমিক মেয়ে সে। বিদেশের ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করবে না ম্যাডোনাকে। লিপগার্ডের কাছে চিঠি লিখলো মারিয়া। ছবিটা সে পিটার্সবুর্গের যাদুঘরে দিতে চায়। যাদুঘর কিনে নিল ছবিটা। ১৯১৪- হেরমিতাজের দেয়ালে জনতার জন্য টাঙিয়ে দেয়া হলো ফুল হাতে ম্যাডোনার ছবি। তার নতুন নাম হলো ‘বেনোয়া ম্যাডোনা’। সেই থেকে নেভা নদীর তীরে পিটার্সবুর্গের যাদুঘরে শোভা পাচ্ছে দা’ভিন্সির হারানো ম্যাডোনা। হাতে তার ফুল, কোলে শিশু, মুখে মাতৃত্বের স্বর্গীয় হাসি।’ ...গল্প শেষ করে হাসলো ইলিয়েনা। আমি তখনো হা করে তাকিয়ে আছি ছবিটার দিকে। সন-তারিখ সহ এত কাহিনী শুনে আমার মাথা চক্কর দিচ্ছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত কথা তুমি জানলে কী করে?’ আমার দিকে তাকালো ইলিয়েনা। ওর সবুজ চোখে কৌতুকের হাসি, ‘আন্দাজ করো... ধাঁধাঁ!’ আন্দাজে আমি এমনিতেই কাঁচা। এখন গোলকধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম। এরপর আরও অনেক ছবিটবি দেখলাম আমরা। ইলিয়েনাও আর কিছু বললো না। আমি দু’একবার জিজ্ঞেস করলাম। সে শুধু ঠোঁট টিপে হাসলো। আর আমি মনে মনে ভাবলাম- মেয়েদের পেটে কয়টা সিন্দুক থাকে! এত সিক্রেট ওরা রাখে কোথায়! সেদিন এদিক-ওদিক ঘুরে অনেক রাতে ফিরেছিলাম আমরা। ট্রামে ফিরছি। মনে পড়লো দু’টো ম্যাডোনার কথা নোটবুকে লিখেছিলেন দা’ভিন্সি। একটা তো পাওয়া গেল তিনশো বছর পর রাশিয়ায়। আরেকটার কী হলো? পাশে বসা ইলিয়েনাকে জিজ্ঞেস করলাম। ‘কী জানি...কেউ বলতে পারে না।’ ঠোঁট উল্টে জবাব দিল ইলিয়েনা। ‘এমন তো হতে পারে ওটা চলে গেছে বাংলাদেশের দিকে?’ মজা করলাম আমি। ‘নিশ্চয়ই হতে পারে।’ হাসতে হাসতে বললো ইলিয়েনা, ‘খুঁজে পেলে কী করবে?’ ‘নিলামে বিক্রি করবো,’ আমি বললাম। ‘টাকা নিয়ে চলে যাবো টেনেরিফ দ্বীপে। আমাদের কবি বলেছেন উজ্জয়িনীর বিজন প্রান্তে কানন ঘেরা ঘরÑ সেইরকম একটা ঘর কিনবো সমুদ্রের ধারে। তারপর...’ হাসছিলো ইলিয়েনা, আমার পিঠে আলতো কিল বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘এসব কিছুই করবে না তুমি, আমি জানি। মারিয়ার মতোই করবেÑ বাংলাদেশের যাদুঘরে দিয়ে দেবে।’ কথা বলতে বলতে ইলিয়েনার স্টপেজ চলে এলো। আমাকে বিদায় জানিয়ে নেমে গেল ও। বরফ পড়তে শুরু করেছে। জানালার কাঁচ ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে কাঁচ মুছে আমি বাইরে তাকালাম। দেখি ঝিরিঝিরি বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ইলিয়েনা, হাত নাড়ছে। আমিও হাত নাড়লাম, আর তখনই বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মনে পড়ে গেল ওর পুরো নামটা ইলিয়েনা পেত্রোভিচ বেনোয়া! মনে হলো ধাঁধার উত্তরটা আমি পেয়ে গেছি। মারিয়া বেনোয়া থেকে ইলিয়েনা বেনোয়া! সেই মারিয়া বেনোয়া যিনি ছবিটা বিদেশীর কাছে বিক্রি করতে চাননি। ইলিয়েনা কী তাঁরই উত্তরপ্রজন্ম? আন্দাজ করলাম দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির কাছ থেকে বংশের গৌরবের গল্পটা উপহার হিসেবে পেয়েছে সে। সেইজন্যই হয়তো মিটিমিটি হাসছিলো। রহস্য সমাধানের আনন্দে ফাঁকা ট্রামের মধ্যে বসে হাসতে থাকলাম আমি। ট্রামটা তখন ঘটাংঘট শব্দে লেনিনগ্রাদের মধ্যরাতের নির্জন রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছে- শেষ স্টপেজের দিকে। ওখানেই নামবো আমি। (সমাপ্ত)
×