ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাপানী বড় বিনিয়োগের হাতছানি

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ১ অক্টোবর ২০২০

জাপানী বড় বিনিয়োগের হাতছানি

এম শাহজাহান ॥ করোনা মহামারী বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তাগণ উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্প সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করছেন। এতে করে বাংলাদেশ বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ওয়ান স্টপ সার্ভিস, গ্যাস বিদ্যুতের নিশ্চয়তা ও সস্তা শ্রমের মতো চার কারণে জাপানী বড় বিনিয়োগের গন্তব্য এখন বাংলাদেশ। চীন থেকে সরে এদেশে বিনিয়োগ করলে জাপান সরকারের কাছ থেকে বিশেষ প্রণোদনা পাবেন দেশটির শিল্পোদ্যোক্তারা। জাপান গাড়ি তৈরির নিজস্ব কারখানা বাংলাদেশে করার ঘোষণা দিয়েছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপান। চলতি সপ্তাহে এ সংক্রান্ত বিষয়ে ট্যারিফ কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উদ্যোগে আগামী ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ-জাপান পাবলিক প্রাইভেট জয়েন্ট ইকোনমিক ডায়ালগ (পিপিইডি) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জানা গেছে, যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপ বা পিপিইডি বৈঠকের পর আগামী বছরের শুরুতে জাপানী বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আসছে। জাপানী বিনিয়োগ হলে দেশের অর্থনীতির চাকা যেমন গতিশীল হবে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, ভূ-রাজনীতি ও করোনা সঙ্কটের কারণে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাপান। জাপানের বিনিয়োগকারীরা এখন চীন ছেড়ে অন্য দেশে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিনিয়োগের উর্বর ভূমি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দ্বিতীয় বারের মতো গত ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের দায়িত্ব নেয়ার পর জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের মেগা প্রকল্পে সরাসরি জাপান বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। বর্তমানে দেশে ৩০০ জাপানী কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছে। এক দশক আগেও দেশে মাত্র ৮২টি জাপানী কোম্পানি কাজ করত। এছাড়া করোনা সঙ্কট ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ৮৭টি জাপানী কোম্পানি চীন ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে। এছাড়া সবচেয়ে বড় যে উদ্যোগ তা হলো জাপানী মিতসুবিসি গাড়ি এদেশে তৈরি হবে। এ লক্ষ্যে কোম্পানি এদেশে কারখানা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে দেখা করেছেন জাপানী রাষ্ট্রদূতসহ দেশটির একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দল। ওই সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, জাপানী উদ্যোক্তারা এদেশে আসলে তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। জাপানী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, জাপান বাংলাদেশে অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনের চিন্তা করছে এটি হবে বাংলাদেশের আড়াইহাজারের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) জাপান বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে। এটি হবে এশিয়ায় তাদের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। জাপানী গাড়ির বড় বাজার বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশে গাড়ি তৈরির বড় কারখানাই করতে চাইছে দেশটি। ওই সময় জাপানী প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, এদেশে জাপানী গাড়ির কদর সবচয়ে বেশি। এ কারণে জাপানী উদ্যোক্তারা কারখানা করে এদেশে গাড়ি উৎপাদন ও বাজারজাত করবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে এদেশ থেকে গাড়ি রফতানিও করা হবে। চার কারণে জাপানী বিনিয়োগের হাতছানি ॥ করোনা সঙ্কটের মুখে বিশ্বব্যাপী সর্বক্ষেত্রে ব্যয় হ্রাসের একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব না হলে অনেক কারখানা টিকতে পারবে না। এ অবস্থায় চীনের মতো শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধ এবং সর্বশেষ ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধের কারণে ভূ-রাজনীতিতে চাপে রয়েছে চীন। এসব কারণে জাপান নিরাপদ বিনিয়োগের পথ খুঁজতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের নাম। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ওয়ান স্টপ সার্ভিস, গ্যাস বিদ্যুতের নিশ্চয়তা ও সস্তা শ্রমের কারণে জাপানী বড় বিনিয়োগের গন্তব্য এখন বাংলাদেশ। মূলত এই চার কারণে জাপানী বিনিয়োগের হাতছানি দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার বিদেশী বিনিয়োগে সর্বোচ্চ জোর দিয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এদিকে, জাপানের যেসব কোম্পানি এদেশে কাজ করছে তাদের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে রফতানিতে নগদ সহায়তা, মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন ফি কমানোসহ দ্রুত শুল্ক ছাড় দেয়া হবে। বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে রফতানির ক্ষেত্রে কিছু বৈষম্য চিহ্নিত করেছে জাপানী বিনিয়োগকারীরা। তাদের পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গত আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে তা সমাধানের নির্দেশনা দেয়া হয়। তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশে সম্পূর্ণ বিদেশী মালিকানাধীন ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলো রফতানির বিপরীতে সরকারের কাছ থেকে কোন নগদ প্রণোদনা পায় না। রফতানিমুখী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও একই প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব করেছেন জাপানী বিনিয়োগকারীরা। জাপানী বিনিয়োগকারীদের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) পরের অর্থবছর থেকে স্থানীয় কোম্পানিগুলো যেভাবে প্রণোদনা সহায়তা পায় বিদেশীগুলোকে একই হারে প্রণোদনা দেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অর্থ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা শেষে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ফি ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। করোনা মহামারী ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে জাপানি কোম্পানিগুলো চীন থেকে অন্য দেশে সরে যাওয়ার ঘোষণাকে কাজে লাগাতে বিশ্ব ব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচক বাড়ানোর পাশাপাশি জাপানী বিনিয়োগকারীদের সমস্যা সমাধানে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এদিকে, সংশ্লিষ্টরা বলছেন বাংলাদেশকে জাপানী বিনিয়োগকারীদের আনতে তৎপর হতে হবে। নতুন জাপানী বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ সম্পর্কে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ব্যবসায়িক পরামর্শ নেবেন। গত আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ-জাপান পাবলিক প্রাইভেট জয়েন্ট ইকোনমিক ডায়ালগের (পিপিইডি) বৈঠকে বাংলাদেশে জাপানী বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। ওই আলোচনার পর জরুরী ভিত্তিতে সমাধানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে বিডার কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, জাপানী কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ চীন থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশকে আকর্ষণীয় করে তুলতে জাপানী বিনিয়োগকারীদের উত্থাপিত বিষয়গুলোর সমাধানের জন্য বিভিন্ন সরকারী সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে বিডা। তিনি বলেন, বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের খুশি করতে ও নতুন বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করার জন্য বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদিকে, জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অধিক সম্ভাবনা ও লাভের কারণে আগামী দুই বছরে জাপানী কোম্পানিগুলো এশিয়া ও ওশেনিয়ায় তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চাইছে। সেখানে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে থাকবে। বাংলাদেশে জাপানী কোম্পানিগুলোর প্রায় ৭০.৩ ভাগ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে আর ২৩.৪ ভাগ কোম্পানি একই অবস্থায় থাকবে ও মাত্র ১.৬ ভাগ কোম্পানি ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপ কমানোর বিবেচনা করছে বলে জেট্রোর সমীক্ষায় বলা হয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ৩০০ জাপানী কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছিল, যেখানে তাদের বিনিয়োগ ছিল ৩৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এক দশক আগেও দেশে মাত্র ৮২টি জাপানি কোম্পানি ছিল। শুধু তাই নয় বর্তমানে প্রায় ৮৭ টি জাপানী কোম্পানি তাদের ব্যবসা বাণিজ্য চীন থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত করার বিষয়ে বিবেচনা করছে। জাপান সরকার এগুলোকে বাংলাদেশ বা ভারতে স্থানান্তরিত হলে তাদের ২২.১০ কোটি ডলার প্রণোদনা বা ভর্তুকি দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ১০০ ভাগ বিদেশী মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো বেতন প্রদানের জন্য করোনাকালের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কোন আর্থিক সুবিধা পায়নি। যদি এ জাতীয় বৈষম্য দূর না করা হয় তবে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত হবে না। তিনি আরও বলেন, চীন থেকে দূরে সরে যাওয়া জাপানী কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে নতুন করে বিনিয়োগের জন্য জরুরী ভিত্তিতে আগে থেকে যারা বাংলাদেশে ব্যবসা করছে তাদের সমস্যা সমাধান করতে হবে। কারণ, বিদ্যমান কোম্পানিগুলো নতুন জাপানী বিনিয়োগ আনতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে। আড়াই হাজারে জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চল ॥ জাপানী বড় বিনিয়োগ হবে জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চলে। এখানে জাপানী উদ্যোক্তারা কারখানা করে পণ্য উৎপাদন করবেন। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় জাপানী বিনিয়োগে এককভাবে এক হাজার একর অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) তৈরি করা হচ্ছে। সরকার টু-সরকার উদ্যোগে এটি বাংলাদেশের প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল। জাপানী রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরও জাপান বাংলাদেশকে দেয়া বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার চিন্তা করছে। এজন্য এফটিএ অথবা পিটিএ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। এগুলোতে জাপান বিনিয়োগ করলে লাভবান হবে। এখানে বিনিয়োগে বাংলাদেশ আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ জাপানের তৈরি গাড়ির বড় বাজার। বাংলাদেশে জাপান গাড়ি তৈরির কারখানা স্থাপন করলে তা লাভজনক হবে।
×